শিশুদের কোডিং শেখাচ্ছে ই-স্কুল অব লাইফ
৫ জুলাই ২০২১ ২২:৪৩
ঢাকা: করোনা মহামারির থাবায় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও থমকে আছে স্বাভাবিক জীবন। যেন এক অদৃশ্য দানবের নারকীয় তাণ্ডবে ছন্নছাড়া ও বিপন্ন সবকিছু। শারীরিক, মানসিক অসুস্থতায় জর্জরিত প্রায় সকলেই। তবে মহামারির অন্যতম শিকার শিশুরা। স্বাভাবিক ও সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাইরাস প্রতিরোধে নেওয়া নানারকম সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা। যোগাযোগ বন্ধ করাই মারণঘাতি এই ভাইরাস প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। ফলে সমাজের সবচেয়ে সুরক্ষার দাবি যাদের সেই কোমলমতি শিশুদের ‘রিস্ক ফ্রি’ রাখতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। তাও হয়ে গেল দেড় বছরের বেশি। এরমধ্যে আভ্যন্তরীণ ও জাতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় অটোপাশ দিয়ে কোনরকমে দুর্যোগকালীন শিক্ষা কার্যক্রম টিকিয়ে রাখা হয়েছে। শহুরে অনেক শিশুই অনলাইনে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেও বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রম যা তাদের সৃজনশীল বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক। কিন্তু সেটি করতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা অনেকটাই।
যে বয়সে তাদের মাঠ-ঘাট দাপিয়ে বেড়ানোর কথা, সে বয়সে করোনা আতঙ্কে দিন কাটছে ঘরে। বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এক ধরনের বন্দি জীবন যাপন করছে তারা। ফলাফল হিসেবে অনেক শিশুর জীবনই হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। অনেকেই হয়ে পড়ছে ডিভাইস অ্যাডিক্টেড। এমন অবস্থায় তাদের হাতে থাকা ইলেকট্রনিক ডিভাইসটিকে যদি সঠিক পথে চ্যানেলাইজ করা যায় তাহলে শিশুদের মেধাভিত্তিক বিকাশের পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণের পথে এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারি আমরা। আর শিশুদের প্রযুক্তি দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এই অসহনীয় এক পরিবেশে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ‘ই-স্কুল অব লাইফ’ (eSchool of Life)। এই মহামারিকালেও শিশুরা যেন ঘরে বসে প্রযুক্তি শিক্ষার আনন্দ নিতে পারে ও ভবিষ্যতে একজন দক্ষ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে তাই তারা শুরু করেছে শিশুদের জন্য কম্পিউটার শিক্ষা কার্যক্রম। এই কার্যক্রমের আওতায় তারা শিশুদের উপযোগী করে কোডিং, প্রোগ্রামিং সহ কম্পিউটারের নানাবিধ বেসিক শিক্ষা দেবে। শিশু কিশোরদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অভিঘাত মোকাবেলায় উপযোগী করে গড়ার লক্ষ্যে ই-স্কুল অব লাইফ গ্লোবাল লার্নিং ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড এই ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম এর আয়োজন করেছে।
গত ১ জুলাই থেকে ই-স্কুল অব লাইফ এর উদ্যোগে ভার্চুয়ালি কোডিং শিক্ষার কোর্স শুরু হয়েছে। ঢাকা এবং চট্রগ্রামের বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের প্রায় ৩৫টি স্কুল-কলেজ থেকে ৮ থেকে ১৭ বছর বয়সী মোট ৯০ জন শিক্ষার্থী এতে অংশগ্রহণ করে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে শহিদ বীর-উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ, সানিডেল, সানবিমস, ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুল, এসএফএক্স গ্রিন হেরাল্ড স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গভ. ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ওয়ার্ডব্রিজ স্কুল, বিআইটি, স্যার জনসন উইলসন স্কুল, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার, সেন্ট জোসেফ, গ্রিন ডেল, সাউথ ব্রিজ, অ্যাপল ট্রি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ, মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, মিরপুর বাংলা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল, চিটাগং গ্রামার স্কুল, আদমজি ক্যান্ট পাবলিক স্কুল, সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল, এক্সসেল একাডেমি, প্লেপ্যান স্কুল, বিয়াম মডেল স্কুল, তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মাইলস্টোন স্কুল, কর্ডোভা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বনশ্রী আদর্শ বিদ্যানিকেতন এবং ইন্ডিয়ান স্কুল সালালাহ, ওমান ইত্যাদি।
ই-স্কুল অব লাইফের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ঢাকা ইউনিভার্সিটি ফ্রেন্ডস অ্যালায়েন্স (DUFA) এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবু সালেহ বন্ধু সংগঠন ও এলামনাই সংগঠন হিসেবে DUFA’র পরবর্তী প্রজন্মকে ভবিষ্যৎমুখী কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য মূলত এই কোর্স চালু করেন।
আসুন জেনে নেই কোডিং আসলে কি—
কোডিং হচ্ছে মূলত কম্পিউটারের ভাষা যার সাহায্যে নানারকম অ্যাপস, ওয়েবসাইট, এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট করা যায়। কোডিং ছাড়া ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় প্রযুক্তি, আমাদের স্মার্ট ফোন এবং ব্রাউজার উন্নত করা সম্ভব নয়। এককথায় আমরা যেসব প্রযুক্তির উপর নির্ভর করি তা কোডিংয়ের মাধ্যমেই চলে।
কোডিং কোর্স করে শিশুরা যা শিখবে—
শিশুরা কম্পিউটার বিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা পাবে। কোডিংয়ের হাতেখড়ির মাধ্যমে এর মৌলিক ধারণার সাথে পরিচিত হতে পারবে ও বেসিক অ্যানিমেশান করতে সমর্থ হবে। এভাবে এক পর্যায়ে কোডিংয়ের মাধ্যমে তারা একসময় কম্পিউটার গেমও তৈরি করতে সক্ষম হবে। এছাড়াও শিশুরা নিজেদের পোর্টফলিও, ইত্যাদি তৈরি করতে পারবে।
সর্বোপরি কোডিংয়ের পরবর্তী অ্যাডভান্সড লেভেলের কোর্স করে ফ্রিল্যান্সিংয়ে দক্ষ হয়ে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট লেভেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই নিজের টিউশন ফি নিজে আয় করতে পারবে।
কোর্স শুরু হওয়ার পর কোডিং বিষয়ে জানার জন্য শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদের মধ্যেও ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা দেয়। তাই প্রথম সেশানে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অনেক অভিভাবকও অনলাইনে সংযুক্ত ছিলেন।
অভিভাবকদের মধ্যে ডুফার প্রাক্তন মহাসচিব ড. সৈয়দ নেয়ামুল ইসলাম এবং ডুফা সদস্য সৈয়দা তাসলিমা তুহিন তদের শুভেচ্ছা বক্তব্যে ই-স্কুল অব লাইফকে এ ধরনের যুগোপযোগী স্কিল শিক্ষার আয়োজন করার জন্য ধন্যবাদ জানান। এসময় আরও সংযুক্ত ছিলেন ই-স্কুল অব লাইফ-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ মাসুদ এবং অভিভাবকদের মধ্যে আফজাল হোসেন সারোয়ার, মাহমুদুর রহমান মঞ্জু, রফিকউল্লাহ সানা রোমেল, ড. সুস্মিতা দাস, লুনা খান, ইশরাত জাহান শাহানা, জুঁথি জেসমিন আরা ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার আফরোজা, ব্যারিস্টার কামরুন মাহমুদ, সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব কায়সার, শরীফ বাচ্চু, তারেক শমি, ইয়াসিন আহমেদ, আমিনুল ইসলাম ও আমেনা জাহেদ বাণীসহ আরও অনেক ডুফা সদস্য সংযুক্ত ছিলেন।
কোডিং কোর্সটির প্রশিক্ষক হিসেবে রয়েছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (আইইউবি) এর কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইন্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের প্রভাষক রোমাসা কাসেম। তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইন্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে পাস করেন এবং স্বর্ণপদক (গোল্ড মেডেল) অর্জন করেন। এক মাসব্যাপী এই স্ক্র্যাচ/ক্রাশ কোর্সের পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এর সম্পূর্ণ নির্দেশনা অনুসরণ করে। ১২টি অনলাইন লাইভ ইন্টারেক্টিভ (সরাসরি অনলাইন মিথস্ক্রিয়ামূলক) ক্লাসে কোডিংয়ের এই মৌলিক কোর্সটি আগামী আগস্টের ২ তারিখ সম্পন্ন হবে। কোর্স শেষে প্রতিটি প্রশিক্ষণার্থীকে সনদ দেওয়া হবে। তাছাড়া প্রতিটি অংশগ্রহণকারীকে বয়স অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে প্রজেক্ট দেওয়া হবে যার মাধ্যমে তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতার মূল্যায়ন করা হবে।
এ বিষয়ে ই-স্কুল অব লাইফের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ মাসুদ জানান, এই কোর্স নিয়ে তাঁদের একটি রিসার্চ পেপার (গবেষণা পত্র) তৈরি করার ইচ্ছা আছে।
প্রথম সেশানে স্বাগত বক্তব্যে মোহাম্মদ আবু সালেহ বলেন, উন্নত দেশে কোডিং তাদের পাঠ্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কিন্তু আমাদের যেহেতু এখনও শিক্ষাক্রমের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তাই আমাদেরকে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগেই কোডিং শিখতে হবে।
হতাশা ও আশাবাদের সংমিশ্রণে তিনি আরও বলেন, একদিকে ৬ লাখ ৫০ হাজার রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে-এটি যেমন আশার দিক; অপরপক্ষে, হতাশার দিক হচ্ছে – বিআইডিএস-এর ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশে ৩৪% শিক্ষিত বেকার রয়েছে। এছাড়া আমাদের রফতানিমুখী পোশাক শিল্পে অটোমেশনের ফলে লাখ লাখ লোক বেকার হয়ে পড়বে পর্যায়ক্রমে। তাই আমাদের আগামী প্রজন্মকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অভিঘাত সামাল দিতে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের উপযোগী আইসিটি স্কিলস শেখাতে শিশু কিশোরদের জন্য ই-স্কুল অব লাইফ পর্যায়ক্রমে নিয়ে আসবে ডেটা সায়েন্স, ডেটা এনালাইসিস, মেশিন লার্নিং, বিগ ডেটা, প্রোগ্রামিং, ফ্রিল্যান্সিং, ফিনটেক, আইওটি, রোবোটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, অগমেন্টেড রিয়্যালিটিভিত্তিক কোর্স।
উল্লেখ্য, ই-স্কুল অব লাইফ একটি ব্লেন্ডেড লার্নিং (অনলাইন এবং অফলাইন) প্ল্যাটফর্ম যা ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রধানত পেশাগত দক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়ে কর্পোরেট ট্রেনিং দিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি বহু বহুজাতিক, সরকারি ও বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই প্রথম শিক্ষা প্রযুক্তি (Edtech) স্টার্টআপ হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানটি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অংশীদার হতে শিশু কিশোরদের জন্য নিয়ে এলো কোডিং শিক্ষার কোর্স।
সারাবাংলা/আরএফ