আক্রান্তরা দ্রুত মারা যাচ্ছে, হাসপাতালে ৫ দিনে মৃত্যু ৪৮ শতাংশ
১৮ এপ্রিল ২০২১ ১৯:৪৪
ঢাকা: স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের তীব্রতা অনেক বেড়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তিরা আগের তুলনায় খুব দ্রুত মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে মারা গেছেন ৪৮ শতাংশ রোগী। একই সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের।
শনিবার (১৭ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানায় আইইডিসিআর। ২৮ জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে
প্রতিবেদনে আইইডিসিআর জানায়, কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার ৪৪ শতাংশ। ৩৩ শতাংশ সংক্রমিত ব্যক্তি প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। ১৭ শতাংশ রোগী বাড়িতে এবং ছয় শতাংশ রোগী অন্যান্যভাবে চিকিৎসা নিয়েছেন।
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাস: ৩ মাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড
প্রতিবেদনে জানানো হয়, হাসপাতালে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মারা যাওয়া রোগীদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৪৮ শতাংশ রোগী ভর্তি হওয়ার পর পাঁচ দিনের মধ্যে মারা গেছেন। হাসপাতালের ভর্তি হওয়ার ৫ থেকে ১০ দিনের ভেতরে মারা গেছেন ১৬ শতাংশ।
হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মৃত্যু পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে আইইডিসিআর জানায়, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে ৫২ শতাংশ উপসর্গ শুরুর ৫ দিনের মাথায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ২৬ শতাংশ উপসর্গ শুরুর পাঁচ থেকে ১০ দিনের মাথায় হাসপাতালে ভর্তি হন। আর করোনায় আক্রান্ত হয়ে উপসর্গ শুরুর ১১ থেকে ১৫ দিনের মাথায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১২ শতাংশ।
আরও পড়ুন: করোনাভাইরাসের চেয়ে ভয়ংকর রোগ যক্ষ্মা: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২০ ও ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেউ মারা যাননি। মার্চ মাসে পাঁচ জন ও এপ্রিল মাসে ১৬৩জন মারা গেছে। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ২৮১ জন মারা গেছেন। মার্চ মাসে মৃতের সংখ্যা ছিল ৬৩৮ যা এপ্রিলের প্রথম ১৫ দিনে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪১–এ। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ৩২ দশমিক ২ শতাংশ।
আইইডিসিআরের গবেষণা প্রতিবেদনটি যা জানানো হয়েছে-
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ বিশ্বমহামারিতে মৃত্যুর কারণগুলোকে আইইডিসিআর নিয়মিত পর্যালোচনা করে থাকে। কারণগুলো চিহ্নিত করে মৃত্যু কমিয়ে আনাই এর উদ্দেশ্য। কোভিড-১৯ মহামারিতে ২০২১ সালের মার্চে মৃতের সংখ্যা ছিল ৬৩৮, যা এপ্রিলে (১৫ এপ্রিল) বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৪১-এ। মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি ৩২.২ শতাংশ। অন্যদিকে শুধু ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে তার আগের বছরের সর্বোচ্চ হারের চেয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি মৃত্যুবরণ করেছেন (৩০ জুন, ২০২০ মৃতের সংখ্যা ৬৪ জন)।
২৮ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল ১৫, ২০২১ এর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, কোভিড-১৯। রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার ছিল ৪৪ শতাংশ অর্থাৎ এ সময় আক্রান্ত রোগীদের প্রায় বড় অংশ হাসপাতালে ভর্তি, বাকিরা প্রাতিষ্ঠানিক (৩৩ শতাংশ) বা হোম আইসলেশন এ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন।
কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত মৃত রোগীদের ৫২ শতাংশ উপসর্গ শুরুর ৫ দিনের মধ্যেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ২৬ শতাংশ উপসর্গ শুরুর ৫-১০ দিনের মধ্যেই ভর্তি হয়েছিল। ১২ শতাংশ ভর্তি হয় উপসর্গ শুরুর ১১- ১৫ দিনের মধ্যে। এ উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে কোভিড-১৯ রোগের তীব্রতা আরও বেড়েছে।
আরও পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ১০২ জনের মৃত্য
কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত মৃত রোগীদের ৪৮ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৫ দিনের ভিতরে মৃত্যুবরণ করেছেন। ১৬ শতাংশ মৃত্যুবরণ করেন ভর্তি হওয়ার ৫-১০ দিনের ভিতরে। এই উপাত্তের বিশ্লেষণেও দেখছি যে কোভিড-১৯ রোগী খুব দ্রুত মৃত্যুবরণ করছেন।
গত বছরের জুলাই মাসে যখন কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট মৃত্যুহার সর্বোচ্চ ছিল সে সময়ে নারী-পুরুষের মৃত্যুর (২২৬/৯৮২) অনুপাত ছিল ১:৩.৫। এ বছরের এপ্রিলে এসে দেখা যাচ্ছে যে নারী-পুরুষের মৃত্যুর (২৬৩/৬১৪) অনুপাত ১:২.২৩। অর্থাৎ গত বছরের চাইতে নারী বেশি হারে মৃত্যুবরণ করছেন।
করোনায় মনের যত্ন
বৈশ্বিক মহামারি পরিবর্তন করেছে মানুষের মনোজগৎ, তা আমরা আঁচ করতে পারি মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত মানসিক রোগের হার সংক্রান্ত জরিপের ফলাফলে। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা (৬.৭ শতাংশ) আর দুশ্চিন্তার (৪.৭ শতাংশ) সমস্যা ছিল। কোভিডকালে বাংলাদেশে পরিচালিত কয়েকটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা আর ৩৩ শতাংশের এংজাইটি বা দুশ্চিন্তার লক্ষণ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ সাধারণ সময়ের চেয়ে কোভিডকালে মানসিক সমস্যা বাংলাদেশেও বেড়ে যাচ্ছে।
গত একবছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৪ হাজার, যা পূর্ববর্তী বছরগুলাের চেয়ে বেশি। সুনির্দিষ্টভাবে কোভিড নিয়ে কুসংস্কার, স্টিগমা, কোভিড ভীতিতে প্রায় ৫ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক, চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, মৃত্যুভয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, বেকারত্ব; এসব কারণে বাড়ছে মানসিক সংকট।
করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মানসিকচাপ, বার্ন আউট হচ্ছে, যা কোভিড-১৯ এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
কোভিড -১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয়
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে করণীয়- কোনভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আতঙ্ক মানুষের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধে ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। মানসিক চাপ হ্রাস করতে হবে। এ জন্য যা করতে হবে- ঘুমানোর স্বাভাবিক সময় ঠিক রাখা, নিজের পছন্দের বিষয় ও কাজের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া, পরিবারের সঙ্গে গুণগত সময় কাটানো (যেমন পরস্পরকে উৎসাহ দেওয়া, পরস্পরের কাজে সহযোগিতা করা, ঘরের মধ্যেই একসঙ্গে সময় কাটানো ও পছন্দের কাজ করা), প্রতিদিন কিছুক্ষণ সময় অবশ্যই শারীরিক ব্যায়াম করা, নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে ঘরেই প্রার্থনা করা ও আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। সর্বোপরি এ কঠিন পরিস্থিতিতেও টিকে আছি, বেঁচে আছি এ জন্য সন্তুষ্ট থাকা, সবার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। কিন্তু কোনোভাবেই পরিস্থিতি বা রোগ কোনো কারণেই কারো প্রতি করুণা প্রকাশ করা যাবে না।
অতিরিক্ত আতঙ্ক, অস্থিরতা, মানসিক চাপ, বিষন্নতা, ঘুমের ধরন পরিবর্তন ও আচরণগত পরিবর্তন দেখা গেলে আপনার কাছের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। অথবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর এর হটলাইন যোগাযোগ করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে গ্রহণ করুন।
যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে জাতীয় কল সেন্টার ৩৩৩-১ বা বাতায়ন ১৬২৬৩ নম্বরে যোগাযোগ করার বিষয়েও জানানো হয় প্রতিবেদনে।
সারাবাংলা/এসবি/একে