স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বাবা ফিরে আসেনি
৯ মে ২০২১ ১১:০৪
একাত্তর সাল। সারাদেশে চলছে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ। অনেক এলাকাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধে হানাদার বাহিনী পিছু হটেছে। আবার কোন কোন এলাকা দখল করেছে হানাদার বাাহিনী। অন্যদিকে বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রথম স্বাধীন জেলা হিসেবে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা মুক্ত হয় ৩১ মার্চ রাতে। ১ এপ্রিল থেকে মুক্ত ছিল কুষ্টিয়া। ১৬ এপ্রিল বিকেলে পাবনা হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুনরায় প্রবেশ করে কুষ্টিয়ায়। আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর তখনও মুক্ত এলাকা। যে কারণে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। এই সংবাদ হানাদার বাহিনীর কানে পৌঁছানো মাত্রই সারা জেলার নিয়ন্ত্রণ করতে উম্মাদ ও ব্যস্ত হয়ে পরে হানাদার বাহিনী।
কুষ্টিয়া শহরের কয়েকটি এলাকায় বিহারীরা বসবাস করতো। মুক্তিযুদ্ধে এখানকার বিহারীরা পাকিস্তানিদের পক্ষে অবস্থান নেই। এ কারণে প্রথম দিকে প্রতিরোধ যুদ্ধে কুষ্টিয়া জেলা মুক্ত হলে বিহারী চাপে ছিলো। হানাদার বাহিনী পুনরায় কুষ্টিয়া দখল করলে বিহারীরা শুরু করে হত্যা, ডাকাতি, খুন ও নির্যাতন। সারা শহরে তখন থমথমে অবস্থা। শহরের মানুষ পালিয়ে গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছেন। তেমনি একটি রাত ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১।
কুষ্টিয়া শহরের আমলাপাড়ায় বাবর আলী গেট সংলগ্ন মিজানুর কুঠির। বর্তমানে রোজ গার্ডেন, ৭/১ বি সি স্ট্রীট রোডে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে বসবাস করেতন আব্দুল লতিফ। পেশায় শহরের দিনমনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। এক সন্তান খলিলুর রহমান মজু ছিলেন খোকসায়, মেয়ে আলেয়া বেগম ছিলেন কুমারখালী। আরেক মেয়ে ফিরোজা ও ছেলে ওয়ালিউর রহমান বাবু ছিলেন বগুড়ায়। স্ত্রী ও অন্যান্য সন্তানদের নিয়ে তিনি বাসায়ই ছিলেন।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুষ্টিয়া পুনরায় দখল নিতে পাবনা হয়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার দিক হতে জ্বালাও পোড়াও করতে করতে শহরে প্রবেশ করে। শহরে ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই ভয়ে সবাই বাড়ির ভেতরেই ছিলো।
সেদিনের রাতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার সম্পর্কে আব্দুল লতিফের সাথে থাকা সাড়ে নয় বছর বযসী ছেলে ওয়াহিদুর রহমান হিটুর ভাষ্যমতে, ওইদিন বিকেলে আসরের নামাজের পর আমাদের বাড়ির আশপাশে অনেক বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় হানাদার বাহিনী। আমরা তখন বাড়িতে চলে যাই। সন্ধ্যায় বাড়ির জানালা দিয়ে বাবা দেখেন সামনের ব্যান্ডবক্স লন্ড্রিতে আগুন জ্বলছে। শহরে থমথমে অবস্থা।
সন্ধ্যার পর বাবা মায়ের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, এখানে থাকলে ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে আগুনে পুড়ে অথবা পাকিস্তানিদের হাতে মরতে হবে। তার চেয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পারলে অন্তত জানে বাঁচা যাবে। আমাদের বাড়িতে অনেক কবুতর ছিল। প্রথমেই বাবা সেগুলোকে মুক্ত করে দিলেন। তারপর দুটি বাজার করা ব্যাগে কিছু কাপড় চোপড় ও টাকা পয়সা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য তৈরি হলেন। বাড়ির দক্ষিণে বর্তমান সোনালী ব্যাংক। প্রাচীর ডিঙিয়ে আমাদেরকে নিয়ে বাবা হাঁটা ধরলেন পূর্বদিকে রেল লাইন ধরে গন্তব্যহীনভাবে। শহর পার হয়ে দবির মোল্লার রেল লাইনের ওখানে এসে অনেকগুলো লাশ দেখলাম আমরা। পাশেই লাহিনী ইউনিয়ন পরিষদ ও একটা ক্যাম্প ছিলো।
বাবা আমাদেরকে নিয়ে রাস্তার দিকে যেতেই প্রচণ্ড গুলির শব্দ। আমরা এম্বুসের মধ্যে পড়ি। রাতের অন্ধকারে আম্মা দুই ভাইকে নিয়ে একদিকে আশ্রয় নেন। পরে ওইপাশ দিয়েই গড়াই নদী পার হয়েছিলেন আম্মা। বাবা আমাকে নিয়ে রেল লাইনের ধারে আশ্রয় নিলেন। আমার হাতে একটা হ্যারিকেন জ্বলছিল। কাছে থাকা কাপড় দিয়ে চেপে ধরে হ্যারিকেন বন্ধ করে দিলাম নিজেকে বাঁচানোর জন্য। কারণ আলো দেখে দেখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গুলি করছিল। তাদের সাথে দা, তরবারি, বল্লমসহ দেশীয় অস্ত্র হাতে কিছু মানুষও ছিলো। পরে জানতে পারলাম তারা বিহারী। কারণ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এইসব রাস্তাঘাট চেনার কথা নয়। বিহারীরা পথ চিনিয়ে নিয়ে আসছিলো।
একসময় আমি বাবার থেকে আলাদা হয়ে যাই। কিছুসময় পর গোলাগুলি বন্ধ হলে আমি রাতের অন্ধকারে বাবাকে না পেয়ে লাহিনী পাড়ায় পালিয়ে ছিলাম। পরদিন ১৭ তারিখ সকালে 9টার দিকে পরিচিত একজন আমাকে গড়াই নদীর শ্মশান ঘাট পার করে কালোয়া গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের হন। নৌকার ওঠার পরই পাকিস্তানি বাহিনীর গুলি শুরু হয়। সেখানেও অনেকে মারা যায়। আমি দৌড়ে বেঁচে যাই। তারপর সেখান থেকে চড়াইখোল হয়ে কুমারখালী এক আত্মীর বাসায় গিয়ে বাবা মার খোঁজ পেলাম না। সেখান থেকে খোকসা গিয়ে ৪ দিন পর মা ও অন্য্যান্য ভাই বোনদের পেলাম কিন্তু বাবাকে পেলাম না। এখনও সেই রাতের কথা মনে হলে আমার বুকটা হা হা করে ওঠে। মনে হয় গত রাতের স্মৃতি।
চারদিন পর হিটুকে ফিরে পাওয়া গেলেও ফিরে আসেননি আব্দুল লতিফ। কিছুদিন পরে খোকসা থেকে নিজ বাড়ির অবস্থা দেখতে গোপনে শহরে আসেন রহিমা খাতুন। দেখেন বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ, লুটপাট করে বাড়িঘর ছিন্নভিন্ন করে রেখেছে স্বাধীনতা বিরোধীরা। বাড়িতে থাকার মধ্যে ভাঙা আসবাবপত্রের পাশেই ছিলো একখানা সাদাকালো অক্ষত ছবি। ছবিটি ১৯৬৩ সালে ঢাকার নিউমার্কেটের সিকো স্টুডিও থেকে তোলা। স্বামীর স্মৃতি হিসেবে ছবিটি সংগ্রহ করে কাছে রাখেন তিনি। সেই ছবির দিকে তাকিয়েই বাকি জীবন কাটিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ২০০৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। দেশ স্বাধীন হলেও ন্ত্রী, সন্তানেরা পথ চেয়ে থেকেছেন তার জন্য। এভাবেই কেটে গেছে পঞ্চাশ বছর।
একাত্তরে অবরুদ্ধ মানুষের ভাষ্য, স্থানীয় ইতিহাস ও স্বাধীনতা বিরোধীদের চালানো হত্যাযজ্ঞ পর্যালোচনা করে জানা যায়, কুষ্টিয়া শহরের জয়নাবাদ ও দেশওয়ালী পাড়াসহ কয়েকটি এলাকায় বিহারীরা বসবাস করতো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এলাকায় ব্যপকহারে খুন, ধর্ষণ ও লুটপাট চালিয়েছিলো বিহারীরা। হানাদার বাহিনীরাও সেদিন অনেক মানুষকে হত্যা করেছিলো। ধারণা করা হয় বিহারীদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর চালানো ঐই দিনের হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয়েছিলেন আব্দুল লতিফ।
দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাক্ষরিত স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গকারীর হিসেবে একটি চিঠি আসে আব্দুল লতিফের স্ত্রী রহিমা খাতুনের কাছে। চিঠিতে পরিবারের প্রতি গভীর শোক জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’ থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছিলো এই পরিবারকে। মহান স্বাধীনতায় আব্দুল লতিফের আত্মদানের স্বীকৃতি ও স্মৃতি হিসেবে পরিবারের কাছে আছে শুধু একটা চিঠি, একখানা ছবি ও দুইখানা ব্যবহৃত শার্ট।
৫ মে, ২০২১ বৃহস্পতিবার এই বিষয়ে কথা হলো একাত্তর সালে ১৬ বছর বয়সী আব্দুল লতিফের ছেলে খলিলুর রহমান মজুর সাথে। তার বয়স এখন ৬৬ বছর। তিনি অবসর প্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। বাবার স্মৃতি ও সেদিনের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস সম্পর্কে জানালেন, ওই রাতের ৪ দিন পরে ছোট ভাই হিটুকে পাওয়া গেলো কিন্তু আব্বা আর আমাদের মাঝে ফিরে আসেনি। তাকে পাওয়ার জন্য দিক-বিদিক খুঁজেছি কিন্তু কোনো রকম সন্ধান পাওয়া যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আব্বার ফিরে আসার পথ চেয়ে থাকতাম। কতো আশার কথা ভাবতে ভাবতে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় উল্লাস হলো, তখন আব্বার খোঁজে কুষ্টিয়ার মানুষের কাছে কতো খোঁজ করলাম। আব্বার কোনো সন্ধান পেলাম না। একসাথে পথ চলতে চলতে একজন মানুষকে হারিয়ে ফেললাম ভাবতে পারতাম না। মাকে অনেক কষ্টে সামাল দিয়ে চলতাম আমরা। স্বাধীন বাংলাদেশে কোথায় আব্বার কবর তা আমরা জানি না। গৌরস্থানে গিয়ে সকল করববাসীকে সম্মুখে রেখে জিয়ারত করি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আব্বার অবদান কি জানি না। তার কথা কোথাও লিপিবদ্ধ হয়েছে কি-না তাও সঠিক ভাবে জানা নেই।
* ইমাম মেহেদী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক
সারাবাংলা/একে