অপরিপক্ক ফলে বাজার সয়লাব, নেই প্রশাসনের নজরদারি!
৩ মে ২০২১ ১২:২২
ঢাকা: ‘হয়তো দু-চার বছর বাজার থেকে ফল-ফলাদি কিনেছে সন্দেহ ছাড়াই। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ইচ্ছে মতো খেতেও পেরেছি। কিন্তু এ বছর আর পারছি না’— রোববার (২ মে) দুপুরে রাজধানীর বাদামতলী ফল আড়তে ষাটোর্ধ্ব বয়সী ইমরান হাসান এভাবেই বিড় বিড় করে কথাগুলো বলছিলেন আর এদিক ওদিক দেখছিলেন।
এ সময় ইমরান হাসানের কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোথায় র্যাবের আদালত? কোথায় ভোক্তা অধিকার? কোথায় নিরাপদ খাদ্য অধিদফতর? আর কোথায় বিএসটিআই? তারা আসুক, দেখে যাক, বাজারে কী উঠেছে। বাজারে আম ভরে গেছে। এত আগে আম পাকছে কিভাবে? এগুলো বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো হয়েছে। কাঁঠাল উঠেছে। পছন্দ হয়নি, তাই কিনতে পারলাম না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো- এবার ফল খেতে পারব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’
ইমরান হাসান আরও বলেন, ‘কয়েক বছরতো শান্তি করে ফল খেলাম। গেল বছরগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সরব উপস্থিতি ছিল। গাছ থেকে আম নামানোর একটা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সেটা এবার করা হয়নি। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে কিছু ব্যবসায়ী। রাষ্ট্র বা সরকার এদের রুখতে না পারলে ভবিষ্যত প্রজন্ম বিভীষিকা ছাড়া কিছুই দেখবে না।’
বাদামতলী ফল বাজার ঘুরে দেখা যায়, অপরিপক্ক ফলের মধ্যে আম ছাড়াও এসেছে কাঁঠাল, লিচু এবং জামরুল। বোঝাই যাচ্ছে এসব ফল এখনো ঠিকমতো পাকেনি। লিচু পাকলে দেখতে টসটসে লাগে। সেখানে মনে হচ্ছে জোড় করে ছিঁড়ে আনা হয়েছে।
কাঁঠালের বিষয়ে জানতে চাইলে আড়তদার বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি, স্যার আপনি সাংবাদিক। এই কাঁঠাল নিয়েন না। খেতে পারবেন না। আপনি কাঁঠাল খাইতে চাইলে আরও এক মাস পরে আসেন। আম-লিচু কিছুই কিনেন না এখন। সবই অপরিপক্ক।’
তাহলে এগুলো আনছেন কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আড়তদার। আমরা কিছু আনি না। এখানে এনে দিয়ে যায়। আমরা বিক্রি করি। যাদের দরকার তারা নিয়ে যায়। আমরা কাউকে জোর করে দিই না। যদি এসব অপরিপক্ক ফল না আসতো তাহলে আমরা বিক্রি করতাম না।’
ওই আড়তদার জানান, এর আগে সপ্তাহে তিনদিন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসতো। তখন অপরিপক্ক ফল-ফলাদি উঠতো না। এখন ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান নেই। তাই আবার অপরিপক্ক ফল ওঠা শুরু হয়েছে। এ জন্য অভিযান নিয়মিত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছর ফলের বাজার ভালো ছিল। কোনো ব্লেইম ছিল না। এখন আবার ফল নিয়ে মানুষের মধ্যে অনিহা শুরু হয়েছে।’
রোববার (২ মে) বেলা আড়াইটা। রাজধানীর অন্যতম ফল বাজার যাত্রাবাড়ী। বাঙ্গি, তরমুজ, আনারস, জামরুল, সফেদা, তালবীজ, পেয়ারা, লিচু, আম আর জাম সাজানো রয়েছে জামান ফল ভাণ্ডারে। মালিক নুরুজ্জামান আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এর মধ্যে আম, তালবীজ আর লিচু ছাড়া নিঃসন্দেহে যে কোনোটাই কিনতে পারেন। আমগুলো অপরিপক্ক, ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়েছে। লিচুগুলো এখনো পরিপূর্ণ হয়নি আর তালবীজ খেয়েও স্বাদ পাবেন না। সফেদায় আরও কিছুদিন পর পরিপূর্ণ স্বাদ আসবে ‘
এই ফলগুলো বেশি দামের আশায় পরিপক্ক হওয়ার আগেই গাছ থেকে পেড়ছে। কারা এগুলো নিয়ে এসেছে? জানতে চাইলে আহমেদ বলেন, ‘অনেক সময় কৃষক নিজেই বেশি মুনাফার আশায় অপরিপক্ক ফল নিয়ে আসে। আবার ব্যবসায়ীরাও কোনো কোনো সময় জোর করে নিয়ে আসায়। আবার ব্যবসায়ীরাও এখন আগেই গাছ কিনে রাখে। ফলে তার কর্তৃত্বটা বেশি থাকে।’
আম কিনে প্রতারিত হয়েছেন রবি হাসান নামে এক ব্যক্তি। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গত ২৭ মার্চ গুলশান-২’র একটি গলি থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে আম কিনেছিলাম। বাসায় এনে ইফতারির আগে আম্মা কাটতে গিয়ে দেখে, আমে কোনো আটি নেই। এমনকি গন্ধও নেই। এটা যে আম নামক ফল তার কোনো কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। কোনো কোনোটার বাইরে শক্ত, আবার কোনোটার ভেতরে কালো হয়ে গেছে। যে ভাব নিয়ে আম কিনেছিলাম, কাটার পর ফিউজ হয়ে গেছি।’ তার দাবি, রাজধানীতে অবিলম্বে অভিযান পরিচালনা করা দরকার।
রোববার (২ মে) রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে দেখা গেছে, ভ্যানে করে আম বিক্রি করা হচ্ছে। বিক্রেতাদের বেশির ভাগই যাত্রাবাড়ী, কারওয়ান বাজার আর বাদামতলীর ফল বাজার থেকে এসব আম কিনে বিক্রি করছে। আড়তে এসব আম ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি কিনলেও অলিগলিতে তা ১৫০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছে তারা।
এর আগের বছরগুলোতে অপরিপক্ক ফলের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চললেও এবার নেই কেন? জানতে চাওয়া হয় র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসুর কাছে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘রোজায় ভেজাল ট্যাং, ভেজাল সেমাইসহ ভেজাল খাদ্য নিয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে। আমের বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। সেরকম কিছু পেলে অবশ্যই অভিযান চালানো হবে।’
এদিকে র্যাব সূত্রে জানা গেছে, কখন কোন অভিযান চালানো হয় প্রতিমাসে মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে একটি গাইডলাইন দেওয়া হয়ে থাকে। এবার আম নিয়ে অভিযানের বিষয়ে এখনো কোনো গাইড লাইন দেয়নি মন্ত্রণালয়গুলো। এরপরেও যেসব জেলায় বেশি পরিমাণে আম চাষ হয় সেখানকার জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেটরা নির্দিষ্ট সময়ের আগে যেন আম ছেঁড়া না হয় সেজন্য কাজ করছে বলে সূত্র জানায়।
র্যাব সূত্র বলছে, তরমুজসহ যে ফলগুলো বাজারে রয়েছে এগুলোর তদারকি সংস্থা মূলত বাংলাদেশ কৃষি বিপণন অধিদফতর। তারা কেন মাঠে কাজ করছে না? তাদের কেন আবেদন-নিবেদন নেই? তারা মাঠে সরব ভূমিকা পালন করলেই ফলের বাজার অন্তত অস্থিতিশীল হতো না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের উপ-পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘শুধু অভিযান চালিয়ে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। চাহিদা থাকলে যোগান আসবেই। আমাদের উচিত চাহিদা বন্ধ করা। এখন কেন আমরা আম কিনতে যাই। কোনো যুক্তিতেই এখন পরিপক্ক আম বাজারে আসবে না। নিজের গাছের আমটাও তো পাকেনি এখনো। তাহলে বাজারে এসব কীভাবে আসছে বুঝতে হবে।’ এরপরেও বাজারে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম