৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৩৫১ কোটি টাকা
১৫ জুন ২০২১ ২২:৪৫
ঢাকা: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণজনিত মহামারির কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলেও ব্যাংকের ঋণমান পরিবর্তন করা যাবে না— এমন নিষেধাজ্ঞার পরও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। গত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসেই ব্যাংকগুলোতে এই খেলাপি বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সবশেষ গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত শেষে দেশের ৫৯টি ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে শ্রেণিকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার ৮৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এই পরিমাণ মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। আর এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন মাস আগের তুলনায় ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা বেশি।
মঙ্গলবার (১৫ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত সবশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতি তিন মাস পর পর এই তথ্য প্রকাশ করে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে ঋণখেলাপিদের বেশকিছু সুবিধা দেওয়ার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়েনি। তবে এ বছর সেসব সুবিধা বহাল না থাকার কারণে ঋণ বাড়তে শুরু করেছে।
সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয়। এতে করে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। এই সংকট মোকাবিলায় ঋণখেলাপিদের বেশ কিছু সুবিধা দেয় সরকার। এসব সুবিধার মধ্যে ছিল— ২০২০ সালের বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি না দিলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।
পরে ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করা হয়। সার্কুলারে বলা হয়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের কোনো কিস্তি পরিশোধ না করলেও ঋণগ্রহীতা খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবেন না। এ সময়ের মধ্যে ঋণ বা বিনিয়োগের ওপর কোনোরকম দণ্ড, সুদ বা অতিরিক্ত ফি (যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন) আরোপ করা যাবে না। এসব কারণে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণ বাড়েনি। কিন্তু চলতি বছর এ সুবিধা রাখা হয়নি বলেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
তবে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, খেলাপি সবসময় ঋণের কিস্তির ওপর নির্ভর করে না। বিভিন্ন কারণে, বিশেষ করে পেমেন্টের ওপর নির্ভর করেও খেলাপি ঋণ বাড়তে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের এই তথ্য নিয়ে অবশ্য সংশয় প্রকাশ করছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি মনে করছেন, খেলাপি ঋণের প্রকৃত অঙ্ক আরও অনেক বেশি।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিচ্ছে, প্রকৃত অঙ্ক দুই থেকে আড়াই গুণ বেশি। এ ধরনের অর্থহীন তথ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করছে।
তিনি আরও বলেন, ঋণ আদায় না করে এবং ঋণ খেলাপিদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী মজা পাচ্ছে, সেটি আমার বোধগম্য নয়।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। ওই অঙ্ক ছিল মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
এর মধ্যে গত ৩১ মার্চের তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১১ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। আর এই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ৮৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকায়।
এই হিসাবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) ব্যাংকগুলো ১৮ হাজার ৮৮৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। আর একই সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন বিতরণ করা ঋণের এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ আকারে বেড়েছে।
এর আগে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সেটি ছিল বিতরণ করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর গত বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ।
এর আগে ২০২০ সালের মার্চ মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ১২২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৪৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, বেসরকারি ব্যাংকের ৪৫ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংকে খেলাপি ৪ হাজার ৮৬ কোটি টাকা ও বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি রয়েছে ২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ কমাতে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড়, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে, ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরের জন্য ঋণ পরিশোধের মতো নানা সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও খেলাপি ঋণ বাড়ছে।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর