ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে হুমকির মুখে কুয়াকাটা সৈকত, সুরক্ষার উদ্যোগ নেই
১৩ জুন ২০২১ ০৮:৪২
বরিশাল: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়ছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ। আর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে শ্রীহীন হয়ে পড়ছে সাগরকন্যার কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত। ক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এরই মধ্যে সমুদ্রগর্ভে ভেসে গেছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের শত শত গাছ। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে কুয়াকাটা পাবলিক টয়লেট, জাতীয় উদ্যান, পর্যটন পার্কসহ মসজিদ-মন্দির।
স্থানীয়রা জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সাগরের রুদ্ররোষে হারিয়ে যাচ্ছে কুয়াকাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দফায় দফায় বিধ্বস্ত হয়েছে সৈকত লাগোয়া জাতীয় উদ্যান। ভেসে গেছে অভ্যস্তরীণ ছোট ছোট স্থাপনা। জাতীয় উদ্যানের লেকের ওপর সেতু, ঘাটলা, গোলঘর, শোভাবর্ধনের বাগান, বেঞ্চি, স্থায়ী ছাতা— সবই সাগরে গিলে খেয়েছে। এরই মধ্যে ফয়েজ মিয়ার ফার্মস অ্যান্ড ফার্মস লিমিডেটের সারি সারি নারিকেল বাগান সাগরের বুকে হারিয়ে গেছে। সাগরে আগেই গিলে ফেলেছে সরকারি ডাকবাংলো, এলজিইডির বায়োগ্যাস প্লান্ট। তবে ভাঙন রোধে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় কুয়াকাটার স্থানীয় বাসিন্দাসহ বিনিয়োগকারীরা চরম উৎকণ্ঠায় মধ্যে রয়েছেন।
আর পরিবেশবিদেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও সমুদ্রের তলদেশে পলি জমায় পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এর ফলে সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে। আর বিপর্যস্ত হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। তবে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত স্থায়ী ও টেকসই কোনো পরিকল্পনা বা প্রকল্প নেই। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, এ জন্য তারা প্রকল্প প্রণয়ন করবেন।
সৈকতের বিভিন্ন পর্যটন স্পট ঘুরে দেখা যায়, সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে সাগরের ঢেউয়ের ঝাপটায় সৈকতের গাছের গোড়া থেকে বালু সরে শিকড় বেরিয়ে এসেছে। কোনো রকম দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছু গাছ। সৈকতে বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য গাছের মূল। জোয়ারের সময় ঢেউয়ের আঘাতে বালুতে লুটিয়ে পড়ছে বড় বড় গাছ। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সামুদ্রিক ঢেউয়ের ঝাপটায় ভাঙনের মুখে পড়ে বনাঞ্চল। অমাবস্যা, পূর্ণিমা কিংবা প্রাকৃতিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রতিবছর কিছু কিছু বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
কুয়াকাটার স্থায়ী বাসিন্দা ইসাহাক শেখ বলেন, সাগরের ঢেউয়ের ঝাপটায় সৈকতের বালু ক্ষয় হয়ে বেশকিছু গাছ পালা নষ্ট হয়ে গেছে। এভাবে প্রতিনিয়ত বালু ক্ষয় হলে সৈকতের সৌন্দর্য তো দূরের কথা, সৈকতেরই অস্তত্ব থাকবে না। জরুরিভিত্তিতে সৈকতের বালু ক্ষয় রোধে স্থায়ী পরিকল্পনা নেওয়া উচিত বলে মত দেন ইসাহাকসহ স্থানীয়রা।
দেশের অন্যতম পর্যটন স্পট এই কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। কক্সবাজার সৈকতের মতো বিশাল না হলেও শান্ত সৈকত হিসেবে কুয়াকাটার জনপ্রিয়তাও কম নয়। কিন্তু গত একযুগের ব্যবধানে কুয়াকাটার দর্শনীয় অনেক স্পটই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। স্থানীয় নারকেল বাগানের কথা তুলে ধরে ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সভাপতি ইমতিয়াজ রহমান তুষার বলেন, সৈকতে একসময় সারি সারি নারিকেল বাগান ছিল। গাড়ি পার্কিং, পিকনিক স্পট, পর্যটকদের বিনোদন কেন্দ্র ছিল এ বাগান। কালের বিবর্তনে আজ তা শুধুই স্মৃতি।
প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিরা অবশ্য বলছেন, সৈকতের ক্ষতি ঠেকাতে তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। স্থানী বন বিভাগের কর্মকর্তা মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবদুল কালাম আজাদ যেমন বললেন, কুয়াকাটার পাশাপাশি খাজুরা ও গঙ্গামতি বিটের বেশ ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্মকতার কাছে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা এলে সে অনুযায়ী কাজ করা হবে।
জানতে চাইলে কুয়াকাটা পৌর মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের তাণ্ডব ঠেকানের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড উদ্যোগে সৈকতে বালু ভর্তি জিও টিউব ফেলা হয়। জিও টিউব থাকায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাব সত্ত্বেও সৈকত কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছে।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতকে রক্ষা করতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়া সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হালিম ছালেহী। তিনি বলেন, সৈকতে পূর্বসতর্কতার অংশ হিসেবে বালু ভর্তি জিও টিউব ফেলা হয়েছিল। সৈকত রক্ষা প্রকল্পের এ কার্যক্রম চলছে। তবে এভাবে স্থায়ীভাবে সৈকতকে রক্ষা করা সম্ভব না। স্থায়ী সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকল্প আকারে প্রস্তাবনা দেওয়া হবে।
সারাবাংলা/টিআর
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটা (টোয়াক) পানি উন্নয়ন বোর্ড