মিরপুরে সরকারি ফ্ল্যাট নির্মাণে নানা অনিয়ম
৩ জুলাই ২০২১ ১৩:০৯
ঢাকা: মিরপুরে সরকারি ভবন নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় আইন মেনে দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। এমনটি অনুমোদিত ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) বাইরেও করা হয়েছে কাজ। ‘ঢাকার মিরপুরে ৯ নং সেকশনে ১৫টি ১৪ তলা বিশিষ্ট আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন অনিয়ম হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইএমইডি’র সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে চিত্র উঠে এসেছে সেটিই আমরা তুলে ধরেছি। দু’একদিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ প্রতিবেদন পাঠানো হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে।’
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিকল্পিত উপায়ে অল্প জমির উপর সর্বাধিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত অত্যাধুনিক আবাসিক ভবন নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরিতে তীব্র আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ঢাকার মিরপুরস্থ ৯ নং সেকশনে ১৫টি ১৪ তলা বিশিষ্ট আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পটি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। প্রকল্পটি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে ৯৩৬ কোটি ৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের জানুয়ারি হতে চলতি বছরের ডিসেম্বর (প্রস্তাবিত) মেয়াদে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপিভুক্ত) উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে চলমান প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ এবং সমাপ্ত প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন সমীক্ষা কাজ সম্পন্ন করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে এই প্রকল্পটি নিবিড় পরিবীক্ষনেনর জন্য বাছাই করা হয়েছে এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইউনিকনসাল্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জানুয়ারি হতে ২০২০ সালের জুনে বাস্তবায়নের জন্য ৯৩৬ কোটি ৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন হয়েছে। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া ২০১৭ সালের জানুয়ারি হতে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং পুনরায় চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে । প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত মোট ৩ জন প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রকল্প অঞ্চল অধিকতর নিচু হওয়ার কারণে প্রায় ১০ থেকে ১৫ ফুট আর্থ-ফিলিংয়ের মাধ্যমে মাটি ভরাট করে নির্মাণ কাজ শুরু করতে প্রায় ৪ থেকে ৫ মাস সময় পার হয়েছে, প্রকল্প এলাকায় ভূমি দখল করতে প্রায় ৩ থেকে ৪ মাস সময় অতিবাহিত হয়েছে এবং বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে প্রায় ৫ থেকে ৬ মাস কাজ বন্ধ ছিল।
প্রকল্পের আওতায় অনুমোদিত অংশ গুলোর বছর ভিত্তিক কর্ম-পরিকল্পনা ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) থাকলেও গত অর্থ বছরগুলোতে সময়ভিক্তিক কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করা হয়নি। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পের আওতায় ১৫টি ১৪ তলা বিশিষ্ট ভবনে সর্বমোট ১ হাজার ৫৬০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে তবে কোনো ভবনের কাজ পুরোপুরিভাবে সম্পন্ন হয়নি। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি গড়ে ৫৫ শতাংশ এবং চলতি বছরের মে পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি ৪২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ যা সন্তোষজনক নয়।
পণ্য ও কার্য ক্রয় ডিপিপি এবং সরকারি ক্রয় বিধি নীতিমালা ( পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এ্যাক্ট-২০০৬ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস ২০০৮) অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয়েছে কিনা সমীক্ষাকালীন তা যাচাই করা হয়েছে। দেখা যায় যে, ডিপিপিতে সংযুক্ত ক্রয় পরিকল্পনার সাথে মিল রেখে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা তৈরি করা হয়নি। এছাড়াও পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে দরপত্র অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে ব্যতয় ঘটেছে। যেখানে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০০৮ এর ব্যত্যয় করা হয়েছে। পণ্য ক্রয়ের ৬টি প্যাকেজের মধ্যে মাত্র একটি প্যাকেজ এর দরপত্র আহবান করা হয়েছে এবং অন্য একটি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান ছাড়া ৪টি কম্পিউটার ক্রয় করা হয়েছে। জিডি-০২ প্যাকেজের আওতায় ২টি মোটরসাইকেল এবং একটি জিপ গাড়ি ক্রয় করা হয়েছে। কার্যক্রয়ের ২০টি প্যাকেজের মধ্যে ১১টি প্যাকেজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু প্যাকেজ নং ডব্লিউডি-৩ থেকে ডাব্লিউ-১১ পর্যন্ত ৯টি প্যাকেজ ডিপিপি অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। এক্ষেত্রে প্যাকেজ নাম্বার পরিবর্তন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে যেখানে ডিপিপির ব্যত্যয় হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থ বছরের একটি অডিট আপত্তির বিপরীতে এখনো ত্রি-পক্ষীয় অডিট সভা হয়নি এবং অডিট আপত্তিটি নিষ্পত্তি হয়নি। অর্থ-বছর ২০১৭-১৮ সালে ৪টি অডিট আপত্তির বিপরীতে ৩টি অডিট আপত্তি বিষয়ে ত্রি-পক্ষীয় অডিট সভায় নিষ্পত্তির জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় ডিপিপি এব পরিপত্র অনুযায়ী নিয়মিত পিআইসি ও পিএসসি সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মোট ৬টি পিআইসি সভা এবং ৪টি পিএসসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় চলমান কাজে ব্যবহৃত নির্মাণ উপকরণের প্রতিটি ল্যাব টেস্ট বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা হয়েছে এবং প্রতিটি ল্যাব টেস্টের ফলাফল সন্তোষজনক পাওয়া গেছে। কিন্তু সরেজমিন ১১.১৬, ১৭, ১৮ ও ২৪ নং ভবনে ব্যবহৃত ইটের মান সন্তোষজনক পাওয়া যায়নি। চলমান কাজে একেক ভবনে একেক ধরনের রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে যেমন ভবন নং ১৭তে হাই-টিস রেইনফোর্সেসমেন্ট আবার অন্য ভবনে এমসবিআরএম রেইনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করা হচ্ছে যেগুলো বাজারের শীর্ষস্থানীয় কোনো রেইনফোর্সমেন্ট নয়। ভবনের ফলস স্ল্যাব ও লিন্টেলের ঢালাই কাজে ব্যবহৃত পাথরগুলো মানসম্মত নয়।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের উদ্দেশ্য স্বল্প ও মধ্যম আয়ের জনগণকে উন্নত জীবন যাবনের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় আধুনিক সুবিধা সরবরাহ করা ব্যহত হচ্ছে বলে ধারণা করা যায়। এখন পর্যন্ত ভূমিউন্নয়নের কাজ সম্পন্ন হয়নি, ১৫টি ভবনের মধ্যে একটি ভবনের কাজও শেষ হয়নি, রাস্তা উন্নয়নের কাজ শুরু করা হয়নি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজও শুরু করা হয়নি। এছাড়াও গভীর নলকূপ স্থাপন ও সীমানা প্রাচীরের কাজ শুরু করা হয়নি। অর্থাৎ ডিপিপিতে উল্লিখিত লগ ফ্রেম অনুযায়ী প্রকল্পের আউটপুট অর্জন খুবই কম।
আইএমইডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাজের তদারকি বৃদ্ধি করা, প্রত্যেক নির্মাণাকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের নির্মাণাধীন ভবন গুলোর জন্য আলাদা আলাদা কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করবে যা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা যাচাই এবং অনুমোদন করবে, প্রকল্পের কর্ম পরিবেশ বজায় রেখে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কর্তৃপক্ষের তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে।
নির্মাণকাজে ইটের গুণগত মান বজায় রক্ষায় স্বীকৃত ল্যাবরেটরি থেকে ল্যাব টেস্ট করে ইট ব্যবহার করতে হবে, ইউরোপীয়ান লিফট গুলোর স্পেসিফিকেশন এবং আমদানি প্রসেসের ব্যাপারে এখন থেকেই তদারকি করা, প্রত্যেক ঢালাই কাজ শেষ হওয়ার পর সেটির ডিজিটাল স্থিরচিত্র ধারণ করে একটি ডাটাবেজ তৈরি করা, অবিলম্বে ১৯ নম্বর ভবনের জন্য ফের দরপত্র আহ্বান করা এবং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রাকযোগ্যতা যাচাই করা, মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের থেকে তথ্য নিয়ে প্রস্তাবিত আরডিপিপিতে এসটিপি, ডব্লিউটিপি স্থাপনের জন্য সংস্থান রাখা, ভবিষ্যতে প্রকল্পের আওতায় পন্য ও কার্যক্রয়ের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস ২০০৮ এর বিধিমালা অনুসরণ করা, পরিমাপ মান দন্ড আইন ২০১৮ অনুযায়ী প্রকল্পের ড্রইং ডিজাইন মেট্রিক পদ্ধতিতে করার জন্য মন্ত্রণালয় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ভবিষ্যতে প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধনছাড়া ব্যয় ও অযৌক্তিক খরচ গুলোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নজরদারি বাড়াতে হবে।
সারাবাংলা/জেজে/একে