করোনা মোকাবিলায় সব দলকে নিয়ে জাতীয় কমিটি করতে হবে
২০ মে ২০২১ ১০:৩৩
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক সাত নম্বর সেক্টরে উপদেষ্টা ও ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭২ সালে গঠিত ৩৪ সদস্যের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিরও সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা-৮ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা-১ আসনে বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। দীর্ঘ দিন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত আবু সাইয়িদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যোগ দেন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে। দলটির একাংশের অন্যতম শীর্ষ নেতা তিনি। তার সঙ্গে কথা বলেছেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আজমল হক হেলাল। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি, সমসাময়িক রাজনীতি ও জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেছেন তার সঙ্গে। দু’জনের কথোপথনের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
সারাবাংলা: করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আবু সাইয়িদ: করোনাভাইরাস যখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে, তখনই কিন্তু বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণসহ সরকারও জানত। ওই সময় যে সরকার করোনা মোকাবিলার জন্য ব্যবস্থা নেয়নি, তা নয়। তবে সেই ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবিলা করার পর অনেক পদক্ষেপেই সরকারের উদাসীনতা ছিল চোখে পড়ার মতো। যেমন— স্বাস্থ্য খাতে যে টাকা বরাদ্দ আছে, তার মাত্র ৪২ শতাংশ সরকার খরচ করতে পেরেছে। বাকি টাকা খরচই করতে পারেনি। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ দিয়েছেন, তাকে পাশ কাটিয়ে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে করে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসবের বিরুদ্ধে সরকারের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
সারাবাংলা: বিশ্বের অনেক দেশের আগেই বাংলাদেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত ডোজ না পাওয়ায় এখন এই ভ্যাকসিন কার্যক্রমে স্থবিরতা এসেছে। এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
আবু সাইয়িদ: ভ্যাকসিন কেনার সিদ্ধান্ত নিতে সরকার অনেক ভুল করেছে। বলা যায়, ভ্যাকসিন নিয়ে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার চিত্র ফুটে উঠেছে। যেমন— যখন ভ্যাকসিন তৈরি শুরু হলো, তখন সরকারের উচিত ছিল জি-টু-জি (সরকারের কাছ থেকে সরাসরি কেনা) পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করা। তা না করে সরকার বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে ভ্যাকসিন আনার চুক্তি করলো। এটি ছিল সরকারের ব্যাবসায়িক মনোভাব। তারপরও ভারত থেকে চুক্তি অনুযায়ী যে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা ছিল (৩ কোটি ডোজ), তার মাত্র চার ভাগের একভাগ (৭০ লাখ ডোজ) দিয়েছে। টাকা দিয়েও বাকি ভ্যাকসিন আমরা পাইনি। এটা সরকারেরই ব্যর্থতা। আবার চীনের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করলেন ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য। সরকার তাদের অবহেলা করে উদাসীনতা দেখাল। এখন কিন্তু তাদের কাছেই যেতে হচ্ছে। শুরুতে তাদের সঙ্গে চুক্তি করতে পারলে দেশের জন্য লাভ হতো। একাধিক ভ্যাকসিন থাকলে আজ ভ্যাকসিন সংকটে প্রয়োগ বন্ধ করতে হতো না। কিন্তু ভ্যাকসিন নিয়ে সরকার সম্পূর্ণভাবে ভারতমুখী হয়ে পড়ায় দেশের ক্ষতি করেছে। সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেনি।
সারাবাংলা: চলমান পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
আবু সাইয়িদ: করোনা থেকে মুক্তি পেতে হলে ভ্যাকসিন তো লাগবেই। তার ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। তবে সাধারণভাবে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। শুধু মানুষকে মুখে বললে হবে না, তাকে কাজে বুঝিয়ে দিতে হবে। শুধু জনগণের ওপর দোষ চাপালে চলবে না, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না রাখার জন্য সরকারকেও নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে। পাশাপাশি দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় কমিটি গঠন করতে হবে। সেই কমিটির মাধ্যমে দেশব্যাপী বিস্তৃত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে হবে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে হিমশিম খেতে হবে।
সারাবাংলা: করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে সুনির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপের কথা বলবেন কি?
আবু সাইয়িদ: পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া, লকডাউনের নামে তামাশার মতো কাজ করে ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব না। করোনা মোকাবিলা করতে হলে সরকারকে একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে একত্রিত করতে হবে। তাদের মাধ্যমে জেলা-উপজেলা-ওয়ার্ডে কমিটি করে মানুষের কাছে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। আর গণমাধ্যমকে কাজে লাগাতে হবে এ কাজে। তাদের আর্থিকভাবে সহায়তা দিয়ে যত ধরনের সচেতনতামূলক প্রচারণা আছে, সেগুলো চালাতে হবে। প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও— প্রত্যেকের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে, সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে। সেলিব্রেটিদের দিয়ে করোনা সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে।
সারাবাংলা: করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আবু সাইয়িদ: করোনা মোকাবিলায় গণফোরাম সামর্থ্য অনুযায়ী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে— স্বৈরতান্ত্রিক ও এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলগুলো কোনো পরিস্থিতিতেই তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না। রাতের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন হলে সেই সরকারের জবাবদিহিতা লোপ পায়। আর জাতীয় সংসদে যে বিরোধী দল রয়েছে, এটি নামমাত্র বিরোধী দল। এই দলটির কোনো কাজ নেই। এই দলের কাছে মানুষের তেমন কোনো প্রত্যাশাও বোধহয় নেই। সরকারের মতো এই দলেরও জবাবদিহিতা নেই।
সারাবাংলা: হেফাজতে ইসলাম সাম্প্রতিক সময়ে যে কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, একে কীভাবে দেখবেন?
আবু সাইয়িদ: হেফাজতে ইসলামসহ যেসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে, সেগুলো নিষিদ্ধ করা উচিত। কারণ বাহাত্তরের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে— ধর্মভিত্তিক সংগঠন রাজনীতি করতে পারবে না, ধর্ম নিয়ে কেউ ব্যবসা করতে পারবে না। আবার অনুচ্ছেদ ১৭’তে রাষ্ট্রে একমুখী, আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন প্রগতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা আছে। ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো যতদিন রাজনীতি করবে, ততদিন পর্যন্ত তারা মাদরাসাকে নিজেদের সাংগঠনিক লোকবল তৈরির কাজে ব্যবহার করবে। ফলে মাদরাসা থেকে সুষ্ঠু চিন্তাধারার মানবসম্পদ তৈরি হবে না। তৈরি হবে ভিন্ন মানসিকতার নাগরিক। এ জন্য ধর্মান্ধ সংগঠনগুলোর মূলোৎপাটন করা উচিত, নিষিদ্ধ করা উচিত। একইসঙ্গে মূল শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে একীভূত করা উচিত।
সারাবাংলা: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আবু সাইয়িদ: সারাবাংলাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর