করোনা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগে সহনশীল ও জনগণকে সচেতন হতে হবে
২৭ এপ্রিল ২০২১ ০০:২০
ঢাকা: পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও একবছরের বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণে ভুগছে। এর মধ্যে গত মার্চ থেকে এই সংক্রমণ ফের মাত্রা ছাড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর সেই বিধিনিষেধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে মাঠে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কখনো কখনো আইন প্রয়োগে মানবিকতার অভাব দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার জনগণের মধ্যেও বিধিনিষেধ অনুসরণ না করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারি নিয়ন্ত্রণে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন অনুসরণ করে সরকার আন্তঃমন্ত্রণালয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। তবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মানবিক হতে হবে। একইসঙ্গে জনগণকেও বিধিনিষেধ মেনে চলার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালালেই কেবল সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সারাবাংলা ডটনেট আয়োজিত আইন বিষয়ক নিয়মিত ভার্চুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠান ‘সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বারস’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। ‘সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বারে’র এই পর্বের আলোচনার বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এর বিস্তার: অপরাধ ও দণ্ড’।
ব্যারিস্টার ইফ্ফাত গিয়াস আরেফিনের পরিকল্পনা ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক। এছাড়া বিশেষ আলোচক ছিলেন নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি খুলনার সহকারী অধ্যাপক ও প্রক্টর ড. আশিকুদ্দিন মো. মারুফ এবং সারাবাংলা ডটনেটের অ্যাক্টিং নিউজ এডিটর তরিকুর রহমান সজীব।
আলোচনায় প্রধান আলোচক অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য আমাদের যা আছে, তা কিন্তু যথেষ্ট নয়। কেবল আইনের মাধ্যমে যে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তা নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ যারা রয়েছেন, তাদের সবার পরামর্শের ভিত্তিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। তারাই বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দিচ্ছেন যে কোন কোন ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করলে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব।
তিনি বলেন, গত বছর যখন করোনা সংক্রমণ শুরু হলো, তখন কিন্তু আমরা বিধিনিষেধগুলো মেনে চলেছিলাম। তখন আমাদের হাতে কোনো ভ্যাকসিন ছিল না। যখন আমাদের হাতে ভ্যাকসিন এলো, আমরা ভাবলাম করোনাভাইরাসে আর আমরা আক্রান্ত হব না। এরপরই সংক্রমণ বাড়তে লাগল।
চলমান পরিস্থিতিতে সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধগুলো মেনে না চললে কী করণীয়— এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, ১৮ দফা কিন্তু বাধ্যতামূলক না। এটি একটি সচেতনতামূলক নির্দেশনা। এগুলো মানলে সংক্রমণ কমানো সম্ভব। সংক্রমণ ব্যধি সংক্রান্ত যে আগের আইন রয়েছে, সেটি কিন্তু এ ধরনের সংক্রমণের কথা চিন্তা করে করা হয়নি। কেউ যদি লকডাউন সংক্রান্ত বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করে বিস্তার ঘটায়, তাহলে সেই আইনের ২৪ ধারায় ও ২৬ ধারায় সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে। কিন্তু পুলিশ জরিমানা করছে তাদের পুলিশি আইনে। জরিমানা করা হচ্ছে মাস্ক না পরার জন্য, গণজমায়েতের জন্য।
আইন না মানলে জরিমানা করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কাউকে যদি ফাইন বা কোনো সাজা দেওয়া না হয়, তাহলে পুলিশ বাহিনী যে একটি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, সেটি কিন্তু আমাদের উপলব্ধির মধ্যেই আসছে না। সেটি উপলব্ধিতে আনার জন্য অবশ্যই আইন প্রয়োগের প্রয়োজন আছে।
তিনি বলেন, নিজেকে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে হলে আমাদের আইন মেনে চলতে হবে। যখন আমরা এসব মানার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছি না, তখন ফাইন বা শাস্তিপ্রয়োগ করা উচিত। সেটি না করতে পারলে এটি সম্ভব না। কেউ যখন টিভিতে দেখে যে আইন না মানলে ফাইন করা হচ্ছে, সাজা দেওয়া হচ্ছে, সে কিন্তু বের হবে না। যদি দেখে যে সবাই স্বাধীনভাবে ঘুরছে, তাহলে সবাই বের হবে। তাই সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনগণ সবাই মিলে চাইলে এই মহামারি রোধ করা সম্ভব।
ড. আশিকুদ্দিন মো. মারুফ বলেন, সরকার সবাইকে বলেছে মাস্ক পরার জন্য। আমি যদি মাস্ক না পরে দোকানে যাই, তাহলে আমি একটি ফৌজদারি অপরাধ করলাম। আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে বিচারের সম্মুখীন করা হতে পারে, ২৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে। এ ব্যাপারে কিন্তু আমাদের সাধারণ জনগণের মাঝে তেমন কোনো সচেতনতা নেই।
তিনি বলেন, অনেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অবস্থায় গোপন করে বাইরে বের হচ্ছেন। এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। তাদের ২০১৮ সালের সংক্রামক ব্যাধি নির্মূল আইনে তিন মাস পর্যন্ত জেল, ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
তবে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের লোকজনের সংখ্যা বেশি। ঢাকায় কেউ হয়তো ফ্লাক্সে করে চা বিক্রি করছেন বা কেউ রিকশা চালিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। তারা কিন্তু এই লকডাউনের মধ্যে এসব কিছু বন্ধ করে সংসার নিয়ে চলতে পারবে না। আমাদের দেশের যে আর্থসামাজিক অবস্থা, তাতে কিন্তু সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয় যে প্রত্যেককে পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তার মধ্যে আনা। আমাদের দেশে এই অবস্থা নেই। সেই জিনিসগুলো আমাদের বুঝতে হবে।
আইনের এই শিক্ষক আরও বলেন, একটি ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, একজন প্রতিবন্ধী রিকশাওয়ালাকে পুলিশ চড় মেরেছে। সেই চড়ের পর রিকশাওয়ালা বসে পড়েছেন, আর উঠতে পারছেন না। কিছু সচেতন মানুষ সেটি ভিডিও করে সবার নজরে এনেছেন। নোয়াখালীতেও এক যুবককে কয়েকজন পুলিশ জোর করে রিকশা থেকে নামিয়ে গায়ে হাত দিয়েছে। এই জিনিসগুলো ভিডিওর মাধ্যমে সবার সামনে এসেছে। আমাদের পুলিশ বা সবাই যে এমন তা কিন্তু নয়, কিন্তু এমন ঘটনা ঘটছে। মূলত লকডাউন পালন বা কার্যকরের জন্য পুলিশকে মাঠে নামানো হয়েছে। কিন্তু সেটা যদি নির্যাতনের পর্যায়ে চলে যায়, মানুষ যদি সামাজিকভাবে, শারীরিকভাবে আহত হয়, তখন আইনশৃঙ্খলার দিকে তীর্যকভাবে দৃষ্টি যায়। তাহলে কিন্তু লকডাউন সিচুয়েশন বা আইন— সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন চলে আসে। সেক্ষেত্রে সবদিক বিবেচনা করে সম্মিলিতভাবে এই মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
আলোচনায় মুভমেন্ট পাস
এদিকে, সরকার বিধিনিষেধ জারির পর রাজধানীতে জনচলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘মুভমেন্ট পাস’ চালু করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এই মুভমেন্ট পাস নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। লাইভে দর্শকরাও মুভমেন্ট পাস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এ বিষয়ে তরিকুর রহমান সজীব বলেন, সরকার করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে কঠোর বিধিনিষেধ জারির পর পুলিশ মুভমেন্ট পাস চালু করেছে। এই মুভমেন্ট পাস হলো জরুরি প্রয়োজনে চলাচলের জন্য অনুমতিপত্র, যা পুলিশের ওয়েবসাইট থেকে ফরম পূরণ করে সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু বিধিনিষেধ জারির প্রজ্ঞাপনেই উল্লেখ ছিল, জরুরি প্রয়োজনে চলাচলের জন্য বাড়তি অনুমতির প্রয়োজন নেই। পাশাপাশি করোনা মোকাবিলায় সম্মুখযোদ্ধা যেমন— চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, নিত্যপণ্য সরবরাহকারী, সংবাদপত্রের কাজে যারা নিয়োজিত, তারা এই বিধিনিষেধের আওতার বাইরে। পুলিশের চালু করা মুভমেন্ট পাসের ভিত্তিটা কী, সেটি তিনি জানতে চান অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হকের কাছে। মুভমেন্ট পাস ডিজিটাল সেবা হওয়ায় এর মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন কি না, সেটিও জানতে চান তিনি।
তরিকুর রহমান সজীব আরও বলেন, আমাদের যে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন আছে, তার আওতায় মহামারি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া বাকি বিষয়গুলোতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো কার্যকর ভূমিকা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এ বিষয়টির আইনি ব্যাখ্যাও জানতে চান তিনি।
এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল হক বলুন, পুলিশকে লকডাউন কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন পুলিশ কোন আইনের মাধ্যমে মুভমেন্ট পাস চালু করেছে, সেটি সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। তবে পুলিশকে যখন জনচলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই দায়িত্বটা পালনের জন্য তারা একটি টুল বা পদ্ধতি হিসেবে মুভমেন্ট পাস চালু করেছে।
তিনি আরও বলেন, অনেকেই বলে থাকেন, চিকিৎসকরা গাউন পরিহিত থাকলে আইডি কার্ড দেখাতে হবে কেন? কিন্তু এই বিধিনিষেধের সময়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে চিকিৎসক না হয়েও কেউ গাউন পরে বের হতে পারেন। অনেকেই জরুরি পণ্যের নামে অন্য পণ্য নিয়ে যাতায়াত করতে পারেন। তাদের প্রত্যেককে তো আলাদা আলাদাভাবে চেক করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব না। তাই রাস্তায় চেক করার কাজটি সহজ করার জন্য পুলিশ মুভমেন্ট পাস চালু করেছে যেন পাস দেখালেই তারা ছেড়ে দিতে পারে, চেক করতে না হয়। মুভমেন্ট পাসকে তাই পুলিশের কাজের সুবিধার্থে একটা টুল হিসেবে দেখতে হবে। ফলে এটি আইন বহির্ভূত কিছু নয়।
আইন প্রয়োগের দিক থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতর নিষ্ক্রিয় কি না— এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল বলেন, করোনা মহামারি গোটা বিশ্বের জন্যই নতুন এক অভিজ্ঞতা। এখানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হলেও এর সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতো অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও যুক্ত। ফলে অনেক বিষয়েই কিন্তু আন্তঃমন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও এখানে ভূমিকা রাখছে। এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখাটাই ভালো হবে।
সারাবাংলা/এসএসএ/টিআর
অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক ড. আশিকুদ্দিন মো. মারুফ ব্যারিস্টার ইফ্ফাত গিয়াস আরেফিন সারাবাংলা লিগ্যাল চেম্বার