বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কার্যকর উদ্যেগ নেওয়ার তাগিদ
১৭ এপ্রিল ২০২১ ২১:৪৭
ঢাকা: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতি ও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিনিয়োগ আকর্ষণে দীর্ঘদিন ধরে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে অনেক আলোচনা হলেও অগ্রগতি প্রত্যাশিত নয়। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শনিবার (১৭ এপ্রিল) এক অনলাইন সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘এফডিআই ফর এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশন অ্যান্ড স্মুথ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন’ শীর্ষক ওয়েবিনারটি যৌথভাবে আয়োজন করে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ), দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ও রিসার্স পলিসি ইনটিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)।
ইআরএফ সহসভাপতি এম শফিকুল আলমের সভাপতিত্বে ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা এলডিসি থেকে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র্যাপিড চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক। করোনাভাইরাস সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রতিযোগী অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগ অনেক। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ একই সময়ে কম্বোডিয়ায় এই বিনিয়োগের পরিমাণ ৩৪ বিলিয়ন ডলার, ভিয়েতনামে ১৬১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে বার্ষিক বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ জিডিপি মাত্র এক শতাংশের মতো। সে তুলনায় ভিয়েতনামে তা প্রায় ৬ শতাংশ। অথচ সরকারের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাসহ অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বিনিয়োগের বিকল্প নেই।
বহু আলোচনা সত্ত্বেও দেশে প্রত্যাশিত বিদেশি বিনিয়োগ না আসার পেছনে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতা তথা বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজ করার সূচকে পিছিয়ে থাকাকে অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করেন ড. রাজ্জাক। বিশেষত অবকাঠামো দুর্বলতা, বিদ্যমান অবকাঠামো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারা, শ্রমিকের দক্ষতার ঘাটতি, দুর্নীতি, ব্যবসায়িক বিরোধ নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা, দুর্বল ব্যাংকিং খাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণতা, সম্পত্তির নিবন্ধনে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা, ঋণপ্রাপ্তিতে জটিলতা, বিভিন্ন অবকাঠামোর অনুমোদনপ্রাপ্তিতে জটিলতা তথা ব্যবসা শুরু করতে অনেক বেশি সময় লেগে যাওয়ার মতো কারণ হিসেবে দায়ী করেন তিনি।
ড. রাজ্জাক বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ তথা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতির পথে বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছর রফতানিতে এখনকার সুযোগ পেতে যাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যেই ইউরোপ, কানাডাসহ বড় বাজারগুলোতে রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা ধরে রাখতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
বিনিয়োগ আকর্ষণে চলমান সীমাবদ্ধতা দ্রুত সমাধান করা, বিশেষত ব্যবসা সহজ করার সূচকে উন্নতি করার পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, বিদেশিরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের এই সূচকটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। এছাড়া চীন থেকে সরে আসা বিনিয়োগ ধরতে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যবসায়ী নেতা ও এমসিসিআই’র সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বিনিয়োগ আকর্ষণে বিদ্যমান কর ব্যবস্থাকে অন্যতম বাধা হিসেবে দায়ী করেন। তিনি বলেন, বর্তমান কর প্রদান পদ্ধতি ব্যবসাবান্ধব নয়। বর্তমান কর ব্যবস্থাপনায় ব্যবসা বন্ধই করে দেওয়া উচিত। এটি ঠিক না হলে বিদ্যমান ব্যবসাই থাকবে না, নতুন ব্যবসা তো দূরের কথা।
ঢাকা চেম্বার সভাপতি মীর রিদওয়ান রহমান বলেন, বাংলাদেশে করহার অনেক বেশি। সরকারের কালো টাকা বিনিয়োগের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, কর না দিলে সাড়ে ২২ শতাংশ লাভ। কেননা কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় কর দিতে হয় মাত্র ১০ শতাংশ। তাহলে বোকার মতো কেন করে দেবো?
কালো টাকা পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ নেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন মীর রিদওয়ান। তিনি বলেন, কালো টাকা পুঁজিবাজারে ঢোকার পর ২০১০ সালে কী হলো? আমরা কী আবারও সেই পথে যাচ্ছি? পুঁজিবাজার ও আবাসনে না দিয়ে এই সুযোগ স্বাস্থ্য খাত, অবকাঠামোসহ এ ধরনের খাতে দেওয়া এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে তৈরি পোশাক খাতের বাইরে অন্যান্য খাতকেও সমান সুবিধা দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
এমসিসিআইর সভাপতি ব্যরিস্টার নিহাদ কবীর সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সমন্বয়হীনতা ও অদূরদর্শিতার একাধিক উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, এভাবে দেশ এগিয়ে যাবে না। টার্গেটেড পলিসি নিতে হবে। তিনি সরকারের একটি প্রজ্ঞাপন তুলে ধরে বলেন, মাত্র দু’টি কোম্পানির জন্য একটি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ওই পণ্য কি অন্য কোম্পানি তৈরি করে না?
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বিনিয়োগ আকর্ষণে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেন। এক্ষেত্রে বিডার পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের ঘাটতিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘দেশে কর্মরত বিদেশি ৫০ হাজার কর্মীর জন্য টিকা চাওয়া হয়েছিল। একাধিক সভা ও চিঠি দেওয়ার পরও তা এখনো পাওয়া যায়নি। তারা এই টিকা পেলে তো ইতিবাচক বার্তা যেত।’ বিনিয়োগ আকর্ষণে বিডা’র বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এসময় তুলে ধরেন তিনি।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, এই পরিস্থিতিতে (করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি) আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
অনলাইন সেমিনার ইআরএফ দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান র্যাপিড