পুলিশের সামনেই এক জেলার যাত্রীবাহী গাড়ি যাচ্ছে অন্য জেলায়
৭ মে ২০২১ ২১:৩৫
ঢাকা: চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা আবু জাফর পেশায় একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসার প্রয়োজনেই তার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসা হয়ে থাকে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেওয়া সরকারি বিধিনিষেধে উল্লেখ করা ক্যাটাগরিতে না পড়লেও তার রাজধানীতে আসতে কোনো সমস্যা হয় না। মুভমেন্ট পাস না থাকলেও ১৪ এপ্রিলের পর থেকে তিনি তিন বার ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করেছেন।
জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, সবই তো খোলা। চলছে গাড়ি যাত্রাবাড়ী, রাস্তায় বিধিনিষেধ নিয়েও নেই বাড়াবাড়ি। শুধু বাসই তো নাই দিনের বেলা আর বাকি সবই তো আছে। বাসের ভাড়া এক হাজার থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা হয়। আর এখন মাইক্রোতে এক হাজার ২০০ আর প্রাইভেট কারে এক হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে আরামসে যাওয়া আসা করা যায়।
ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘পুলিশের সামনেই যাত্রী ওঠানো হয় আর তারাই কিছু বলে না। আর সব মিডিয়াতে খালি বলে করোনার জন্য গাড়ি নাকি বন্ধ। শুধু রাস্তায় যদি হঠাৎ করে কেউ গাড়ি আটকায় তবে ড্রাইভার যা শিখিয়ে দেবে সেটি বলতে হয়। কিছু সময় ড্রাইভারই মুভমেন্ট পাস দিয়ে দেয়।’
দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী চলছে বিধিনিষেধ। ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই বিধিনিষেধ ১৬ মে পর্যন্ত বর্ধিত করেছে সরকার। শর্তসাপেক্ষে ৬ মে থেকে শুধু জেলা শহরে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সংক্রমণ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় না ছড়ানোর জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে দূরপাল্লার পরিবহন।
আরও পড়ুন: ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানলে অবস্থা ভারতের চেয়েও খারাপ হবে’
সরকারিভাবে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী বিধি নিষেধকালীন সময়েও পুরো দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত করা যাচ্ছে নির্বিঘ্নেই। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়লেও কার্যত সবার চোখের সামনেই মহাসড়কে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, পিকআপ ভ্যানে গাদাগাদি করে মানুষ রাজধানী থেকে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্থান থেকে আসছে রাজধানীতেও। এছাড়াও মহাসড়কে চলছে পিকআপ, বাইক এমনকি সিএনজিওচালিত অটোরিকশাও। বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুলিশের চোখের সামনেই চলছে এভাবে যাতায়াত। কিন্তু তারা বলছে, এমন কিছুই হচ্ছে না। তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। যার তথ্যপ্রমাণ সারাবাংলার কাছে সংরক্ষিত আছে।
বিশেষজ্ঞরা এভাবে যাতায়াতের বিষয়টিকে বলছেন সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস চালকরা দাবি করছে, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এমন কিছুই ঘটছে না, আর যদি হয়েও থাকে তবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিবহন নেতারা বলছে, এভাবে ছোট গাড়ি দিয়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করার চাইতে ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালু করাই ভালো। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছেন এভাবে বিধিনিষেধ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, এভাবে কিছু হলে সেটা দুঃখজনক। অবশ্যই এটি নিয়ে তৎপর হওয়া প্রয়োজন প্রশাসনের। সংক্রমণ সারা দেশে ছড়ালে সামনে বিপদ আসতে পারে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মূলত রাজধানীর কয়েকটি স্থান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার জন্য প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস ছেড়ে যায়। ৩,৪ ও ৫ মে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় এই সব স্থানে বিভিন্ন রেন্ট এ কারের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে যাত্রী ওঠানো হয়ে থাকে। রাজধানী সুপার মার্কেট, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, জনপদের মোড় থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ী, সাইন বোর্ড, চিটাগাং রোড ও কাঁচপুর ব্রিজসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে গাড়িগুলো ছাড়া হয়ে থাকে। একইভাবে গাবতলী, আবদুল্লাহপুর, বিমানবন্দর এলাকা থেকেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কোনো গাড়ি বদল না করেই সরাসরি গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাচ্ছে। আর এ সব এলাকাতে এ সব গাড়িতে যাত্রী তুলে দেওয়ার জন্য গড়ে উঠেছে পৃথক পৃথক দালাল চক্র।
আরও পড়ুন: ফেসবুকে টিকেটের বিজ্ঞাপন দিয়ে রাতের অন্ধকারে চলছে দূরপাল্লার বাস
সরেজমিনে যাত্রাবাড়ী মোড়ে থাকা ট্রাফিক পুলিশ অফিসের ঠিক উল্টো দিকেই দেখা যায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন রকমের প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও মোটরবাইক। মোটরবাইকে নিজেরাই ডেকে যাত্রী উঠালেও অন্যান্য গাড়িতে কমিশন পাওয়ার বিনিময়ে যাত্রী উঠিয়ে থাকে দালাল চক্রের সদস্যরা। মিডিয়ার লোগো লাগানো গাড়ি দেখলেই সরে যাওয়া এ সব দালালরাই মূলত এ সিন্ডিকেট চালিয়ে থাকে। তবে প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস চালকরা অভিযোগ জানিয়ে বলে এই সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে মূলত ট্রাফিক পুলিশ ও পুলিশের সহযোগিতাতেই। আর তাই তারা সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও কিছু বলে না।
৫ মে সরেজমিনে গিয়ে প্রতিবেদক দরদাম করে ৪০০ টাকা দিয়ে একটি মাইক্রোবাসের সামনের আসনে বসে যাত্রী সেজে। মাইক্রোবাস চালক কুমিল্লা ও ফেনীর উদ্দেশ্যে যাত্রীদের আহ্বান করছিলেন যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আরও দুই জন। এ সময় গাড়ির সামনেই ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন এক ব্যক্তি যার নেমপ্লেটে নাম হিসেবে লেখা ছিল মাহবুব। ৯ সিটের গাড়ি পরিপূর্ণ হয়ে গেলে দালালদের টাকা দেন তিনি যা গাড়ির পেছনে গিয়ে ভাগ করে নেওয়া হয় ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা পুলিশের সঙ্গে। বিষয়টি ভিডিও ধারণ করতে গেলে বাধা দেওয়া হয় প্রতিবেদককে। আর এ সময় তারা সেখান থেকে সরে পড়েন।
চলতি পথে মাইক্রোবাস চালক দেলোয়ার প্রতিবেদককে জানান, এভাবে প্রতিদিন দুই থেকে তিন বার আপডাউন করি কুমিল্লা থেকে ঢাকা। দালালদের টাকা না দিলে এখান থেকে যাত্রী উঠানো যাবে না। আবার প্রশাসনকে টাকা না দিলে তারাও এখানে থাকতে পারবে না। সবই এখানে সিস্টেমে হয়। শুধু মিডিয়া আর ম্যাজিস্ট্রেট টিম আসলে একটু নিরাপদে থাকতে হয়। নইলে সবই এখানে প্রকাশ্যেই হয়। আর কেউ দেখলেও বা কী যায় আসে। সবই ম্যানেজ করা যায়। ভৈরব রোডে গেলে দেখবেন আরও ভয়াবহ অবস্থা।
তবে ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলে গাড়ি থেকে নেমে আবার যাত্রাবাড়ী মোড়েই এসে দেখা যায় একই অবস্থা। বিভিন্ন গাড়ি আসছে আর সেখানে যাত্রী তুলে দেওয়া হচ্ছে। একটু পেছনের দিকে গিয়ে জনপদ মোড় ও সায়েদাবাদেও একই দৃশ্য।
আরও পড়ুন: পাটুরিয়ায় ঘরমুখো মানুষের চাপ, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না কেউই
সায়েদাবাদে একটি প্রাইভেটকারে যাত্রী সেজে উঠেন এই প্রতিবেদক। ৮০০ টাকা দিয়ে ফেনী যাওয়ার ভাড়া ঠিক করা হয়। ঠিক তার সামনেই সায়েদাবাদ রেল লাইন সংলগ্ন ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও সেখানে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তারা। সামনে একজন ও পেছনের ৪ জন যাত্রী নিয়ে প্রাইভেটকারের যাত্রী পরিপূর্ণ হলে সেটি গন্তব্যস্থলে উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।
জানতে চাইলে প্রাইভেটকার চালক রাজীব চন্দ্র বলেন, এখানে হিসেব খুব সোজা। যদি আপনার একটা গাড়ি থাকে তবে এখানে এসে যোগাযোগ করবেন। তারা আপনাকে যাত্রী ঠিক করে দেবে। কুমিল্লা গেলে গাড়ি ঠিক করে দিবে ৪ সিটের জন্য দুই হাজার টাকা দিয়ে। আর ফেনী গেলে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ২০০ টাকা দিয়ে যাত্রী ঠিক করে দেবে। পরে গাড়ি ছাড়ার সময় ৫০০ টাকা তাদের দিয়ে দিবেন। সোজা সিস্টেম কারণ যাত্রী ডাকাডাকি থেকে শুরু করে সবই তারা করে। পুলিশও আটকায় না, সবই স্ট্যান্ডের তারাই ম্যানেজ করে। কোনো মুভমেন্ট পাসও লাগে না আবার কোনো গার্মেন্টসের গাড়ি বইলা সিলও দিতে হয় না।
মহাসড়কে গিয়ে দেখা যায় সেখানে চলন্ত পিকআপ ভ্যানের পেছনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসে আছে যাত্রীরা। একই সঙ্গে দেখা যায় মহাসড়কে চলছে সিএনজি এবং মোটরবাইকও।
৬ মে সাইনবোর্ড এলাকা, শনির আখড়া, চিটাগাং রোড, কাঁচপুর ব্রিজ এলাকায়ও দেখা যায় একই অবস্থা।
আরও পড়ুন: গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি: একে অন্যকে দুষছে যাত্রী-শ্রমিক
৭ মে রাজধানীর গাবতলী ও আবদুল্লাহপুর এলাকায় গিয়েও দেখা যায় সেখান থেকেও দেশের বিভিন্ন স্থানে যাত্রী নিয়ে মহাসড়কে চলছে গাড়ি।
যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন প্রয়োজনে আসলে যেতেই হচ্ছে। আর যেহেতু কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই তাই এভাবে ঝুঁকি নিয়েই যেতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে আসলে কিছু বলার নেই।
এভাবে গাদাগাদি করে বসে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেলে কোভিড-১৯ সংক্রমণ তো ছড়াতে পারে। সেটা নিয়ে কী ভাবছে জানতে চাইলে গাড়ি চালক ও যাত্রীরা জানায়, শপিং মলে যদি মানুষ যেতে পারে তবে গাড়িতে আর কী সমস্যা?
উভয়পক্ষই অভিযোগ জানিয়ে বলে, করোনা হলো বড়লোকের রোগ যারা নিজেদের গাড়ি নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। তাদের টাকা আছে দেখে তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গাড়ি নিয়ে যেতে পারবে আর আমরা মধ্যবিত্ত বা গরিব বলে যেতে পারব না তা তো হয় না। আর করোনা আমাদের হবে না, এটা বড়লোকদের রোগ।
কী বলছে প্রশাসন?
যাত্রাবাড়ী ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে থাকা কনস্টেবলের উপস্থিতিতেই প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে অবাধে। এটা কী সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী হওয়া সম্ভব?
এমন প্রশ্নের উত্তরে ওয়ারীর উপকমিশনার (ডিসি) সাইদুর রহমান রাজু সারাবাংলাকে বলেন, এভাবে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংক্রমণ যেন না ছড়াতে পারে সেজন্যেই তো এই বিধিনিষেধ দিয়েছে সরকার। এখন যদি এভাবে মানুষ যায় তবে সেই উদ্যোগে কার্যকর হবে না। এমনটা হওয়ার কথা না। যেহেতু আপনি আমার নলেজে দিলেন তাই অবশ্যই এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। যেন এ ধরনের ঘটনার কোনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
আরও পড়ুন: জেলাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চালানো যাবে, প্রজ্ঞাপন জারি
তবে যাত্রী সেজে প্রতিবেদক নিজেই ছিলেন এমন বলার পরে তিনি বলেন, যদি আমাদের কোনো কর্মকর্তা এভাবে সহায়তা করে থাকে তবে সেটার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না।
তিনি আরও বলেন, যে কোনো আইন করা হয় রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সকল নাগরিককেই সচেতন হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু আমাদের এখানে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে ব্যতিক্রম ঘটে অনেক ক্ষেত্রে। দেখা যায় কয়েকজন আইন মানছে ও অন্যরা সেটা ভাঙছে। সেক্ষেত্রে আমরা যদি কঠোর হই তবে তা কিন্তু গণমাধ্যমে নেগেটিভভাবে উঠে আসে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় আমরা কড়াকড়ি করতে গেলে সেটাকে আবার অনেকে বাড়াবাড়ি বলে থাকেন। আবার যদি শিথিলতা দেখানো হয় তবে বলা হয় ঢিলেঢালা লকডাউন পালন করা হচ্ছে পুলিশের সহায়তায়।
মহাসড়কে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসের পাশাপাশি তিনজন যাত্রী নিয়ে মোটরবাইক ও সিএনজিও চলছে। এতে ঝুঁকির পরিমাণ কেমন? প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে?
জানতে চাইলে হাইওয়ে এসপি (কুমিল্লা) সারাবাংলাকে বলেন, ‘এমনটা সম্ভব না। প্রতিদিনই আমাদের টিম নানা জায়গায় কাজ করে যাচ্ছে।’
প্রতিবেদকের কাছে তথ্য প্রমাণ আছে বলার পরে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন টিম টহলে থাকছে প্রতিদিনই। আমাদের প্রচুর চেকপোস্ট আছে। সেখানে আসার আগে দেখা যায় গাড়িগুলো যাত্রী নামিয়ে দিয়ে বলে চেকপোস্টের জায়গাটা হেঁটে পার হতে। আর এরপরে সে খালি গাড়ি নিয়ে যায়। চেক পোস্ট পার করে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে গিয়ে আবার যাত্রীরা গাড়িতে উঠে। তারপরেও আমাদের প্রচেষ্টা থাকে যেন এভাবে যাতায়াত করতে না পারে। কিন্তু যদি মানুষই অসচেতন হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সাহায্য না করে তবে আসলে কী করা যায় বলেন?’
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন কিন্তু আমরা সিএনজি গাড়ি ধরছি। কিন্তু তাদের মামলা দিতে গেলে দেখা যায় তারা বলে, এই টাকা কিভাবে দিবে। এখন বিধিনিষেধ বা লকডাউন যাই বলি না কেন এতে তো আসলে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। গত ৫ এপ্রিল থেকে আমাদের লোকজন ঘুম নেই, খাওয়া দাওয়া নেই তাও কাজ করে যাচ্ছে। আমরাও চাচ্ছি এগুলো আটকাতে। এ জন্য মামলা করতে গিয়েও পারি না। কারণ কাউকে যদি পাঁচ হাজার টাকার মামলা দেওয়া হয় তবে সে আসলে কিভাবে দিবে? ওর তো গাড়ি চালিয়েই ইনকাম করতে হয় যেটা সে পারছে না। এসব মানবিক দিকও তো বিবেচনা করতে হয় আমাদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে পাবলিকরা গাড়িতে উঠছে তারা কিভাবে আসলে গাড়িতে উঠছে সেটা একটা প্রশ্ন। আমরা যখনই গাড়ি আটকায় তখন সবাই এক সঙ্গে বলে কারো অমুক মারা গেছে বা তমুক হাসপাতালে ভর্তি। এখন এ সব পরিস্থিতিতে আসলে কী করা যায়? আন্তঃজেলা বাস চলাচল বন্ধ করা হয়েছে জনগণকে নিরাপদে রাখার জন্যেই। এখন তারাই যদি না বুঝে তাহলে আমরা কঠোর হয়ে গেলে তো গণমাধ্যমেই আমাদের দোষারোপ করা হবে প্রশাসনে। তাও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে মানুষ এভাবে না যেতে পারে।’
আরও পড়ুন: স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে মার্কেট বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত
জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাকে কেন প্রশ্ন করছেন? এর জন্য হাইওয়ে পুলিশের অ্যাডিশনাল আইজিপিকে ফোন দেন।’
তবে হাইওয়ে পুলিশের অ্যাডিশনাল আইজিপিকে ফোন দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে খুদে বার্তায় প্রশ্ন আকারে জিজ্ঞেস করা হয়— ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়েতে প্রচুর সংখ্যক কার, মাইক্রো ও সিএনএজি চালিত অটোরিকশা চলছে যাত্রী পরিবহন করার জন্য। এ বিষয়ে আপনাদের ভূমিকা ও পদক্ষেপ জানাবেন কী?
তবে তিনি খুদে বার্তার কোনো উত্তর দেননি।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার ইফতেখারুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এভাবে গাড়ি চলার কোনো অনুমতি নেই। আমাদের জানা মতে সেটি করা হচ্ছে না। কিন্তু তাও আমি সংশ্লিষ্ট বিভাগে বিষয়টি অবগত করে রাখছি। রাস্তায় যদি এভাবে গাড়ি চলে তবে সংশ্লিষ্টরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন। এ বিষয়টি আমাদের জায়গা থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে।’
কী বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা?
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, এভাবে যদি আন্তঃজেলা যান চলাচল করে তবে সংক্রমণ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছড়ানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে আমাদের বর্তমানে সংক্রমণ শনাক্তের হার যেটা কমছে সেটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় অনেকাংশে। কারণ প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসে তো পাশাপাশি বলে আসলে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব না।
তিনি বলেন, ‘আসলে মানুষকে বোঝাতে হবে আগে। কেনো এভাবে যাতায়াত নিরাপদ না তার পাশাপাশি তাদের বোঝাতে হবে এভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেলে সংক্রমণ কিভাবে বাড়তে পারে। একই সঙ্গে সেই ব্যক্তি নিজের জন্য কিভাবে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এটাও তাকে বোঝাতে হবে। অর্থাৎ এই যে বিধিনিষেধ বা লকডাউন তা যে মানুষকে নিরাপদে রাখার জন্যেই দেওয়া হচ্ছে এটা সবাইকে বোঝাতে হবে। তা না করে যদি শুধু মুখে আইনের কথা বলা হয় সেটা বাস্তবায়ন করা অনেকটা কষ্টকর হয়ে পড়ে?’
তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে যখন প্রাইভেট কার চলছে তখন যাদের নিজস্ব গাড়ি নাই তাদের আর কী দোষ? তাদেরও তো যাতায়াত করতে হয় কোনো না কোনো কাজে। এক্ষেত্রে যদি বাস চালানোর অনুমতি দেওয়া হয় তবে তখন সেখানে কতটুকু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালানো হবে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। সবকিছু মিলিয়ে আসলে বলতে হয় সরকারকেই উদ্যোগ নিয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।’
ডা. মোশতাক বলেন, ‘বর্তমানে যেভাবে চলাচল করছে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, মোটর বাইক, পিকআপ বা সিএনজি দিয়ে তাতে সড়কে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা যেমন বাড়ে ঠিক তেমনি কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনাও বাড়ে। আর এর প্রভাব কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরে পড়তে পারে যদি রোগীর সংখ্যা আবার বাড়া শুরু করে।’
বিধিনিষেধ চলাকালে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাওয়াটা কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যদি এমন হয়ে থাকে তবে এটা দুর্ভাগ্যজনক। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এসে বরং বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। আর তাই আসলে সবার সচেতন হতে হবে।’
কী বলছে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা?
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন,‘ সবই তো চলছে শুরু থেকেই। শুধু বাস চললেই সংক্রমণ বাড়বে এমনটা মনে হচ্ছে এখন। এভাবে প্রাইভেটকার মাইক্রোবাস দিয়ে যাত্রী চলাচলে তো ঝুঁকিও অনেক। অথচ আমরা বলেছি স্বাস্থ্য বিধি মেনে অর্ধেক যাত্রী চলাচলের অনুমতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু তা দেওয়া হয় নাই। আর কিছু বলার নেই।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পাশের দেশ ভারতে। সেখানে এখন যে অবস্থা তা তো সবাই দেখছে। আমাদের এখানে যদি তেমন কোনো অবস্থা হয় তবে কী হবে? স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কী সেই পরিমান প্রেশার নিতে পারবে? এ সব দিক বিবেচনায় নিয়েই কিন্তু বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। এটা আসলে মানা উচিত।’
আরও পড়ুন: মার্কেট-শপিংমলে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে ছাড় নয়: আ.লীগ
তিনি বলেন, ‘বিধিনিষেধ মানা প্রয়োজন কিন্তু এক্ষেত্রে অন্যান্য অনেক দিকও ভাবতে হবে। শ্রমিকদের অবস্থা কিন্তু ভালো না যারা আন্তঃজেলা যান পরিবহনে দৈনিক ভাতার ভিত্তিতে কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের কথা সরকারকে বিবেচনা করতে হবে। একই সঙ্গে সেই সকল যাত্রীদের কথাও বিবেচনা করতে হবে যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। কেউ রাস্তায় নিজের গাড়ি থাকার কারণে যেতে পারবে আর কেউ পারবে না এটা তো ঠিক না। দেখা গেল অনেকেই গ্রামের বাড়িতে যায় জাকাত দেওয়ার জন্য। এখন তার গাড়ি নাই। তাহলে সে কিভাবে যাবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘আসলে সব কিছু ভেবেই সামনের দিনগুলোতে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। সচিবালয়ে বসে মাঠের পরিস্থিতি না বুঝে সিদ্ধান্ত দিলেই হবে না। এক্ষেত্রে প্রয়োজন পরিকল্পনার সঙ্গে কাজ করে যাওয়া যাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মানুষকে না খেয়ে মরার কবল থেকে বাঁচানো যায়।’
প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিয়ে মহাসড়ক ও শহর এলাকায় গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
সারাবাংলা/এসবি/একে