১৫ হাজার ছাড়াল মৃত্যু, শেষ ৮ দিনেই ১ হাজার ১২ জন
৪ জুলাই ২০২১ ২১:১৫
ঢাকা: ২০২০ সালের ১৮ মার্চ। দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার ১০ দিন পর এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যু ঘটে সেদিন। এরপর পেরিয়ে গেছে আরও ৪৭৪ দিন। অর্থাৎ দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের ৪৮৪তম দিনে এসে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণহানি ছাড়িয়ে গেল ১৫ হাজার। আশঙ্কার কথা হলো— এর মধ্যে শেষ হাজার মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে মাত্র আট দিন সময়ের মধ্যে! এই আট দিনে দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন এক হাজার ১২ জন।
রোববার (৪ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে ১৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতেই দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে প্রাণহানি দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৬৫ জনে। আর একদিনে ১৫৩ জনের মৃত্যু এখন পর্যন্ত দেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত ২৬ জুন দেশে করোনায় মৃত্যু পেরিয়ে গিয়েছিল ১৪ হাজার। তার ঠিক ৮ দিনের মাথায় ৪ জুলাই এসে সেই সংখ্যা পেরিয়ে গেল ১৫ হাজার। এত কম দিনে করোনায় হাজার মৃত্যুর সাক্ষী বাংলাদেশ আর কখনো হয়নি। এর আগে গত ১৫ এপ্রিলের পর ১০ দিনে হাজার করোনায় এক হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- সব রেকর্ড ভেঙে একদিনে মৃত্যু ছাড়াল দেড়শ
যেভাবে ১৫ হাজার মৃত্যু
দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। সেদিন একজনের মৃত্যুর তথ্য জানানো হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিংয়ে। প্রায় একমাস পর ১৫ এপ্রিল করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা স্পর্শ করে ৫০-এর ঘর। ২০ এপ্রিল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১০১ জন। একমাস পাঁচ দিন পর ২৫ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় পাঁচশ। ১৫ দিনের মাথায় ১০ জুন এই সংখ্যা স্পর্শ করে হাজারের ঘর। সে হিসাবে দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের ৯৫ দিনে করোনায় মৃত্যু স্পর্শ করে হাজারের ঘর।
এর ২৫ দিনের মধ্যেই আরও একহাজার মৃত্যুর কারণ হয় কোভিড-১৯। ৫ জুলাই দুই হাজার ছাড়িয়ে যায় মৃত্যু। এর পরের এক হাজার মৃত্যু হয় আরও দ্রুত— মাত্র ২৩ দিনে। ২৮ জুলাই তিন হাজারের ঘর ছাড়িয়ে যায় করোনায় মৃত্যু। দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম হাজার মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে সময় লাগে ২৮ দিন করে। ২৫ আগস্ট চার হাজার ও ২২ সেপ্টেম্বর পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায় মৃত্যু। এরপর করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর গতি সামান্য কমে যায়।
২২ সেপ্টেম্বরের ৪৩ দিন পর ৪ নভেম্বর ছয় হাজার, এর ৩৮ দিন পর ১২ ডিসেম্বর সাত হাজার এবং এর ৪২ দিন পর ২৩ জানুয়ারি করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু পেরিয়ে যায় আট হাজারের ঘর। এরপর করোনায় মৃত্যুর গতিতে লাগাম ধরানো সম্ভব হয়। আট হাজারের পর ৯ হাজারের ঘরে যেতে সময় লাগে দুই মাসেরও বেশি— ৬৭ দিন। এ বছরের ৩১ মার্চ দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা পেরিয়ে যায় ৯ হাজার।
আরও পড়ুন- দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শনাক্ত ৮৬৬১, সংক্রমণের হার তৃতীয় সর্বোচ্চ
এপ্রিলে এসে করোনায় মৃত্যু সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করে। এই মাসেই একদিনে ওই সময়কার সর্বোচ্চ ১১২ জনের মৃত্যুও দেখেছে বাংলাদেশ। তাতে এপ্রিলের প্রথম ২৫ দিনেই করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু হয় দুই হাজার ৭ জনের। ২৫ এপ্রিল করোনায় মোট মৃত্যু ছাড়িয়ে যায় ১১ হাজার। এর ১৬ দিন পরে অর্থাৎ ১১ মে মৃত্যু ছাড়ায় ১২ হাজারের ঘর।
একমাস পর গত ১১ জুন দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ১৩ হাজার। এর পরের হাজার মৃত্যুতে সময় লাগে ১৫ দিন। গত ২৬ জুন দেশে করোনায় মৃত্যুর মোট সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ১৪ হাজার। এর ঠিক আট দিন পরেই দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়াল ১৫ হাজার। এই আট দিনের প্রতিদিনই করোনায় শতাধিক ব্যক্তি মারা গেছেন। এর মধ্যেই সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় একদিনে সর্বোচ্চ ১৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ যে ১১২ জন মৃত্যুর রেকর্ড, তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে এই আট দিনের ছয় দিনেই!
২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মৃত্যু যে পাঁচ দিনে
২০২১ সালের ৪ জুলাই: এদিন দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে ১৫৩ জন মারা যান। এটি দেশে এখন পর্যন্ত একদিনে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মারা যাওয়ার সর্বোচ্চ পরিসংখ্যান।
২০২১ সালের ১ জুলাই: এদিন দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে ১৪৩ জন মারা যান। এটি দেশে এখন পর্যন্ত একদিনে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মারা যাওয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিসংখ্যান।
২০২১ সালের ৩ জুলাই: এদিন দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে ১৩৪ জন মারা যান। এটি দেশে এখন পর্যন্ত এক দিনে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মারা যাওয়ার তৃতীয় সর্বোচ্চ পরিসংখ্যান।
২০২১ সালের ২ জুলাই: এদিন দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে ১৩২ জন মৃত্যুবরণ করেন। যা দেশে এখন পর্যন্ত এক দিনে কোভিড-১০ সংক্রমণ নিয়ে মারা যাওয়ার চতুর্থ সর্বোচ্চ পরিসংখ্যান।
২০২১ সালের ২৭ জুন: এদিন দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে মারা যান ১১৯ জন। যা দেশে এখন পর্যন্ত এক দিনে কোভিড-১০ সংক্রমণ নিয়ে মারা যাওয়ার পঞ্চম সর্বোচ্চ পরিসংখ্যান।
করোনায় মৃত ১০ জনের সাত জনই পুরুষ
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত্যুবরণকারী ১৫৩ জনের ৯৬ জন পুরুষ, ৫৭ জন নারী। এ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত মোট ১০ হাজার ৬৭৬ জন পুরুষ ও চার হাজার ৩৮৯ জন নারী করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন। শতাংশ হিসাবে করোনায় মোট মৃত ব্যক্তির ৭০ দশমিক ৮৭ শতাংশ পুরুষ, ২৯ দশমিক ১৩ শতাংশ নারী।
বয়সভিত্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান
গত ২৪ ঘণ্টায় যে ১৫৩ জন করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন, তার মধ্যে ৭০ জনের বয়স ষাটের বেশি, ৪৫ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। এছাড়া ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ২৪ জন ও ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ১১ জন মারা গেছেন। দেশে ০ থেকে ১০ বছর ও ১১ থেকে ২০ বছর বয়সসীমার মাঝে গত ২৪ ঘণ্টায় ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ৩ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে।
গত ২৪ ঘণ্টার মতোই এ পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুবরণকারী ১৫ হাজার ৬৫ জনের অর্ধেকেরই বেশি ষাটোর্ধ্ব। সবচেয়ে কম মৃত্যু হয়েছে নবজাতকসহ অনূর্ধ্ব-১০ বছর বয়সীদের।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত ১৫ হাজার ৬৫ জনের মধ্যে ৮ হাজার ৪২৩ জনই ষাটোর্ধ্ব। অর্থাৎ করোনায় মোট মৃত্যুর ৫৫ দশমিক ৯১ শতাংশই এই বয়সী। এছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৩ হাজার ৬৪৫ জন (২৪ দশমিক ২০ শতাংশ) ও ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী এক হাজার ৭২৪ জন (১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ) মারা গেছেন করোনা সংক্রমণ নিয়ে।
মৃত্যুর হার কম বয়সীদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম। এর মধ্যে নবজাতক থেকে শুরু করে ১০ বছর বয়সীদের মধ্যে মারা গেছে ৫২ জন (শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ), ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী মারা গেছে ৯৮ জন (শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ)। এছাড়া করোনা সংক্রমণ নিয়ে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী ২৮৮ জন (১ দশমিক ৯১ শতাংশ) ও ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী ৮৩৫ জন (৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ) মারা গেছেন।
বিভাগভিত্তিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে সবচাইতে বেশি ৫১ জন মারা গেছে খুলনা বিভাগে। এছাড়া ৪৬ জন মারা গেছেন ঢাকা বিভাগে, ১২ জন মারা গেছেন রাজশাহী বিভাগে। চট্টগ্রাম বিভাগে মারা গেছেন ১৫ জন। সিলেটে বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় ২ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে। বরিশাল বিভাগে ৩ জন মারা গেছে। এছাড়া রংপুর বিভাগে ১৫ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৯ জন মারা গেছে গত ২৪ ঘণ্টায় কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মৃত্যুও ঘটেছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, ঢাকা বিভাগে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন ৭ হাজার ৭২৮ জন, যা মোট মৃত্যুর ৫১ দশমিক ৩০ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুই হাজার ৮১৫ জন জন মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগে। এই বিভাগে মৃত্যুর হার মোট মৃত্যুর ১৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর তৃতীয় সর্বোচ্চ এক হাজার ৪৩৬ জন মারা গেছেন খুলনা বিভাগে, যা মোট মৃত্যুর ৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
এছাড়া রাজশাহী বিভাগে এক হাজার ১১২ জন (৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ), রংপুর বিভাগে ৬৫৭ জন (৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ), সিলেট বিভাগে ৫৩৯ জন (৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ), বরিশাল বিভাগে ৪৩৯ জন (২ দশমিক ৯১ শতাংশ) ও ময়মনসিংহ বিভাগে মারা গেছেন ৩৩৯ জন (২ দশমিক ২৫ শতাংশ)।
এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী
চলমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যায় সম্প্রতি ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। তবে এই সময়ে কিন্তু সংক্রমণও অনেক বেড়েছে।
তিনি বলেন, সংক্রমণ বাড়লেই বয়স্ক মানুষদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়বে। যারা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত, তাদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। আর বয়স্ক এবং এ ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলে বরং মৃত্যুর হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে।
ডা. আলমগীর আরও বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকলে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো ব্যক্তি সচেতনতা। সরকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু ব্যক্তি যদি সচেতন হয়ে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে সহযোগিতা না করে, তবে বিপদ বাড়বে। কারণ একজন যদি কোনো এলাকায় সংক্রমিত হয়ে থাকেন তবে তিনি তার পরিবার, সমাজে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। আর মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচেতন থাকতে হবে। একইসঙ্গে অবশ্যই মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর