বর্ষার উৎসবে অপরূপা বাংলা
২৭ জুন ২০২১ ০২:৩৩
প্রাণ-প্রকৃতির ঐশ্বর্যমণ্ডিত এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। বাংলার পাহাড়, নদী, সমুদ্র, সমতলে ষড়ঋতুর আগমন যেন প্রকৃতিরই এক অপূর্ব খেলা। বৈচিত্রময় বাংলার প্রকৃতিতে প্রতিটি ঋতুর আলাদা আলাদা সৌন্দর্য থাকলেও বর্ষা আবির্ভূত হয় মেঘ-বৃষ্টির খেলায় এক অনাবিল সৌন্দর্য, রূপ- মাধুর্য ও আশির্বাদের ঝুড়ি নিয়ে। বর্ষার আগমন উৎসবে মেতে উঠে বংলার জনপদ। তাইতো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায় লিখেছেন-
“আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।”
অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক বর্ষার রঙ-রূপের প্রেমে পড়ে এর স্রোতস্বিনী ধারায় ভাসিয়ে দিয়েছেন তাঁদের শিল্প-সাহিত্যের ময়ূরপঙ্খী তরী। কবি-সাহিত্যিকদের গল্প, উপন্যাস, কবিতায় উঠে এসেছে বাংলায় বর্ষার নানা বৈচিত্রময় রূপ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘আষাঢ়’ কবিতায় বর্ষাকালে গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন এভাবে-
“নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্ চাহিরে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।”
পল্লীকবি জসীম উদদীন তাঁর ‘পল্লী-বর্ষা’ কবিতায় পল্লী প্রকৃতিতে বর্ষার এক অনবদ্য ছবি এঁকেছেন। তাঁর ভাষায়-
“আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে,
কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।
কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা
তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া!”
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘বর্ষা-বিদায়’ কবিতায় বর্ষাকে ‘বাদলের পরী’, ‘কাজল-মেয়ে’, ‘জলের দেশের কন্যা’ রূপে অভিহিত করে বর্ষা বিদায়ের বিরহ গাঁথা লিখে গেছেন এভাবে-
“ওগো বাদলের পরী!
যাবে কোন্ দূরে, ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী!
ওগো ও ক্ষণিকা, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজ তব?
পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন্ দেশ অভিনব?
……………………………………………।
ওগো ও কাজল মেয়ে,
উদাস আকাশ ছলছল চোখ তব মুখে আছে চেয়ে।
কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে
তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।”
অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত পলিমাটির এই ভূমিতে বর্ষাকাল আশির্বাদ স্বরূপ। এ সময়ে অপরূপ সাজে সজ্জিত হয় গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি। খাল-বিল-নদী-নালা ভরে উঠে কানায় কানায়। নৌকা হয়ে উঠে মানুষের নিত্যদিনের বাহন। শাপলা-পদ্ম-কলমিফুলে ছেয়ে যায় বিল-ঝিল। গাঢ় সবুজের মোহনীয় এক নিগূঢ়তায় যেন প্রাণ ফিরে পায় বন-বনানী। কেয়া, কামিনী, হিজল, তমাল, জারুল, বকুল, সোনালু, করবীসহ নানা বন্য ফুলে শোভিত হয় চারপাশ। বৃষ্টিভেজা কদম ফুলের মনকাড়া সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ ধরতে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে গ্রামগুলো। টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ মনের গহীনে এক অদ্ভুত উদাসী ছন্দের সূচনা করে। গ্রামীণ জনজীবনে বর্ষা যেন এক অখন্ড অবসর। গ্রামের মানুষেরা এ সময় গল্প-গুজব ও লুডু-চৌপাতিসহ নানা ধরণের গ্রামীণ খেলায় অলস সময় পার করে। কর্দমাক্ত মাঠে দামাল ছেলেদের ফুটবল, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুটসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খেলা বর্ষার আনন্দ বাড়িয়ে দেয় অনেকগুণ।
শহুরে ব্যস্ত জীবনে বর্ষার রূপ-বৈচিত্র খুব একটা অনুভব করার সুযোগ না থাকলেও রৌদ্রতপ্ত পিচঢালা ব্যস্ত সড়কে বৃষ্টি নামলে এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন। রাস্তার পাশের ধুলোজমা গাছগুলো হয়ে ওঠে সবুজ-সতেজ। খিচুড়ি আর মাংসভুনা খাওয়ার মাধ্যমে বর্ষা উদযাপন করে শহরের মানুষ।
আবহমানকাল ধরেই বাংলার প্রকৃতিতে বারবার ফিরে আসে চিরযৌবনা স্বর্গীয় অপ্সরা ‘বর্ষা’। এক রহস্যময় প্রাণের স্পন্দনে জেগে ওঠে প্রকৃতি। এই প্রাণস্পন্দন মানুষের মাঝে এক অকৃত্রিম আবেগ ছড়িয়ে দোলা দেয় মনের দুয়ারে। কবি জসীম উদ্দীন এর ভাষায়-
“আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে,
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।”
করোনা মহামারীর এই দুর্যোগকালীন সময়ে বর্ষাকাল হয়তো বাংলার মানুষের মনে সেই হৃদয়স্পর্শী আবেগ-অনুভূতি জন্মাতে পারবে না। তবুও প্রকৃতির অমোঘ আহবানে পৃথিবীতে নতুন প্রাণের মঙলবার্তা নিয়ে বর্ষা আসবেই। এই বর্ষার শুদ্ধ স্নানে বিতাড়িত হোক অকোষীয় জীবাণু করোনা, মুক্ত হোক ধরণী, ভালবাসা আর আবেগ-অনুভূতিতে ভরে উঠুক জীবন, করুণাময় স্রষ্টার কাছে এমনটাই প্রার্থনা আমাদের।
লেখকঃ গবেষক, পরিবেশ বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসএসএস