Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঠিকানাহীন মানুষগুলোর ঠাঁই হচ্ছে এই স্বপ্ননগরে


২১ জুন ২০২১ ১৯:১৫

প্রিয় লেখক মানিক বন্দোপাধ্যায়। অনেকের মতে, কিংবা তর্ক সাপেক্ষে, মানিক শুধুমাত্র গদ্যকার হিসেবে নজরুল-রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড়। ফ্যান্টাসির বাইরে জীবনঘনিষ্ঠতার বলেই তিনি শক্তিশালী। তার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজেক্ট- পদ্মা নদীর মাঝি, সুন্দরতম স্বপ্ন ময়নাদ্বীপ। শ্বাপদসংকুল ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার করে দ্বীপ কিনে তার চেনা মানুষগুলোকে একত্র করেছেন ময়নাদ্বীপের বাসিন্দা হিসেবে। প্রজেক্টের অংশ হিসেবে মানিক তৈরি করেছেন হোসেন মিয়া, কুবের মাঝি, কপিলার মত চরিত্র। যাদের পূর্ণতা পেয়েছে ঐ ময়নাদ্বীপকে কেন্দ্র করে, ময়নাদ্বীপে গিয়ে। একটি পরিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন পদ্মা নদীর মাঝিতে।

বিজ্ঞাপন

জীবন সাহিত্যের মলাটের সুন্দরতম গল্প নয়। অধিকন্তু সাহিত্যই দিনশেষে নিয়তির হাতে সঁপে দেওয়া যাপিত অপূর্ণাঙ্গ মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি।

কাকতালীয়ভাবে, জীবনকালে দেখা সুন্দরতম একটি গদ্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য হল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরগুলো করতে গিয়ে। ছোট আলফাডাঙ্গা উপজেলায় ৬০০টি ঘর এনে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক স্যার, জুন মাস নাগাদ শেষ হয়ে যাবে ৫০০ ঘরের কাজ, মাটিভরাট ও স্থিতিকরণহেতু বাকি কাজ জুলাই মাস নাগাদ শেষ হবে বলে আশা করা যায়। সবগুলো ঘর করতে গিয়ে উপজেলা প্রশাসন উদ্ধার করেছে পঞ্চাশ একরের অধিক বেহাত হয়ে যাওয়া সরকারি খাস জমি।

যা হোক, মোট ৬০০ ঘরের মধ্যে ২০০ ঘর নিয়ে গোপালপুর ইউনিয়নের চরকাতলাসুর গ্রামে একইস্থানে গড়ে তোলা হচ্ছে প্রজেক্ট ‘স্বপ্ননগর, ৭০০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যেই থাকবে আরও ৫০টি ঘর। এই ২৫০ ঘর নির্মাণ করা আমাদের দায়িত্ব, এটি হয়ত সবাই করে। ঘর তৈরি বাদে বাকি সব কর্মযজ্ঞে আমরা সাহিত্যকথার ছোটখাট চরিত্র।

একদম শুরুর দিকে মোটামুটি হত্যা হুমকি মাথায় নিয়ে ৩১ একর খাস জমি উদ্ধার। এই কাজ খুব কঠিন। ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, মানুষ তার বাপের সম্পত্তি হারানোর ব্যথার চেয়ে বাপ হারানোর ব্যথা দ্রুত ভুলে যায়। আমার মনে হয়েছে, কেউ কোনোভাবে সরকারি সম্পত্তি হস্তগত করলে তা বাপের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে। এই উদ্ধারকৃত সম্পত্তির ঝোঁপঝাড় কেটে ঘরের কাজ শুরু।

এখানে ঘর করলেও সে অর্থে জায়গাটি প্রতিষ্ঠিত গ্রোথ সেন্টার নয়। আর এখানেই আসলে কাজ করার সুযোগ। ২০০ টি পরিবারের মধ্যে ১৭০টির মত মুসলিম পরিবারের জন্য প্রয়োজন মসজিদ-ইদগা । ৩০টি সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের জন্য প্রয়োজন প্রার্থনাগৃহ। আশেপাশে নেই কোনো উচ্চ বিদ্যালয়, কিছু দূরে রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাজার ৩ কিলোমিটার দূরে। নতুন বাসিন্দাদের দরকার নাগরিক সুযোগ সুবিধা। শিশুদের দরকার খেলারমাঠ। তাই প্রয়োজন সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা।

