Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বর্ষা দুয়ারে, যথারীতি পাহাড় নিয়ে ‘সরব’ প্রশাসন

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৮ জুন ২০২১ ২০:৪৬

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বর্ষা একেবারে সন্নিকটে। এরই মধ্যে চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় কয়েক দফা মাঝারি বৃষ্টিপাতও হয়েছে। এতে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন নিচু এলাকা তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তৈরি হয় পাহাড় ধসের শঙ্কাও। আর বর্ষা ঘনিয়ে আসার পরই যথারীতি বিভিন্ন পাহাড়ে ও পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিয়ে শুরু হয়েছে জেলা প্রশাসনের তোড়জোড়। গত দেড় দশকের মতো ধারাবাহিকতায় সারাবছর নীরব থাকলেও বৃষ্টির মৌসুম শুরুর আগ মুহূর্তে সরব হয়েছেন প্রশাসনের লোকজন।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (৮ জুন) চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় পরিদর্শন করেছেন। প্রতিবছর বর্ষা এলেই এ ধরনের পরিদর্শন হয়। এবার আবার বিভাগীয় কমিশনার জানিয়েছেন, পাহাড় ও সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন রক্ষায় তিনি নতুন করে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা দেবেন।

২০১৯ সালে সরকারিভাবে গঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি চট্টগ্রামে বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের তালিকা করেছিল। সেই তালিকা অনুযায়ী চট্টগ্রামে মোট ১৭টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি আছে। এর মধ্যে ১০টি ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়। বাকি সাতটি বিভিন্ন সরকারি সংস্থার। এসব সংস্থার মধ্যে আছে— রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত বিভাগ, বন বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।

ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রামের এমন অনেক পাহাড়

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের তালিকায় ১৭টি পাহাড়ে ৮৩৫টি পরিবারকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসের জন্য চিহ্নিত করা হয়।

তালিকা ধরে ওই বছরের ৩ জুলাই থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। ৩ জুলাই  থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত টানা অভিযান চালিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশ পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু এরপর আকস্মিকভাবে থেমে যায় বসতি উচ্ছেদ অভিযান। কেবল বৃষ্টি শুরু হলেই কিছু বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে।

নগরীর মতিঝর্ণা, বাটালি হিল, একে খান পাহাড়, ট্যাংকির পাহাড়, আমিন জুট মিলস এলাকা, রউফাবাদ, খুলশী, পাহাড়তলি, ফয়’সলেক, আকবর শাহ, ঝিল-১,২,৩ নম্বর এলাকা, কৈবল্যধাম বিশ্বকলোনী এলাকা, ফিরোজ শাহ, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট এলাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি আছে বলে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে; যদিও ২০১৯ সালে এবং গত বছরও সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর পর বর্ষায় পাহাড় থেকে বসতি উচ্ছেদ কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত ছিল। তবে বৃষ্টি ‍শুরু হলে বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হতো। কিন্তু স্থায়ী উচ্ছেদের দিকে নজর দেয়নি জেলা প্রশাসন। এ অবস্থায় গত দুই বছরে ১৭টি পাহাড়ে অবৈধ বসতির সংখ্যা বেড়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ হয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

পাহাড়সংলগ্ন সড়কগুলোতে চলাচলও এই সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে

এর মধ্যে আরেক বিপত্তি শুরু হয়েছে পাহাড় কেটে তৈরি করা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড নির্মাণ নিয়ে। এই সড়কটি নির্মাণের জন্য সিডিএ ছোট-বড় ১৮টি পাহাড় কেটেছে। এর মধ্যে অন্তত আটটি পাহাড়ে আছে বসতি।

জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিডিএর কেটে ফেলা পাহাড়সহ এখন মোট ২৫টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি আছে। অতিবৃষ্টিতে ধসের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এসব পাহাড়ে। ঘটতে পারে প্রাণহানিও।

২০০৭ সালে পাহাড় ধসে চট্টগ্রামে বড় ধরনের মর্মান্তিক বিপর্যয় ঘটে। ওই বছরের ১১ জুন নগরীর কুসুমবাগ, কাইচ্যাঘোনা, সেনানিবাসের লেডিস ক্লাব সংলগ্ন লেবুবাগান, বায়েজিদ বোস্তামী, লালখান বাজারের মতিঝর্ণা পাহাপড়সহ সাতটি স্থানে পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়ে মারা যায় শিশু-নারী ও বৃদ্ধসহ সব বয়সের ১২৭ জন। মূলত এরপরই বর্ষা এলে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের শঙ্কা এবং নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকেও বারবার ঘোষণা এলেও গত একযুগেরও বেশি সময়ে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোকে ঝুঁকিমুক্ত এবং অবৈধ বসতিমুক্ত করা যায়নি। বরং পাহাড়ে বসতির সংখ্যা বাড়ছে বলে অভিযোগ আছে।

পাহাড় ধসে ২০০৮ সালে মারা যায় ১২ জন। ২০১১ সালে একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১৭ জন, ২০১২ সালে মারা যায় ২৩ জন। এভাবে প্রতিবছরই পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে।

সবশেষ গত ৬ জুন চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় টানা মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিপাত হয়। এতে পাহাড় ধসের শঙ্কা তৈরি হলে নগরীর কয়েকটি পাহাড় থেকে ৫০টির মতো পরিবারকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে বৃষ্টি থামার পরই তারা আবারও ফিরে গেছে পাহাড়ে।

এ অবস্থায় এ বছরের বর্ষা ঘনিয়ে আসার পর নগরীর বাটালি হিল এলাকায় পাহাড় পরিদর্শনে যান চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসান ও জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রহমান। কর্মস্থলে যোগদানের তিন দিনের মাথায় পাহাড় পরিদর্শনে গিয়ে বিভাগীয় কমিশনার জানান, তিনি পাহাড় রক্ষা ও প্রাণহানি ঠেকাতে সরকারের কাছে নতুন করে একটি প্রস্তাবনা দেবেন।

মঙ্গলবার পাহাড় পরিদর্শন করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার

আগেও এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা দেওয়া হলেও নতুন করে আবার কেন— জানতে চাইলে কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি মাত্র যোগ দিয়েছি। আগের রেকর্ডগুলো দেখব। আমি পাহাড় দেখলাম। আমার একটা মতামত আছে। সেটিও যুক্ত করে প্রস্তাবনা পাঠাব। বিগত সময়ে এসব পাহাড়ে অনেক হতাহত হয়েছে। সেজন্য এবার আমরা বর্ষা আসার আগেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। অনেক ঘর তালাবদ্ধ করে পরিবারগুলোকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’

অবৈধ বসতি উচ্ছেদের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘আমরা তো অবৈধ বসতি বলতে পারি না। এটি নথিপত্রের বিষয়। আগে মালিকানা নির্ধারণ করতে হবে। বিরোধপূর্ণ হলে সে বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেবে। তবে আমরা একটি স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করছি।’

বর্ষা শুরুর আগ মুহূর্তে এই তোড়জোড় নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা কিন্তু তিন রাত ঘুমাইনি। পাহাড়ে যারা বসবাস করছেন, আমরা তাদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েসের সভাপতি শরীফ চৌহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবছর বর্ষা এলেই প্রশাসনের তৎপরতা শুরু হয়। অথচ সারাবছর যদি পাহাড়গুলো সুরক্ষা এবং অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধের দিকে নজর দিত, তাহলে বর্ষায় প্রাণহানি এড়ানো যেত। পাহাড়গুলো যে কেটে ফেলা হচ্ছে, অনেক পাহাড় প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এটা কি প্রশাসনের দৃষ্টির আড়ালে হচ্ছে? সেগুলো বন্ধে প্রশাসন জোরালো পদক্ষেপ নেয় না কেন?’

তিনি বলেন, ‘পাহাড়ের মালিক যারা, তারা কেন তাদের পাহাড় কেটে অবৈধ বসতি স্থাপনের সুযোগ দেবে? এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও প্রশাসনের একশ্রেণির লোকের পৃষ্ঠপোষকতা আছে। তা না হলে অবৈধ স্থাপনায় গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের সংযোগ থাকে কিভাবে? রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা যদি না থাকে, তাহলে এসব পদক্ষেপ লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই হবে না।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট পাহাড় পাহাড় ধস পাহাড় ধসের আশঙ্কা

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর