অতলান্তিক পেরিয়ে পর্ব ২
৭ মে ২০২১ ১০:০০
হঠাৎ ঘাড়ের উপর এসে পড়া কিছু বিষয়ে কারো হাত থাকে না। দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশের বাইরে চলে যাওয়াটা ছিল ঘাড়ের উপর এসে পড়ার মতই একটা ব্যাপার। তবে যাহা কর্তব্য তাহা কর্তব্য। ভিসা পাবার আগে দিনগুলো যেন চলছিল কচ্ছপের পিঠে চড়ে। ভিসা পাবার পর দিনগুলো কচ্ছপের পিঠেই থাকল, তবে কচ্ছপ চড়ে বসল ঘোড়ার পিঠে। অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে কাটতে থাকল সময়। ইউএস অ্যাম্বেসির সেই অফিসার বলেছিল যেখানে যাচ্ছি সেখানে বেশ ঠান্ডা, তাই গরম জামাকাপড় নেয়ার একটা ব্যাপার আছে। আমি ওয়ালথামে আমার কলিগদের সাথে যোগাযোগ করেছি। তারা বলেছে, ভাই, ঠান্ডায় মারা যেতে না চাইলে ভাল জামাকাপড় নিয়ে আইসেন। আর হ্যান্ডগ্লাভস আনবেন অবশ্যই, তা না হলে ফ্রস্ট-বাইট হয়ে যেতে পারে। শুনেই ভয় লাগছে খুব। এত কিছু নিতে গেলে লাগেজ কয়টায় গিয়ে ঠেকে সেই চিন্তা হচ্ছে। কোথাও বেড়াতে গেলে আমি যতটা সম্ভব কম লাগেজ নেয়ার চেষ্টা করি। এবারের জার্নিটা টেকনিক্যালি বেড়ানো না, এবং অল্প সময়ের জন্যও না, তারপরও একটার বেশি স্যুটকেস নিতে ইচ্ছা করছে না। ঢাকা কলেজের উল্টো দিকের মার্কেটে কিছু দোকান আছে যারা সারাবছর শীতের কাপড় বিক্রি করে। তাদের দারস্থ হলাম। এক দোকান থেকে একটা জ্যাকেট কেনা গেল। গরম হবে কি না তা নিয়ে হালকা সন্দেহ প্রকাশ করায় মনে হল দোকানির সম্মানে আঘাত দিয়ে ফেলেছি। সে গম্ভীর হয়ে বলল, স্যার, যেই জিনিস দিলাম, এইটা গায়ে দিয়া আপনি সাইবেরিয়াতে যান। যদি ঠান্ডা লাগে আমারে আইসা বলবেন। যেভাবে বলল তাতে সাইবেরিয়া যাওয়াটা আমার অবশ্য কর্তব্যের তালিকায় ঢুকে গেল। সাবেরিয়া-প্রুফ জ্যাকেট কিনলাম। সাথে হ্যান্ড গ্লাভস, কয়েকজোড়া মোজা এসবও কিনলাম। হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তা-ই কিনে নিচ্ছি। কাজ হবে কি হবে না, তা তো আর এখানে বসে বুঝতে পারব না। পরীক্ষা একেবারে জায়গামত গিয়েই হবে। একজোড়া ভাল জুতা কেনার দরকার ছিল। যা বুঝছি তাতে কেডস্ পরে মনে হয় না ঠান্ডা সামলাতে পারব। আমার কলিগরা অবশ্য জুতা কিনতে নিষেধ করেছে। বলেছে যাবার পর সেখান থেকেই কিনতে। এমন না যে আমি নিজের জন্য কেনাকাটা করি না। কিন্তু তাই বলে ডলার খরচ করে কিনব, তাও আবার জুতা! বসুন্ধরা সিটিতে সবাই যায় এমন এক জুতার দোকানে গেলাম। মোটামুটি ভাল দেখে বুট কিনলাম একজোড়া। গোড়ালি পর্যন্ত কাভার করবে। তাতেই কাজ চলে যাবে বলে আমার ধারণা। পায়ে দিয়ে হাঁটার পর নিজেকে কাউবয় কাউবয় লাগা শুরু হল। মনে হল মাথায় একটা হ্যাট আর গলায় স্কার্ফ পরে হাঁটলে খারাপ হত না।
তবে আমার যা হাইট, এরকম জটায়ু হাইটের কোন কাউবয় পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমার মনে হয় না। পরে অবশ্য বুঝেছি কেন আমার কলিগরা ঢাকা থেকে জুতা কিনতে নিষেধ করেছিল। সেই গল্প যথা সময়ে করা যাবে।
ট্রাভেল করা উপলক্ষ্যে আমার যা ব্যস্ততা, তার চাইতে বেশি ব্যস্ততা হচ্ছে বহ্নির। সে আমাকে নিয়ে শপিংয়ে যায়। কেনাকাটা যা করার সে-ই করে। আমার কাজ হচ্ছে তার পেছন পেছন ঘোরা। ফিরে আসার পর তার অন্য কোন একটা জিনিসের কথা মনে পড়ে। আমরা আবার শপিংয়ে যাই। এভাবেই চলছে। মুস্তাফা মার্ট থেকে সে অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস কিনেছে আমার জন্য। তার মধ্যে আছে টিএসএ (Transportation Security Administration) অ্যাপ্রুভড্ তালা। এই কম্বিনেশন লকগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কোন কারণে যদি আমার অনুপস্থিতিতে আমার লাগেজ এয়ারপোর্ট অথরিটির খোলা লাগে, তাদের কাছে থাকা স্পেশাল চাবি দিয়ে এই তালা তারা খুলতে পারবে। এর জন্য আমার লকের কম্বিনেশন তাদের জানার প্রয়োজন নেই, কিংবা আমার তালা তাদের ভাঙ্গতেও হবে না। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত এয়ারপোর্ট অথরিটির কাছেই টিএসএ অ্যাপ্রুভড্ তালা খোলার ব্যবস্থা থাকে। এই তালাটা সত্যিই কাজে এসেছিল। ইউএসএ থেকে ফেরার পর বাসায় এসে লাগেজ খুলে দেখি ভেতরে একটা চিঠি। পড়ে বুঝলাম টিএসএ আমার লাগেজ খুলেছে এবং সেটা কনফার্ম করার জন্য চিঠিটা ভেতরে দিয়ে দিয়েছে।
আমার জার্নি উপলক্ষ্যে সবচাইতে অদ্ভুত যেই বস্তুটা বহ্নি কিনেছে সেটা হচ্ছে ডিসপোসেবল টয়লেট সিটের একটা প্যাকেট। আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, এটা দিয়ে আমি কী করব? ও বলে, যদি এয়ারপোর্টের বাথরুম ইউজ কর, তাহলে কমোডের উপর একটা বিছিয়ে তারপর বসবে। পাবলিক টয়লেটে কত রকমের মানুষ যায়, কত রকমের জার্ম, একবার ভাব তো? আমি কথা বন্ধ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। পরে অবশ্য আমেরিকার প্রায় সব পাবলিক টয়লেটগুলোতে এই জিনিস দেখেছি। আমাদের অফিসের টয়লেটেও থাকত। শেষ হয়ে গেলে টয়লেট টিস্যুর মত এগুলোও রেগুলার রিফিল করা হত। কোরোনার কারণে আজকাল অনেকের পকেটেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকে। যে সময়ের গল্প তখন এই জিনিস মনে হয় না ঢাকায় অত পপুলার ছিল। বহ্নি আমার জন্য লাইফবয় কোম্পানির হ্যান্ড স্যানিটাইজার জোগাড় করে আনল। বলল, যখনই সুযোগ পাবে, এটা দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নেবে।
দেখতে দেখতে যাত্রার সময় ঘনিয়ে এল। বহ্নি যদিও অনেক করে বলেছিল দু’টো স্যুটকেস নিতে, কিন্তু আমি কোনভাবেই রাজি হলাম না। আমাদের একটা ঐতিহাসিক পুরনো ব্রাউন কালারের স্যুটকেস আছে। হাজার হাজার মাইল বেড়ানোর সাক্ষী স্যুটকেসটা। সেটা নিব ঠিক করলাম, সাথে থাকবে ল্যাপটপের ব্যাকপ্যাক।
যাবার আগের দিন রাতে আব্বার বাসায় গেলাম সবার থেকে বিদায় নিতে। খুব সকালে ফ্লাইট আমার। তাই যাবার দিন আর আসতে পারব না। আমার আমেরিকা যাবার ব্যাপারটায় দেখলাম আমি ছাড়া বাসার সবাই খুব খুশি। আব্বাও খুশি। যেকোন মধ্যবিত্ত বাবার মত আমার বাবার চিন্তাভাবনাও খুব সহজ সাধারণ। তার একমাত্র ছেলে অফিস থেকে কাজের জন্য বিদেশে যাচ্ছে। অফিসই পাঠাচ্ছে সব খরচ দিয়ে। এটা তার জন্য একটা খুব গর্বের ব্যাপার। বাসার অন্য সবার অবস্থা আব্বার মতই। তারা কেউ যাচ্ছে না। আমি যাচ্ছি। তা-ও মনে হচ্ছে বিষয়টা তাদের জন্য আনন্দের। তাদের আনন্দে আমি অবশ্য অংশ নিতে পারছি না। আমার চোখ জ্বালা করছে। খালা বলল সাবধানে যেতে। মেজকাকা বলল সিম কার্ড নিলে নাম্বার জানিয়ে দিতে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাসায় ব্যাক করতে করতে মনে হল আমি অত্যন্ত বোকার মত একটা কাজ করেছি। ইউএসএ যেতে রাজি হওয়াটা আমার উচিত হয়নি। একা থাকা আমার জন্য না।
আরও পড়ুন
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ১
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৩
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৪
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৫
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৬
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৭
বাসায় ফিরে বহ্নিকে বললাম, একটা কথা বলি? বহ্নি তাকাল আমার দিকে। বললাম, ধর যদি আমি না যাই, তাহলে কি তুমি রাগ করবে? বহ্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, না, তুমি না গেলে আমি অবশ্যই রাগ করব না। আমি বুঝতে পারছি আব্বার বাসা থেকে এসে তোমার মন খারাপ হয়েছে। তোমার একেবারেই যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু একবার ভেবে দেখ, তোমাকে তোমার অফিস একটা কাজে পাঠাচ্ছে। ধরে নাও এটা হচ্ছে একটা মিশন, আর তুমি হচ্ছ ফুট-সোলজার। কোন ভাল সোলজার কি মিশনের ভয়ে পালিয়ে যায়? ভেবে দেখ তো? হ্যাঁ, তুমি যদি না যাও, আমি জানি তুমি টিকেটের টাকা থেকে শুরু করে সবটাই অফিসকে ফেরত দিয়ে দেবে। কিন্তু তোমার অফিসের দিকটাও একটু ভাব। ওরা যদি তোমাকে যোগ্য মনে না করত তাহলে কি পাঠাত? তাছাড়া তোমাদের ক্লায়েন্ট চাইছে তুমি সেখানে যাও। তোমাদের নতুন প্রোজেক্টের কিক-অফ না কি জানি বল তোমরা, সেটা ওখান থেকে কর। এগুলো তো তোমার জন্য নতুন এক্সপেরিয়েন্স। ঢাকায় বসে এই এক্সপেরিয়েন্স কি তুমি পাবে? আমি চুপ করে থাকলাম। দরকারের সময় বহ্নি গুছিয়ে কথা বলতে পারে। এই ব্যাপারটাকে সে সিরিয়াসলি নিচ্ছে, তাই যথেষ্ট গুছিয়ে কথা বলছে। আমার ব্রেইনের সুইচ অফ হয়ে যাওয়া লজিক্যাল সার্কিট তখন কাজ করা শুরু করল। আমি কম্পিউটার প্রোগ্রামার। একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামারের লজিক্যাল সার্কিট সবসময় অন থাকা উচিত। সব প্ল্যান করা হয়ে গেছে। এখন আচমকা ইমোশোনাল হয়ে এভাবে প্ল্যানে বাগড়া দেয়ার কোন মানে নেই।
ভোর সাড়ে ছয়টায় আমার ফ্লাইট। অন্তত তিন ঘন্টা আগে রিপোর্টিং এর কথা বলা হয়েছে। তিনটার দিকে আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবার জন্য নয়ন গাড়ি নিয়ে আসল। নয়ন আমাদের অনেক দিনের পরিচিত। নিজের গাড়ি দিয়ে ট্যাক্সি সার্ভিস দেয়। দূরে কোথাও যাবার দরকার হলে আমরা তাকে নিয়ে যাই। লাগেজ নিয়ে নিচে নামলাম। বহ্নিও এসেছে আমাকে বিদায় দিতে। পেছনের ট্রাঙ্কে আমার স্যুটকেস ঢোকানো হল। পাড়ার গলিতে দু’টো কুকুর সারারাত ঘুরে বেড়ায়। পাহারা দেয়। আমরা মাঝে মাঝে বারান্দা থেকে এদেরকে পাউরুটি দিই খেতে। দেখলাম তারা লেজ নাড়াতে নাড়াতে এগিয়ে এসেছে এখানে কি হচ্ছে বোঝার জন্য। ব্যাকপ্যাকটা সামনের সিটে রেখে আমি পেছনে উঠে বসলাম। ডান দিকে তাকিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলাম গেটের কাছে বহ্নি দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটু হাসলাম। বহ্নিও হাসল। নয়ন গাড়ি ছেড়ে দিল।
রাতের ঢাকা দেখার সুযোগ এর আগে খুব একটা হয়নি। অতি পরিচিত রাস্তাও দেখলাম অপরিচিত ঠেকছে। সব দোকানপাট বন্ধ। সবাই গভীর ঘুমে, আর আমি যাচ্ছি দূর দেশে। ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরের মোড় পার হয়ে মীনা বাজারের দিকে যেতে গিয়ে দেখলাম তিনটা ছেলে গল্প করতে করতে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হর্ন দেয়াতে সরল। এত রাতে তারা কোথা থেকে ফিরছে, নাকি কোথাও যাচ্ছে কে জানে। সুনীলের আত্মপ্রকাশ উপন্যাসে এইভাবে বন্ধুরা মিলে রাতে ঘুরে বেড়ানোর বর্ণনা আছে। মানিক মিয়া এভিনিউয়ে উঠে একটু অবাক হলাম। রাস্তাটাকে মনে হল একটা চওড়া নদীর মত। এই রাস্তাটা যে এত বড় আগে সেভাবে উপলব্ধি করিনি। আসলে উপলব্ধি করব কি, দিনের বেলা গাড়ি ঘোড়ার ভিড়ে রাস্তাই চোখে পড়ে না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এয়ারপোর্ট পৌঁছালাম মাত্র পঁচিশ মিনিটে। অন্য কোন সময় হলে দুই ঘন্টার কমে পৌঁছাতাম কি না সন্দেহ আছে। ঢাকা শহরটা যে আসলে কতটা ছোট সেটা জ্যামের কারণে আমরা বুঝতেই পারি না। সিকিউরিটি চেকিং শেষ করে দেখলাম টার্কিশ এয়ারলাইন্সের কাউন্টার তখনো ওপেন হয় নি, তাই লাগেজ নিয়ে বসলাম। বহ্নিকে ফোনে জানালাম যে সব ঠিক আছে। কিছুক্ষণ পর টার্কিশের কাউন্টার ওপেন হল। লাগেজ চেক-ইন করে বোর্ডিং পাস নিলাম। আমাকে দু’টো বোর্ডিং পাস দেয়া হয়েছে। একটা ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল, আরেকটা ইস্তাম্বুল থেকে বোস্টন যাবার জন্য। এখানে বলে রাখা ভাল, আমি যদিও বোস্টন বলছি, আমেরিকানরা এর উচ্চারন করে ব-অস্টন। ব এর পরে একটু টেনে এবং শুরুতে ও-কার না দিয়ে। শুধু উচ্চারণই না, ছোটবেলা থেকে শিখে আসা আমাদের জানা অনেক ইংরেজি শব্দও ইউএসএ-তে অন্যভাবে বলা হয়। ডাস্টবিন হচ্ছে ট্র্যাশ, ফুটপাথ হচ্ছে সাইডওয়াক, জেব্রা ক্রসিং হচ্ছে ক্রসওয়াক, সোফা হচ্ছে কাউচ, গাড়ির জন্য পেট্রল কিংবা যেকোন লিকুইড জ্বালানি হচ্ছে গ্যাস। এরকম আরো অসংখ্য। যাই হোক, ইমিগ্রেশনে এবার একেবারেই ঝামেলা হল না। শুধু জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছি। ইমিগ্রেশন শেষ করে উঠে গেলাম অ্যামেক্স লাউঞ্জে। এই লাউঞ্জটা আমাদের বেশ পছন্দের। অপেক্ষা করার জন্য বেশ আরামদায়ক ব্যবস্থা আছে এখানে। আর যা-ই হোক মশার কামড় খেতে হয় না। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় দেখলাম সিঁড়িতে একটা বিড়াল গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। সে কোন প্লেনের প্যাসেঞ্জার সেটা অবশ্য বোঝা গেল না।
লাউঞ্জে বসে ব্যাকপ্যাকটা রেখে একটু দম নিলাম। এখন অপেক্ষা কখন বোর্ডিংয়ের ডাক দেয়। ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল যেতে সময় লাগবে সাড়ে আট ঘন্টা। সেখানে দুই ঘন্টার যাত্রা বিরতি। তারপর সেখান থেকে বোস্টন যেতে লাগবে সাড়ে দশ ঘন্টা। তার মানে আমাকে মোট একুশ ঘন্টা জার্নি করতে হবে আর তার মধ্যে উনিশ ঘন্টাই আমি থাকব আকাশে। আর এই আকাশপথে আমাকে পাড়ি দিতে হবে প্রায় তের হাজার সাতশো কিলোমিটার। ভাবা যায়! সবচাইতে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে আজকে ফেব্রুয়ারির এক তারিখ সকাল, এই একুশ ঘন্টা জার্নি করে আমি ইউএসএ-তে পৌঁছাব বোস্টন লোকাল টাইম বিকাল পাঁচটায়। সেখানে তখনও ফেব্রুয়ারির এক তারিখই থাকবে। কী অদ্ভুত তাই না? টাইমজোনের ক্যালকুলেশন বুঝতে পারার পরেও এই ব্যাপারটা আমার কাছে চিরকালের বিস্ময় হয়েই আছে।
শেষ পর্যন্ত বোর্ডিং শুরু হল। এয়ারবাস এ-৩৩০ (A330-300) তে এই প্রথম চড়লাম। বিশাল প্লেন। সম্ভবত আড়াইশোর মত যাত্রী ধরে। যাত্রীও আছে আড়াইশো। প্লেন কানায় কানায় পূর্ণ। যাত্রীরা প্রায় সবাই বাংলাদেশি। তাদের কথায় বুঝলাম অধিকাংশের গন্তব্যই আসলে ইস্তাম্বুলে না। এরা ঢাকা থেকে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে যাচ্ছে। ইস্তাম্বুলটা হচ্ছে ইউরোপ যাবার জন্য একটা হাব মাত্র। আমি আশেপাশে ঘুরে তাকাচ্ছিলাম। একদিকে দু’টো সিট, তারপর মাঝখানে চারটা, তারপর অন্যদিকে আরো দুটো, এভাবে মোট আটটা করে সিট একেক রো-তে। এর আগে আমার এক্সপেরিয়েন্স আছে বোয়িং ৭৩৭ চড়ার। সেই প্লেন এটার তুলনায় শিশু সাইজ। আমি সিট পেয়েছি প্লেনের ডানদিকের আইলে। পেয়েছি বলতে আসলে গতকাল রাতেই অনলাইনে সিট সিলেকশন করে রেখেছিলাম। তা না হলে বোর্ডিংয়ের সময় কোথায় সিট দেবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আইলের পাশে সিট ইচ্ছা করেই নেয়া। প্লেনে আমার ঘনঘন বাথরুম যাবার একটা বাতিক আছে। জানালার পাশে বসলে বের হতে গেলে পাশের প্যাসেঞ্জারকে বারবার বিরক্ত করতে হয়। আমার পাশে উইন্ডো সাইডে একটা টিন-এজড্ মেয়ে বসেছে। কালো কোঁকড়া চুল, গায়ের রং শ্যামলা, চোখে চশমা। যদিও চেহারা দেখে কোন্ দেশের সেটা বোঝার উপায় নেই। মুখ নাড়ানো দেখে বুঝলাম চিউইং গাম চিবুচ্ছে। কানে হেড ফোন, পরনে টি-শার্ট আর জিন্স, পায়ে স্নিকার্স। টিন-এজড্ ছেলেমেয়েদের আন্তর্জাতিক ড্রেসকোড বলা যায় যেটাকে। তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। সে এককানের হেডফোন খুলে আমার দিকে তাকাল। বললাম, ইফ আই ফল এস্লিপ, ফিল ফ্রি টু নক মি ইফ ইউ ওয়ান্ট টু গেট আউট ফর এনিথিং। সে একটা বাবল ফুলিয়ে ঠাশ করে ফাটাল। তারপর মাথা নাড়িয়ে আবার কানে হেডফোন গুঁজে দিল। আইলের সিটে কেউ ঘুমিয়ে পড়লে বের হবার জন্য তাকে নক করতে আমার নিজেরই ডিসকমফোর্ট লাগে। মেয়েটার যেন অস্বস্তি না হয়, তাই আগেই তাকে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে দিলাম। তবে যেভাবে কনফিডেন্টলি বাবলটা সে ফাটালো, তাতে মনে হয় না আমাকে ডিঙিয়ে যেতে তার কোনরকম অসুবিধা হবে। প্লেন ছাড়ার আগে বহ্নিকে ফোন দিলাম। সে বলল পৌঁছে জানাতে এবং কোন কারণে যদি পৌঁছানোর খবরটা জানাতে দেরি হয়, আমি যেন অস্থির না হয়ে যাই। ও জানে যে আমার পৌঁছানোর খবর না পেলে সে নিজে যতটা না অস্থির হবে, খবরটা দিতে দেরি হলে তার চাইতে বেশি অস্থির হব আমি। ফোন রাখার এক মিনিটের মধ্যে আমাদের এয়ারবাস প্রচণ্ড শব্দ করে দৌড় শুরু করল। যেই জিনিস আকাশে যত ভাল ওড়ে সেটা মাটিতে তত শব্দ করে দৌড়ায়। এই দৌড়ের সময়টায় আমি সবসময় নার্ভাস ফিল করি। মনে হয় নাটবল্টু খুলে গিয়ে প্লেন পার্ট বাই পার্ট খুলে যাবে। সিটবেল্ট পরে সিটশুদ্ধ ছেঁচড়ে আমি ধানক্ষেতে গিয়ে পড়ব। সামান্য কিছু পরে অনুভব করলাম মাধ্যাকর্ষণের মায়া কাটিয়ে আমরা উঠে গেছি আকাশে। দেখলাম মেয়েটা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। ওর কোঁকড়া চুলের ফাঁক দিয়ে আমিও তাকালাম। সদ্য ঘুম ভাঙা একটা যাদুর শহর আস্তে আস্তে পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা।
(চলবে)
সারাবাংলা/এসএসএস