অতলান্তিক পেরিয়ে পর্ব ৫
৪ জুন ২০২১ ১০:০০
২০১৫ সালে আমি আমেরিকা আসার সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। আপনাদের হয়তো মনে থাকার কথা সেসময় প্রায় প্রতিদিন বাস পোড়ানো হচ্ছে, পেট্রোল বোমায় মানুষ মারা যাচ্ছে। ইউএস জার্নির ঠিক আগে আগে একদিন আব্বা আমাকে জানালেন যে তিনি দেশের বাড়ি যেতে চান। প্রতি বছর কিছু সময়ের জন্য তিনি গ্রামে গিয়ে থাকেন। এটা তাঁর চল্লিশ বছরের অভ্যেস। সেই অভ্যেসে ছেদ পড়ুক এটা তিনি চান না। সময়টা যে খারাপ যাচ্ছে সেটা নিয়ে তাঁর কোন মাথা ব্যথা নেই। বয়স্ক মানুষরা মাঝে মাঝে শিশুসুলভ কিছু আচরণ করেন এবং আচরণটা যে শিশুসুলভ হচ্ছে সেটা তারা বুঝতে পারেননা। দেশের এরকম একটা ভয়ংকর সময়ে যেখানে খুব দরকার না হলে কেউ বাসার বাইরেই যাচ্ছেনা, সেখানে তিনি বাসে চড়ে কিভাবে দেশের বাড়ি যাবার কথা ভাবলেন এটা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলাম। ইউএস আসার শেষ মূহুর্তের প্রস্তুতি নেবার ছিল অনেক। তাই আব্বার দেশের বাড়ি যাবার ব্যাপারটা চাপা পড়ে যায়।
এর মধ্যে একদিন বিকেলে অফিস থেকে বাসায় মাত্র এসেছি। আজকেও বাস মিস করেছি বলে মাউন্ট ফিক সেমেটারির ভেতর দিয়ে হেঁটে এসেছিলাম। এসে একটা খবর পেলাম। আব্বা নাকি বহ্নিকে সকাল সাড়ে ছয়টায় ফোন দিয়েছেন। এত সকালে ফোন পেয়ে বহ্নি তাড়াতাড়ি ফোন ধরল। সকাল বেলার আর গভীর রাতের ফোন কোন ভাল খবর আনে না। না জানি কি ঘটল আবার। ওপার থেকে ফোনে আব্বা বলল যে তিনি এখন বাসস্ট্যান্ডে। বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। বাসায় বসে থাকতে তার আর ভাল লাগছিল না, তাই তিনি দেশের বাড়ি যাচ্ছেন কিছুদিনের জন্য। আমরা যেন তাকে নিয়ে চিন্তা না করি, তিনি ঠিকঠাক মতই পৌঁছাতে পারবেন এবং পৌঁছে জানাবেন। বহ্নি চুপ করে রইল, কী আর বলবে সে। সাবধানে যাবেন আব্বা, বলে সে ফোন রেখে দিল। আমাকে কিংবা বহ্নিকে তিনি আগে থেকে কিছুই জানান নি। তার ভয় ছিল যে জানালে আমরা হয়তো তাকে নিষেধ করে দিতে পারি। তাই চোরের মত একেবারে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাসের পাদানিতে পা রাখতে রাখতে তিনি বলেছেন ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান। এই হচ্ছে আমার আব্বা।
খবরটা শুনে কিছুক্ষণ গুম মেরে রইলাম। অফিস থেকে ফিরে এসেছি ঠিকই, কিন্তু আজকে আমার অনেক কাজ। আগামীকাল একটা প্রেজেন্টেশন আছে বেন্টলি ইউনিভার্সিটিতে। সেটার প্রিপারেশন নিতে হবে। কিন্তু আব্বার এরকম চালাকি করে দেশের বাড়িতে চলে যাবার ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছি না। দেশের পরিস্থিতি আসলেই ভাল না। আমার ভয়টা হল, আমি এত দূরে আছি, গড ফরবিড কিছু একটা ঘটলেও তো আমি চট করে দেশে আসতে পারব না। আর ক’টা দিন পরে গেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত? মাথা গরম হয়ে রইল কিছুক্ষণ। মাথা ঠান্ডা হবার পর ফোন দিলাম আব্বাকে। ফোন দিয়েই বুঝলাম দেশের বাড়িতে তিনি মহা আনন্দে আছেন। যা-ই জিজ্ঞেস করি, তিনি আদুরে আদুরে গলায় সেটার উত্তর দিচ্ছেন। তিনি যখন গ্রামে তার পুরনো পরিচিতদের সাথে থাকেন, নিজের মায়ের সাথে থাকেন, তখন তার এই গলার স্বরটা প্রকাশ পায়। তার মা, মানে আমার দাদীর নব্বইয়ের উপর বয়স। আমার আব্বা তার বড় ছেলে। মায়ের কাছে এলে মনে হয় যেকোন প্রৌঢ়ের বয়সও কয়েক দশক কমে যায়। আব্বারও তা-ই হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম আপনি কোথায় এখন আব্বা? তিনি বললেন, এই তো বাড়ির ভিতর বাবা, আর কোথায় যাব? আমি বললাম, এখানে তো খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আপনাকে কেউ কিছুই বলবে না। যা খেতে ইচ্ছা হয় এরা আপনাকে খাওয়াবে। তবে একটু নিয়ম মেনে খাবেন যদি পারেন। আর যা-ই খান জর্দা দিয়ে পান কিন্তু খাবেন না। জর্দা খাওয়া আপনার জন্য নিষেধ, মনে আছে তো?
