Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য, জীবনকে চায় ভালোবাসতে

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৩০ এপ্রিল ২০২১ ২৩:০৯

ঢাকা: হাতুড়ি-শাবল কিংবা কাস্তের ছন্দ যেন গতি আসে শ্রমজীবী মানুষের জীবনে। এই ছন্দের তালেই উচ্চারণ করতে হয় অধিকারের কথা, জানাতে হয় দাবির কথা। সেই জন্য মেহনতি মানুষের মাঝে বছরঘুরে আসে একটি দিন। সেটি হলো ১ মে। শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির অঙ্গীকার নিয়ে দিনটি পালিত হয় সারাবিশ্বে।

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড ১৯) পরিস্থিতিতে এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উচ্চারিত হচ্ছে অধিকারের কথা। মৃত্যু-জরা-জীর্ণতার মধ্যে উচ্চারিত হচ্ছে শ্রমিকদের চাওয়া-পাওয়ার কথা।

বিজ্ঞাপন

‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।

চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালবাসতে।’

বর্তমান এই কঠিন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার এই পঙক্তিগুলো যেন অনিবার্য সত্য হয়ে ওঠে। সারা পৃথিবী আজ ভয়ঙ্কর এক অসুখে ভুগছে। বিধ্বস্ত পৃথিবীতে মানুষ আজ ঘরবন্দি। বেঁচে থাকার লড়াই চলছে এক অদৃশ্য ভাইরাসের সঙ্গে।

হোঁচট খেয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য, হাতুড়ি-কাস্তের শব্দ ম্লান হতে বসেছে মহামারিতে। প্রায় কর্মহীন মানুষ, দেশজুড়ে চলছে কঠোর বিধি-নিষেধ। এর মাঝেই আজ সেই বিশেষ দিন।

প্রতি বছর সারা বিশ্বে এই দিনটি পালিত হয় প্রতীকী দিন হিসেবে। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষদের দিন হিসেবে। মে দিবস হাজার হাজার শ্রমিকের পথ চলা মিছিলের কথা, একই পতাকা তলে দাঁড়িয়ে আপসহীন সংগ্রামের কথা। মে দিবস দুনিয়ার সব শ্রমিকদের এক হওয়ার দিন। আন্তর্জাতিক সংগ্রাম আর সৌভ্রাতৃত্বের দিন। মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের কাছে জাগরণের গান, সংগ্রামের ঐক্য ও গভীর প্রেরণা।

বিজ্ঞাপন

মে দিবস আসলে শোষণমুক্তির অঙ্গীকার, পুঁজিপতিদের শাসন-শোষণ উপেক্ষা করে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার দিন।

মেহনতি মানুষদের এই আন্দোলনের পথ কখনও মসৃণ ছিল না। ছিল নানা ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে মোড়া। জুলুম, অত্যাচার, প্রতিরোধ, ধর্মঘট, মিছিল, সংগ্রামের কাহিনি রয়েছে এ দিনটার পেছনে।

১৮৮১ সালে নভেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আমেরিকান ফেডারেশ অব লেবার’। ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর সেখানে চতুর্থ সম্মেলনে গৃহীত হয় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বলা হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে সব শ্রমজীবী মানুষ আট ঘণ্টার বেশি কোনোভাবেই কাজ করবে না। ওই দিনটিতে তাই পাঁচ লক্ষ শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে ধর্মঘটে যোগ দেন। শাসকদল এই ঐক্যবদ্ধ বিশাল শ্রমিক সমাবেশ ও ধর্মঘট দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়।

৩ মে ম্যাককর্মিক হার্ভাস্টার কারখানায় নির্মম পুলিশি আক্রমণ চলে, তাতে প্রাণ হারান ৬ জন নিরীহ শ্রমিক। এর পরের দিন ৪ মে হে মার্কেট স্কয়ারে আয়োজিত হয় এক বিশাল প্রতিবাদ সভা। পুলিশ এই সভায় গুলি চালালে শহিদের রক্তে রাঙা হয় হাতের পতাকা। গ্রেফতার করা হয় চারজন শ্রমিক নেতাকে। বিচারের নামে শুরু হয় প্রহসন, জারি করা হয় ফাঁসির আদেশ।

দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে এই নৃশংস বর্বরতার খবর পৌঁছয় দুনিয়ার সব মেহনতি শ্রমজীবি মানুষের কানে। ১৮৮৯ সালে জুলাই মাসে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথমদিনের অধিবেশনেই সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয় যে ১৮৯০ সালে ১ মে থেকে প্রতি বছর এই দিনটি পালিত হবে। এভাবেই ১৮৮৬ সালের ঐতিহাসিক মে দিবস ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক মে দিবসে পরিণত হলো।

এই মহামারিকালে, এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের বেঁচে থাকার লড়াই সবচেয়ে কঠিন। এই আর্থিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন বহু শ্রমজীবী মানুষ। করোনার অভিঘাত কেবল দেশের মধ্যেই হয় এই মহামারি এখন বিশ্বপ্রান্ত ছুঁয়েছে।

করোনার আশঙ্কায় এরইমধ্যে প্রবাসী শ্রমিকরা দলে দলে ফিরেছে দেশে। পরিসংখ্যান বলছে, বছর পেরিয়ে গেলেও কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীদের ৪৭ শতাংশই এখনও আয়ের জন্য কাজে যুক্ত হতে পারেনি। হলে দৈনন্দিন খরচ চালাতে তাদের অনেককেই পরিবারের আয় বা আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। অন্যদিকে ৫৩ শতাংশ কৃষিকাজ ছোটখাটো ব্যবসা বা শ্রমিক হিসেবে নিজেকে যুক্ত করে বর্তমান পরিবার চালাচ্ছেন। তবে বিদেশ ফেরতদের ৯৮ শতাংশ এখনও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন।

বিদেশ ফেরত ৭৪ শতাংশ শ্রমিক তাদের ভবিষ্যত নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

মে দিবসে দেশের শ্রমিক শ্রেণিসহ শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং শ্রম দাসত্বের জোয়াল ভেঙে অধিকার ও মুক্তি অর্জনে শ্রমজীবী-মেহনতিদের রাজপথের সংগ্রামী ঐক্য আরও জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।

তিনি বলেন, ‘করোনার এই দুর্যোগেও শ্রমিক মেহনতি মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদনের চাকা অব্যাহত রেখেছে। অথচ তাদের জীবন ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ হয়নি। সরকার ও মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দেওয়া ওয়াদা রাখেনি। লকডাউনে ৩/৪ মাইল হেঁটেই তাদের অধিকাংশকে কারখানায় আসতে হয়। তাদেরকে ন্যূনতম ঝুঁকিভাতাও দিচ্ছে না।’

‘সরকার ও মালিকপক্ষ শ্রমিকদের উৎপাদনের যন্ত্রের বেশি মনে করে না। শ্রমিকদের তারা কেবল উৎপাদন বাড়াতে বলেন কিন্তু তাদের ন্যূনতম ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারসহ তাদের গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার দেয় না’ বলে অভিযোগ সাইফুল হকের।

দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন। শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য শ্রমিকের খাদ্য, জীবন, স্বাস্থ্য এবং চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত; করোনা পরিস্থিতিতে কর্মরত শ্রমিকদের ঝুঁকিভাতা, ২০ রোজার মধ্যে মূল মজুরির সমান বোনাস ও বকেয়া পরিশোধ; বাঁশখালী, রানা প্লাজা ও তাজরীনসহ সব শ্রমিক হত্যার বিচার; নিহত শ্রমিকদের আইএলও কনভেনশন অনুসারে ক্ষতিপূরণ; অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত; সংবিধান ও আইএলও কনভেনশন অনুসারে শ্রম আইন সংশোধন; গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবনধারণের উপযোগী মহার্ঘ ভাতা এবং শ্রমিকের রেশন, বাসস্থান, চিকিৎসার জন্য আসন্ন বাজেটে বরাদ্দের দাবি জানানো হয়েছে।

এদিকে মে দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ১৯৭২ সালে জাতির পিতার উদ্যোগ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে এবং আইএলও’র ৬টি কোর কনভেনশনসহ ২৯টি কনভেনশন অনুসমর্থন করে। এটি শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের অধিকার রক্ষায় এক অনন্য মাইলফলক।’

তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ সংক্রমণ জনিত মহামারিতে বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়াল থাবা আঘাত হেনেছে। ফলে গভীর সংকটে পড়েছে শিল্প-প্রতিষ্ঠানসহ দেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ। এ পরিস্থিতিতে সরকার জনগণের পাশে থেকে ত্রাণকাজ পরিচালনাসহ সর্বাত্মক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সরকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তাই কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’

তিনি সরকারের পাশাপাশি শিল্প-প্রতিষ্ঠানের মালিকগণকেও শ্রমজীবী মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহবান জানান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শ্রমজীবীদের মানুষের পাশে দাঁড়াতে বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

মে দিবসের ধাক্কা বিশ্বের শ্রমিকদের সংহতি যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি তাদের ওপর শোষণের বিরুদ্ধেও প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। মে দিবসের পথ ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের অধিকার, বিশেষ করে মজুরি, কাজের পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা—এসব ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। কিন্তু গত দুই দশকে বিশ্বায়নের ফলে অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও সমৃদ্ধি বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে বৈষম্য ও বঞ্চনা।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সারা দেশ কবে মুক্তি পাবে তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে দেশের প্রতিটি মানুষ। তবে একদিন না একদিন করোনা-ভীতি থেকে সারা দেশ মুক্ত হবে, আসবে আবার নতুন দিন। আবারও শান্ত হয়ে এই অশান্ত পৃথিবী।

সবার লড়াই করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে, সেই যূথবদ্ধ লড়াই চালাতে হবে আমার পাশে থাকা শ্রমজীবী মানুষের জন্য। শ্রমিকদের জীবনে যে আঁধার নেমে এসেছে তা কেটে যাবে। আবার জীবন ঘুরে দাঁড়াবে, কল-কারখানার চাকা পুরোদমে আবার ঘুরবেই।

আবারও ‍মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে উঠুক অধিকার আদায়ের স্পর্ধায়। সার্থক হোক শ্রম দিবসের লড়াই।

ছবি: শ্যামল নন্দী, স্থান: চট্টগ্রামের মাঝিরঘাট এলাকা।

সারাবাংলা/একে

করোনা কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাস মে দিবস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর