আপিলে আটকা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপিদের চাকরি
৩০ মে ২০২১ ১৪:২৯
ঢাকা: স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দেশের প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (সিএইচসিপি) চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর বিষয়ক মামলা প্রায় তিন বছর ধরে আপিল বিভাগে আটকে আছে। ২০১১ সালে সারাদেশে ১৩ হাজার ৮৮১টি কমিউনিটি ক্লিনিকের সমসংখ্যক পদে সিএইচসিপিদেরকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি) প্রকল্পে নিয়োগ দেয় সরকার। এরপর থেকে তারা একই বেতন-ভাতায় কাজ করে আসছেন। দীর্ঘ ১০ বছরেও তাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা না বাড়ায় প্রায় ১৪ হাজার সিএইচসিপির মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে সারাদেশে ১৩ হাজার ৮৮১টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। আরও ১৪৬টি ক্লিনিক চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ৮৭৮ জন সিএইচসিপি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যার ৫৪ শতাংশ নারী। সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না পাওয়ায় তাদের মধ্যে সহস্রাধিক ব্যক্তি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বা অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন।
কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গড়ে প্রতিদিন অর্ধশতাধিক সেবাগ্রহীতা সেবা নেন। এসব সেবাপ্রার্থীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ গ্রামীণ দরিদ্র নারী ও শিশু। তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পেয়ে আসছেন। কমিউনিটি ক্লিনিকে যেসব সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- অন্তঃসত্ত্বা নারীর প্রসবপূর্ব টিকাদান এবং প্রসব পরবর্তী নবজাতকের সেবাসহ যক্ষ্মা রোগের প্রতিষেধক টিকাদান, ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইসিস-বি টিকাদান। এ ছাড়া নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, জ্বর, ব্যথা, কাটা/পোঁড়া, হাঁপানি, চর্মরোগ, কৃমিসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ সীমিত চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টি বিষয়ে প্রাথমিক সেবা ও উপকরণসহ ৩০ ধরনের ওষুধ ও স্বাস্থ্য-সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়।
বর্তমানে এসব ক্লিনিকের মাধ্যমে বছরে প্রায় ২০০ কোটিরও বেশি টাকার ওষুধ সরবরাহ করছে সরকার। ২০২২ সালের মধ্যে সরকার আরও ১ হাজার ২৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ শুরু করে। এরপর ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের পর সরকার আবার কমিউনিটি ক্লিনিক চালুর উদ্যোগ নেয়। অতঃপর ২০১১ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পে সিএইচসিপিদের নিয়োগ দেয় সরকার। বর্তমানে সিএইচসিপিরা তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের দাবি করে আসছেন।
এদিকে ২০১৭ সালে সিএইচসিপি মো. সহিদুল ইসলাম, কামাল সরকার, জাহিদুল ইসলামসহ ১০ জন তাদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। শুনানি শেষে একই বছরের ২২ মার্চ বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চ আবেদনকারী ১০ জন সিএইচসিপির চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। পরে একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০ পৃষ্ঠার ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়।
আইনজীবী ও সিএইচসিপিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর চেয়ে হাইকোর্টে ৭৬টি রিট দায়ের করেন দেশের বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার সিএইচসিপি। এর মধ্যে ৭৪টি রিটে সিএইচসিপিদের পক্ষে রায় হয়। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপক্ষ এসব রায়ের মধ্যে থেকে কয়েকটি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন।
এর মধ্যে কক্সবাজারের রামু উপজেলার এস.এম রেজাউল করিমসহ আরও কয়েকজন রিট দায়ের করেন। রেজাউল করিমসহ কয়েকজনের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তরের নির্দেশনা দিয়ে বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন।
ওই মামলার রিটকারীদের আইনজীবী মাসুদ আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাইকোর্ট ২০১৮ সালে সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্বখাতের স্থানান্তরের নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়। একই সময়ে প্রায় অর্ধশতাধিক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট আবেদনকারী সব সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তরের নির্দেশনা দেয়। পরে এ সব রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে যায়। আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত এসব রায় স্থগিত করেন। তারপর থেকে এ মামলাগুলো আপিল বিভাগে আটকে আছে।’
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের রামু উপজেলার সিএইচসিপি এস. এম রেজাউল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গত ১০ বছর ধরে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট)সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছি। হাইকোর্টের রায় মেনে আমাদের চাকরি দ্রুত রাজস্বখাতে স্থানান্তর করা হোক। আমরা অন্যান্য সরকারি চাকরির মতো সুযোগ-সুবিধা চাই।’
এর মধ্যে সরকার ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন’ প্রণয়ন করে। একই সঙ্গে সিএইচিসিপিদের চাকরি ট্রাস্টে স্থানান্তর করা হয়। তবে সুপ্রিম কোর্টে মামলা বিচারাধীন থাকায় সিএইচসিপিদের চাকরি ট্রাস্ট্রে স্থানান্তর প্রক্রিয়া আটকে যায়।
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের সংগঠন বাংলাদেশ সিএইচসিপি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, “আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলাম। রায়ও আমাদের পক্ষে পেয়েছি। কিন্তু এর বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। সরকারের ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইনকে’ আমরা সম্মান করি। আমরা চাই কমিউনিটি ক্লিনিকের জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করে কমিউনিটি ক্লিনিকের আনুষাঙ্গিক বিষয়াবলীকে সরকারের প্রণীত ট্রাস্টে ন্যস্ত করা হোক।”
আপিল বিভাগে রিটকারীদের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োজিত আইনজীবী মোহাম্মদ ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছে। এখনও আপিল শুনানি শুরু হয়নি। আশা করি আপিলেও আমরা জয়ী হবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষেরা সেবা পেয়ে উপকৃত হচ্ছেন। তাই সারাদেশে এই সেবা চালু রাখার জন্য সেবা প্রদানকারীদের পদ রাজস্বকরণ করা সময়ের দাবি বলে আমি মনে করি।’
জানতে চাইলে রাষ্ট্রের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাসান চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে আপিল বিভাগের কার্যক্রম ভার্চুয়ালি পরিচালিত হচ্ছে। ভার্চুয়াল আদালতে এসব মামলার আপিল শুনানি হবে না। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শারীরিক উপস্থিতিতে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে নিয়ম অনুযায়ী এসব মামলা আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসবে।’
সারাবাংলা/কেআইএফ/একে