তিনি বললেন, হ্যাঁ বাবা মনে থাকবে না কেন। মনে আছে। জর্দা আমার দশ হাতের মধ্যে আনতে এদেরকে নিষেধ করে দিছি। আর পান তো আমার পায়ে ধরে সাধলেও আর খাবনা। তুমি চিন্তা কইরো না। আচ্ছা, বাবা একটা খবর দাও তো। খবরটা জানা অত্যন্ত জরুরী। আমেরিকাতে নাকি এবার দশ হাত উঁচু বরফ পড়ছে, ঘটনা কি সত্যি নাকি? আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এসব হচ্ছে তার কথা ঘোরানোর কায়দা। কে জানে হয়ত আয়েশ করে পান খেতে খেতেই কথাগুলো বলছেন তিনি। সারাজীবন তিনি বোকা বোকা স্টাইলে কথা বলেছেন। তার কথা ঘোরানোর স্টাইলটাও বোকার মত। অথচ কে বলবে এই বোকা লোকটা মুক্তিযুদ্ধের সময় টিফিন ক্যারিয়ারে করে গেরিলা বাহিনীর কাছে বোমা পৌঁছে দেবার দ্বায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিলেন। ঢাকার হাজারীবাগে ধরাও পড়েছিলেন পাক আর্মির হাতে। অবিশ্বাস্য ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছিলেন সেদিন। তবে তার সাথের দুই সহকর্মীর ভাগ্য তার মত প্রসন্ন ছিল না। তারা সেদিনই শহীদ হন।
ফোন রাখার পর ভাল লাগল। মনে হল একটু বাড়াবাড়িই করছি আমি। যে লোক মুক্তিযুদ্ধের মত একটা একই সাথে ভয়াবহ এবং গৌরবময় প্রলয়ে অংশ নিয়ে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছেন, তাকে নিয়ে টেনশন করাটা আসলে আমার মানায় না। মানুষটা আনন্দে আছে, এতেই আমার আনন্দিত হওয়া উচিৎ। এর বেশি কিছু ভাবার আপাতত আমার দরকার নেই। দেখলাম মনটা আস্তে আস্তে শান্ত হতে শুরু করেছে। বেন্টলি ইউনিভার্সিটির প্রেজেন্টেশনটা নিয়ে এখন বসা যেতে পারে।
ঢাকা থেকে কেনা জুতাটা ছিঁড়ে যাওয়াতে আমি শেষ পর্যন্ত বোস্টন গিয়ে জুতা কিনেছিলাম। ইচ্ছা ছিল ক্যাটারপিলারের জুতা কিনব, কিন্তু ডিজাইন পছন্দ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত স্কেচারস্-এর এক জোড়া বুট কিনলাম। সেই বুট পরে পরদিন গেলাম বেন্টলি ইউনিভার্সিটি। এখানে প্রেজেন্টেশনের বিষয়টা একটু পরিষ্কার করা দরকার। ম্যাসাচুসেটস্ অঙ্গরাজ্যটা অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিখ্যাত। এমআইটি (Massachusetts Institute of Technology) তো পৃথিবী বিখ্যাত। বোস্টন ইউনিভার্সিটি, অ্যামহার্স্ট ইউনিভার্সিটি, ব্রিস্টল কমিউনিটি কলেজ, বেকার কলেজ সহ প্রায় ১১৪ টা কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি আছে ম্যাসাচুসেটস্ স্টেট জুড়ে। তার মধ্যে ওয়ালথামেই দু’টো নাম করা ইউনিভার্সিটি আছে, একটা হচ্ছে বেন্টলি, আরেকটা ব্র্যান্ডাইস। ব্র্যান্ডাইসটা ছিল টার্নার স্ট্রিটে আমাদের অফিসে আসার পথেই। আমরা যে প্রোডাক্টটা নিয়ে কাজ করছি, সেটার একটা ক্লিন ইউজার এক্সপেরিয়েন্স সাপোর্টের প্রয়োজন ছিল। আমরা কেউই ইউএক্স এক্সপার্ট না। এখানে লোকাল ভেন্ডরদের ব্যাপারটা জানানো হয়েছিল। বেন্টলি ইউনিভার্সিটির একটা ইউএক্স টিম আছে। কিভাবে যেন তারা খবরটা পায়। তারা আমাদেরকে এখানে ডাকে যে আমরা কী চাইছি সেটা যদি তাদেরকে প্রেজেন্ট করতে পারি, তাহলে তাদের ইউএক্স টিম ব্যাপারটায় হেল্প করতে পারে। এই হল আমার এখানে এসে প্রেজেন্টেশন দেবার শানে নযুল। সাথে এসেছে অঙ্ক ভাই, রিয়াজ ভাই, আতাউর আর মিশেল। ইউনিভার্সিটি টাইপের জায়গাগুলোতে এলেই আমার মন উদাস হয়ে যায়। সেই একই ধরণের আড্ডা, সেই একই ধরণের হাসাহাসি, কিছু কিছু ছেলেমেয়ের মেঝেতে গোল হয়ে বসে সেই একই ধরণের সিরিয়াস ডিসকাশন। সারা পৃথিবীর ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের চিন্তাভাবনা আসলে প্রায় একই রকম। তবে মনের উদাস ভাবটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলাম না।
বুটটা এত বেশি আওয়াজ করছে যে এখন মনে হচ্ছে এটা পরে আসাটা ভুল ছিল। একটা চকচকে পিচ্ছিল করিডোর দিয়ে হাঁটার সময় ভয়াবহ আওয়াজ হতে থাকল। এখন আর এটাকে জুতার আওয়াজ বলে মনে হচ্ছে না, অন্য ধরণের আওয়াজ। মানুষজন দেখলাম ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। বেইজ্জতি আর কাকে বলে। খুব আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে হাঁটা ছাড়া কোন উপায় রইল না। বেন্টলি ইউনিভার্সিটিতে প্রেজেন্টেশনটা ভালই হয়েছিল। তবে ওরা আমাদের যে ইউএক্স সাজেস্ট করেছিল তাতে আমরা হতাশ হই। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এর চাইতে বেটার ইউএক্স এর কাজ করে। শুধু সুযোগের আর এক্সপোজারের অভাবে আমরা বেশিদূর যেতে পারি না।
এভাবেই কাটতে থাকল একঘেয়ে দিনগুলো। মার্চের মাঝামাঝি চলে এল। এক দুপুরে অফিস করতে করতে হঠাৎ দেশের কথা মনে পড়ল। এখন ঢাকায় গভীর রাত। আর কয়েক ঘন্টা পর সকাল হলে আমার বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে এক বুড়ো শাকওয়ালা শাক বিক্রি করতে বের হবে। এই শাকওয়ালাটা সবসময় চার রকমের শাক নিয়ে বের হয়। তার ডাকটা হয় এরকম, “লাল শাক! পুঁই শাক! পালং শাক! পানিকচু!!” একদিন দেখি পানিকচু দুইবার বলছে। বুঝলাম সে আইটেম এনেছে তিনটা, কিন্তু যেহেতু চার আইটেমের নাম বলাটা তার সিস্টেমের অংশ, সে সিস্টেমের বাইরে যেতে পারছেনা। পানিকচু শব্দটা তাই দুইবার করে বলছে। মনে হল আহারে কতদিন এই ডাকটা শুনি না! কবে দেশে যাব? কবে রিকশার টুংটাং আওয়াজ শুনব? কাকের ডাক শুনব? মন এত খারাপ করল যে হিমাংশুকে বললাম বাসায় যাব। হিমাংশু স্বাভাবিক ভাবেই জানতে চাইল কোন সমস্যা হয়েছে কি না। প্রায় বলেই ফেলেছিলাম “পেট ব্যথা করছে”। বাচ্চারা স্কুলে না যাবার জন্য এই কমন অযুহাতটা দেয়। এই অযুহাত নিশ্চই এখানে দেয়া যাবে না, দিলেই অফিসের ডাক্তার ডাকবে। বললাম, না তেমন কিছু না, একটু আগে বের হতে চাচ্ছি আরকি। হিমাংশু বলল, হুম, নো প্রব্লেম জাকির, ইউ ক্যান গো। এই হিমাংশু লোকটাকে আমার অসম্ভব ভাল লাগে। একে নিয়ে একটা ছোট্ট কথা বলে পরের অংশে যাচ্ছি। অফিসে একটা কিচেন আছে আমাদের। কেউ চাইলে কফি বানিয়ে খেতে পারে। ভেন্ডিং মেশিন থেকে টুকিটাকি স্ন্যাক্স কিনেও খেতে পারে। অনেক ধরণের সিরিয়াস ডিসকাশন মিটিং রুমে না করে কফির মগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই কিচেনেই আমরা সারি। একদিন আমি আর হিমাংশু কফি খেতে খেতে কিচেনে গল্প করছি। হিমাংশুর জন্ম ভারতের উড়িষ্যায়। বাংলা ভাষার সাথে উড়িয়া ভাষার একটু একটু মিল আছে। সে বাংলা সামান্য বুঝতেও পারে। কিভাবে কিভাবে যেন তাজমহলের কথা উঠল। আমি বলছিলাম ২০০৭ সালে আমার তাজমহল দেখার অভিজ্ঞতার কথা। যেখানে আমার আগ্রায় যাবার ইচ্ছাই ছিল না, সেখানে তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে আমার যে কথা বন্ধ হয়ে গেছিল সেটা বললাম। এই গল্পটা আমি সবাইকেই বলি, তারপর ইচ্ছাকৃতভাবে একটু চুপ মেরে যাই। চুপ মেরে যাবার সেই গ্যাপটায় তখন সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করে তারপর কি হল? হিমাংশু দেখলাম কিছুই বলছে না। বললাম, তোমার তাজমহল দেখার এক্সপেরিয়েন্স কেমন ছিল? সে মুচকি হেসে গোঁফের ফাঁক দিয়ে বলল, আমি তাজমহল সামনাসামনি দেখিনি কোনদিন। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। কফিতে চুমুক দিয়ে সে বলল, যখন আমি ইন্ডিয়াতে ছিলাম, আমার যখন তাজমহল দেখার সময় এবং বয়স ছিল, তখন আমার আগ্রায় যাবার পয়সা ছিল না। এখন আমি আমেরিকা চলে এসেছি। এখন আমার টাকা আছে, কিন্তু সেই সময়ও নেই, বয়সও নেই। আমি চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। প্রশ্নটা করার জন্য নিজের উপর রাগ হতে থাকল। ওয়ালথাম অফিসে যে কজন উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ আমি পেয়েছিলাম, হিমাংশু ছিল তাদের মধ্যে একজন।
আরও পড়ুন
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ১
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ২
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৩
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৪
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৬
- অতলান্তিক পেরিয়ে – পর্ব ৭
অফিস থেকে বের হয়ে চিন্তা করলাম কোথায় যাওয়া যায়। আজকে আমি একা। আতাউর আর রাজীব এখনও অফিস করছে। চিন্তা করে দেখলাম ওয়াটারটাউনেই যাই, আমাদের আমেরিকান বসুন্ধরা সিটি। প্রথমে আর্সেনাল মলে নেমে সাবওয়েতে গেলাম। সুপ্রিয়া আমাকে দেখে হাই দিল। জিজ্ঞেস করল, আজকেও কি টুনা স্যান্ডউইচ? আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ, আজকেও টুনা স্যান্ডউইচ। সে হাসতে হাসতে স্যান্ডউইচ প্রিপারেশন শুরু করল। স্যান্ডউইচটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এই মার্কেটের উল্টো দিকে ওয়াটারটাউন মল। এটা আর্সেনাল মলের চাইতেও বড়।
এর ভেতর আমেরিকার বিখ্যাত চেইন শপ “টার্গেট” আছে। এর আগে কয়েকবার টার্গেটে গিয়েছি। ভাবলাম ঘুরে আসি। যখন কোন কাজ থাকেনা আমি মাঝে মাঝে এখানে আসি। বিশাল বিশাল সেকশনগুলোতে ঘুরে বেড়াতে ভালই লাগে। কেনার সামর্থ্য আমার খুবই সীমিত। কিন্তু প্রাণ ভরে দেখতে তো পয়সা লাগে না। যেকোন অজ্ঞাত কারণে হোক, আমার সবচেয়ে বেশি সময় লাগে খেলনার সেকশনটা ঘুরে দেখতে। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটা খেলনা দেখি। মুগ্ধ হয়ে দেখি। আমাদের দেশে মুস্তাফা মার্টের কারণে কিছু ভাল খেলনা আসা শুরু হয়েছে। কিন্তু এখানকার খেলনাগুলো অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। এই সেকশনে আসা বাচ্চাগুলোকে দেখতেও আমার ভাল লাগে। আজকে যেমন এক পিচ্চি মেয়ে এসেছে তার বাবার সাথে। বাবা বাচ্চাটাকে খেলনার সেকশনে ছেড়ে দিয়ে পাশের সেকশনে গেছে। দেখলাম বাচ্চা একটা আয়রনম্যানের মাস্ক হাতে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে জিনিস সে হাতে নিয়েছে, সেটা দেখে বাচ্চা কি মুগ্ধ হবে, আমি নিজেই মুগ্ধ। এত সুন্দর মাস্ক, যে মনে হচ্ছে আসল আয়রনম্যানের মাস্কও এটার কাছে কিছুই না। আমি এবং বাচ্চা দুজনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হা করে মাস্কটার দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর বাচ্চার মনে হল, এখন অ্যাকশনে যাওয়া দরকার। সে এখান থেকেই চিৎকার করে বলল, ড্যাডি কাম হিয়ার! তার বাবা পাশের সেকশন থেকে বলল, হোয়াই সুইটি? বাচ্চা গম্ভীর গলায় বলল, ড্যাডি প্লিজ কাম হিয়ার নাও, উই নিড টু টক! বাচ্চারা যখন এরকম গলায় কথা বলে তখন বুঝতে হবে যে তার ব্যাটল প্ল্যান রেডি। সে এখন ভুজুং ভাজুং দেবে। যেভাবেই হোক খেলনাটা আদায় করে ছাড়বে। দরকার পড়লে কেঁদে বুক ভাসাবে। এই টার্গেটেই আমি একবার এক মা’কে তার বাচ্চার প্যান্টের গোড়া ধরে টেনে নিয়ে যেতে দেখেছি। বাচ্চা তখন উপুড় হয়ে মাটি খামচাতে খামচাতে যাচ্ছিল আর আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছিল। বাচ্চারা প্রয়োজনে অত্যন্ত ভয়ংকর আচরণ করতে পারে। এবং এই কাজটা তারা ইচ্ছা করেই করে মা বাবাকে এমব্যারেস করার জন্য। মাস্কটার আরেকটা কপি হাতে নিয়ে দেখলাম দাম পঁচিশ ডলার। অনেক দাম! এখানে একটা মডারেট রেস্টুরেন্টে পেট উপচে লাঞ্চ খেতে ছয় থেকে দশ ডলার লাগে। সাবওয়েতে পঁচিশ ডলারে পাঁচটা বড় সাইজের স্যান্ডউইচ পাওয়া যায়। ম্যাগডোনাল্ডস্-এ খরচ আরো কম। দূর থেকে আমেরিকানদের সম্পর্কে আমাদের কাছে যা-ই মনে হোক না কেন, এরা অতি হিসেবি। প্রতিটা সেন্ট হিসেব করে খরচ করে, বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা। ওর বাবা এটা ওকে কিনে দেবে কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আবার কিনে না দিলে সে যে একটা কান্ড ঘটাবে সেটাও তার গলার স্বরে বোঝা যাচ্ছে। আমি একটু সরে এসে পাশের রো’তে গেলাম। সেখান থেকেই শুনতে পেলাম বাপ বেটির কনভার্সেশন। বাচ্চা খেলনাটা নেবেই। বাবা বলছে, উঁহু, এটার অনেক দাম। কিছুক্ষণ বোঝানোর পর বাবা যখন দেখল কথায় কাজ হচ্ছে না, তখন সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সুইটি, বলতো আমার পকেটে এখন কত টাকা আছে? মেয়ের জবাব ফোর্টি নাইন ডলার। বুঝলাম মেয়ে বাবার মানিব্যাগের ওজন সম্পর্কে ভালই ওয়াকিবহাল। বাবা বলল, এই ফোর্টি নাইন ডলার দিয়ে আমাদের সামনের সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে হবে তুমি কি ভুলে গেছ? তোমার ছোট্ট ভাইটার জন্য যে খাবার কিনতে হবে সেটা কি তোমার মনে নেই? তুমিই তো আমাকে এখানে নিয়ে এলে ওর জন্য বেবি ফুড কিনতে। বল, তুমিই নিয়ে আসনি? বাচ্চা ফোঁপাচ্ছিল। বলল, হুঁ। বাবা বলল, এখন যদি তুমি চাও, খুব বেশি চাও, তাহলে তোমাকে এই খেলনাটা আমি কিনে দিতে পারি। কিন্তু সেক্ষেত্রে তোমার বেবি ব্রাদারের জন্য আমাকে কম খাবার কিনতে হবে। এখন তুমিই বল আমি কী করব? বাচ্চা ফোঁপানো বন্ধ করল। বলল, আমি চাই তুমি ভাইয়ের জন্য খাবার কেন। এই খেলনাটা আমার দরকার নেই। আমি পাশের রো থেকে দেখলাম, বাবা পিচ্চিটাকে কোলে নিয়ে কপালে একটা চুমু খেল। তারপর বলল, আমি প্রমিস করছি এই ক্রিসমাসে তোমাকে আমি এই মাস্কটা কিনে দেব, তুমি মন খারাপ করোনা। আই লাভ ইউ সুইটহার্ট। বাচ্চার সাথে সাথে জবাব, আই লাভ ইউ টু ড্যাডি। এই দৃশ্যটা আমার মন অসম্ভব রকম ভাল করে দিল। একটা মানসিক তৃপ্তি নিয়ে পা বাড়ালাম পরের রো’তে। আমরা আসলে যেটা বুঝিনা সেটা হল বাচ্চারা আমাদের ধারণার চাইতেও অনেক বেশি দায়িত্বশীল। শুধু তাদেরকে দায়িত্ববোধটা শেখাতে হয় আর সেটা পালন করার সুযোগ করে দিতে হয়। এই ব্যাপারটায় আমাদের দেশের বাবা মায়েরা কত যে পিছিয়ে আছে সেটা ভাবতে ভাবতে বাসার দিকে রওনা দিলাম।
বাসায় ফিরে এসে দেখি মোবাইলে একটা ম্যাসেজ এসেছে। বাসের আওয়াজে ম্যাসেজটা খেয়াল করিনি। বহ্নির ম্যাসেজ। সেখানে লেখা তোমার স্যুটকেসের ভেতরে তলার দিকের চেনটা খোল। এই ম্যাসেজের মানে যে কি বুঝলাম না। কল দিতে গিয়েও মনে হল, আচ্ছা আগে দেখি কেন স্যুটকেসের তলা সে দেখতে বলেছে। আমার স্যুটকেসের ভেতরের লাইনিং-এ একটা চেইন আছে। যেটা খুললে ট্রলির মেটাল অংশটুকু দেখা যায়। চেইনটা খুলে সেখান থেকে দু’টো জিনিস বের হল। একটা কার্ড, আরেকটা নরম তুলোর তৈরি ব্যাঙ, প্লাশ টয় যাকে বলে। যে অস্থির মন নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছিলাম, সেটা ভাল হয়ে গেছিল টার্গেটে পিতা-কন্যার সেই অসাধারণ ঘটনাটা দেখেই। এরপরেও যে আজকের দিনে আমার জন্য কিছু বাকি ছিল জানতাম না। বাংলাদেশে আজকে মার্চের চৌদ্দ তারিখ। আমার জন্মদিন। বহ্নি জানত যে এই দিনটা আমাকে একা একা কাটাতে হবে আমেরিকাতে। তাই সে আমার জন্মদিনের গিফট্ পাঠিয়ে দিয়েছে স্যুটকেসের গোপন কুঠুরিতে ভরে। কাজটা সে নিশ্চয়ই ঢাকাতে আমার স্যুটকেস গোছানোর সময়ই করেছিল, আমাকে সে বলেনি। এরকম সারপ্রাইজ জীবনে খুব কমই পেয়েছি। কার্ডে বহ্নির হাতে লেখা উইশটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, Had I the heavens’ embroidered cloths, I would spread the cloths under your feet! মনটা খুব বেশি রকম ভাল হয়ে গেল। মোবাইলটা হাতে নিলাম। বহ্নিকে ফোন দিতে হবে এখন।
(চলবে)
সারাবাংলা/এসএসএস