এনআইডি কার্যক্রম মন্ত্রণালয়কে দেওয়ার উদ্যোগ, ইসির স্বাধীনতা খর্ব
৬ জুন ২০২১ ১৯:৫৭
ঢাকা: সরকার কর্তৃক জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার উদ্যোগ নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হামলা বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক সংলাপে অংশ নেওয়া বক্তারা।
রোববার (৬ জুন) ‘সরকার কর্তৃক জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার উদ্যোগ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক এক নাগরিক সংলাপে অংশ নিয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। নাগরিক সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সুজন কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য বিচারপতি এম এ মতিন।
সংলাপে বক্তব্য দেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, সাবেক মন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম, বিশিষ্ট সাংবাদিক সোহরাব হাসান ও আবু সাঈদ খান। এছাড়াও সংলাপে বক্তৃতা করেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল, রাজনীতিবিদ রাজেকুজ্জামান রতন ও রুহিন হোসেন প্রিন্স। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।
মূল প্রবন্ধে ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন এককভাবে ডিএফআইডির উদ্যোগে এবং ইউএনডিপির সমন্বয়ে দ্য প্রিপারেশন অব দ্য ইলেক্ট্রোরাল রোলস প্রজেক্টের আওতায় ভোটার তালিকা তৈরির তিন বছর মেয়াদী পরিকল্পনা ২০০৭ সালের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমোদনে হাতে নিয়েছিল। প্রথমে একে ভোটার আইডি বলা হলেও পরে এর সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র যুক্ত করা হয়। ছবিসহ ভোটার তালিকার সঙ্গে যুক্ত থাকায় শুধু প্রিন্ট এবং প্লাস্টিক কভারের যৎসামান্য খরচে যুগপৎভাবে ভোটার তালিকা এবং আইডি কার্ড প্রস্তুত করার পাইলট প্রকল্প শুরু করা হয় গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলায়। এই প্রকল্পটি যখন হাতে নেওয়া হয় তখন কোনো সরকারি মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে আইডি কার্ডের প্রকল্পে কোনো ধরনের আগ্রহ প্রকাশ করেনি। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পটি প্রায় শতভাগ দাতাদেশগুলোর সহযোগিতায় সম্পন্ন করা হয়। ইউএনডিপির হস্তান্তরের পর নির্বাচন কমিশন গত ১৩ বছর যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে এত বড় আয়োজন সম্পন্ন করে আসছে। তৃতীয়ত, ২০১০ সালের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা, জেলা এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম পরিচালিত হয়।’
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকার সঙ্গে যুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পত্রানুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে অর্পন করা হলে নির্বাচন কমিশনের একটি বৃহৎ অংশ সরকারের উল্লিখিত মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত হবে। যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সত্তা খর্ব হবে। এটি মোটেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এটা নিয়ে দেশ-বিদেশে সরকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং অপরদিকে ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও ব্যবহারে জটিলতা সৃষ্টি হবে। সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব কমিশনের। বিদ্যমান আইনে এর ভাগীদার অন্য কোনো সংস্থাকে করা যাবে না। কাজেই অন্য কোনো সংস্থাকে ভোটার তালিকা সরবরাহ সংবিধান সম্মত হবে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পত্র কার্যকর করলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে।’
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘অনেকগুলো শঙ্কার উদ্রেক করে, তা হলো সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠানকে দেশের সরকার প্রধান এ রকম নির্দেশনা দিতে পারেন কি না। এটি কমিশনের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হামলা।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভোটার ডাটাবেজ যদি সরকারের নিয়ন্ত্রণে যায় সরকার বিভিন্ন রকম কারসাজির মাধ্যমে কাউকে ভোটার করতে পারে এনং কাউকে বাদ দিতে পারে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের একটা সুযোগ থেকে যায়, দুর্নীতিরও সুযোগ তৈরি হয়।’
আবু সাঈদ খান বলেন, ‘একটি দেশের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কী দায়িত্ব পালন করা হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কোনো কাজে সফলতা দেখায় সেটাও ধরে রাখা উচিত।’
আসিফ নজরুল বলেন, ‘কমিশনের বোঝা উচিত তারা নিজেদের কোথায় নামিয়েছে। তারা কতটা মর্যাদাহীন সেটা যেন তারা একটু অনুধাবন করে। কমিশনের ওপর আমাদের আস্থা নেই এটা ঠিক। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ে নিয়ে গেলে আরও শংকাজনক ও বিপদজনক হবে। কারণ কমিশনতো নিজে সরাসরি জনগণকে নিপীড়ন করেনি। গত নির্বাচনে এজেন্ট ও ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেয়নি। এই কাজগুলো করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়য়ের অধীনে পুলিশ।’
শাহদীন মালিক বলেন, ‘বেশ কয়েকদিন বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানানো হয়নি কী উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে। কমিশনের হাতে থাকলে কী অসুবিধা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়য়ের কাছে গেলে কী সুবিধা- তাও জানানো হয়নি। এটি পরবর্তী নির্বাচনের নতুন তরিকার পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে।’
এম এ মতিন বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়য়ের ওপর কেউ আস্থা রাখতে পারছেন না। এখন যে ক্ষমতাটা সেটা সাংবিধানিক ক্ষমতা। আর আইন করে কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিলে সেটা সাবর্ডিনেট হয়ে যাবে।’
সারাবাংলা/জিএস/পিটিএম