বিজ্ঞাপন

তবে এটি পরিকল্পনা বা ভবিষ্যতচিন্তা হিসেবে সীমাবদ্ধ নেই। এরইমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ১৬ শতাংশ জমিজুড়ে মসজিদ ও ইদগা। ৮ শতাংশ জমির বাউন্ডারি রেখে নির্মাণ করা হয়েছে মন্দির। ১.৫ একর জমিজূড়ে স্থাপন করা হয়েছে বাজার, চান্দিনা ভিটির কাজ চলছে। ২ একর জমি রাখা হয়েছে স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য। এগুলোর ভূমি উন্নয়নের কাজ চলমান। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার নিমিত্ত কমিউনিটি ক্লিনিক এর জন্য ৮ শতাংশ জায়গা আলাদা করে ভূমি উন্নয়ন করে রাখা হয়েছে। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয় হওয়ায় কিছুটা সময় লাগবে হয়ত। অদূরে ৯ একর জমি জুড়ে কাজ শুরু হচ্ছে নানা প্রজাতির দেশীয় গাছপালা রোপনের মাধ্যমে ইকোপার্ক। সবকিছুর পর যেখানে যেতে হবে, সেই কবর স্থানের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ শতাংশ জমি। কমিউনিটি ক্লিনিকবাদে বাকি সব কিছুর কাজ শেষ হবে জুলাই মাসের মধ্যেই। ২৮টি গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ শেষ হবে ১৫ই জুনের মধ্যে। নির্মাণকৃত সবগুলো ঘরের বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে এ মাসের মধ্যেই। ঘরবাদে বাদবাকি সব পরিকল্পনার অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান।

স্বপনগরের আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বেদখলকৃত খাস জমির প্রাচুর্য থাকায় ২০০ টি পরিবারের মধ্যে ১৫০ পরিবার পাচ্ছে তিন শতাংশ করে জমি। বাকিরাও ঘরসহ দুই শতাংশ জমির পাশে পাবে ব্যবহারযোগ্য কমন স্পেস, যাতে তারা করে নেবে হাঁসমুরগী গরুছাগল এর ক্ষুদ্র খামার ও অল্প বিস্তর মৌসুমী সবজীর চাষবাস করার সুযোগ। প্রকল্প ঘিরে থাকছে প্রশস্ত চলাচলের রাস্তা। আপাতদৃষ্টিতে উপজেলা পর্যায় হতে যা যা করা সম্ভব সবই শেষ হবে জুলাই মাসের মধ্যে।

মধুমতির নদীভাঙনের কবলে নিঃস্ব হওয়া কিংবা স্থায়ী ঠিকানাহীন মানুষগুলোর ঠাঁই হচ্ছে এ স্বপ্ননগরে।

মানিক ময়নাদ্বীপের শেষ দেখাননি। একেকটি সমাজ ও সভ্যতার শেষ কথা বলে কিছু নেই। ভাঙাগড়ায় এর নিয়তি। মার্ক্সবাদী দৃষ্টিতে দেখলে মানিক হয়ত সফল হননি, তিনি ময়নাদ্বীপকে দেখিয়েছিলেন কুবেরের চোখে, যেখানে হোসেন মিয়া সামন্তপ্রভু। আবার হয়ত তিনি সফল, প্রাণহীনের মাঝেও প্রাণের সূচনারেখা তিনি দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন ব্যাক্তিপ্রচেষ্ঠা সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে না, কিন্তু শুরুর বাঁশি তো বাজাতেই পারে। ধনঞ্জয়, গনেশ, আমিনুদ্দি, রাসু, পীতম মাঝি, বশির এনায়েত এদের কেউ কেউ, আবার এদের বাইরেও অনেকেই ময়নাদ্বীপে গিয়েছিল। কেউ কেউ পালিয়েছেন, আবার মানিক নিজেই ময়নাদ্বীপ হতে বের করে দিয়েছেন অনেককে।

প্রজেক্ট স্বপ্ননগরের গদ্যটি লিখেছেন জেলা প্রশাসক স্যার। স্বপ্ননগর নামটিও তার দেওয়া। আমরা কেউ কেউ তার দু একটি চরিত্র, যাদের স্যারের গল্পের প্লটের প্রয়োজনে কিছু কিছু ভূমিকা আছে। মানিকের গল্পে হোসেন মিয়া, কুবিরের পরিবর্তে রহিম মিয়া বা যে কাউকে বসালেও গল্পের ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই। উপন্যাসিক যেভাবে চাইবেন সেভাবেই এগুবে তার প্লটের চরিত্রগুলো।

আরও পড়ুন:  ঘোড়াঘাটের মতো পরিণতি হবে, আলফাডাঙ্গার ইউএনওকে হুমকি

আমার ধারণা এই স্বপ্ননগর সফল হবে, হয়ত কখনো ভাঙবে- আবার সময় তার নিজ প্রয়োজনেই অনেকদূর এগিয়ে নেবে। ইচ্ছে আছে, যদি বেঁচে থাকি, যেখানেই থাকি- দুচার বছর পর পর হয়ত লুকিয়ে দেখে যাব। হিসেব করে দেখব, কতটুকু শোরগোল বেড়েছে স্বপ্ননগরে, কয়টি নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে, আর স্বপ্ননগরের ওই গোরস্থানের স্থায়ী বাসিন্দাই বা হয়েছে কজন?

লেখক: উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর

সারাবাংলা/একে

আলফাডাঙ্গা প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্প

বিজ্ঞাপন

খেজুর আমদানিতে শুল্ক কমলো
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২১:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর