Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংকটাপন্ন সাজেকে এবার ম্যালেরিয়ার প্রকোপ

প্রান্ত রনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১২ জুলাই ২০২১ ০৮:২২

রাঙ্গামাটি: আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। উপজেলার দুর্গম সাজেক ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী সংখ্যা বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের দুর্গম ত্রিপুরা পাড়া, বড়ইতলী পাড়া, শিবপাড়া, দেবাছড়া, নরেন্দ্রপাড়া, মন্দিরছড়া, শিয়ালদাই, তুইছুই, বেটলিং-সহ কয়েকটি এলাকায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি। তবে এসব এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে মশাবাহিত এই রোগটি।

বিজ্ঞাপন

১৭৭১ দশমিক ৫৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সাজেক ইউনিয়নে জনসংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। ইউনিয়নজুড়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা মাত্র দু’টি। এর মধ্যে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রেতকাটামুখ, আরেকটি ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৮ নম্বর পাড়ায়। তবে এই দুই কমিউনিটি ক্লিনিকেও খুব একটা মেলেনা চিকিৎসকের দেখা। কর্মচারীদের দিয়েই চলে কার্যক্রম।
স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত এই সাজেকে গত বছরও (২০২০ সালে) হাম আক্রান্ত হয়ে আট শিশুর মৃত্যু হয়। আরও কয়েকশ মানুষ ওই সময় হামে আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই পরিবারের তিন শিশুকে তখন সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যায়। সেখানকার উন্নত চিকিৎসায় মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসে তারা। তবে দুর্গমতা, যাতায়াত ব্যবস্থা ও রাস্তাঘাটের সংকট, সংরক্ষিত বনাঞ্চলে স্থানীয় আদিবাসীদের বসতি— এরকম নানা কারণেই সরকারি-বেসরকারি সহায়তা খুব একটা পোঁছায় না এই ইউনিয়নে। সব মিলিয়ে পর্যটককেন্দ্র হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত সাজেক যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের এক স্বাস্থ্য সংকটাপন্ন জনপদ।

বিজ্ঞাপন

উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সাজেক ইউনিয়নে ১৮ জনের ম্যালেরিয়া শনাক্ত হয়েছে। পরে কেবল জুন মাসেই ৭৮ জনের মধ্যে শনাক্ত হয় রোগটি। সব মিলিয়ে এ বছর এখন পর্যন্ত প্রায় একশ মানুষের শরীরে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি হিসেবের চেয়ে সাজেকে ম্যালেরিয়া রোগের সংখ্যা বেশি।
সাজেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নেলশন চাকমা নয়ন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি হিসাবের চেয়ে সাজেকে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি হবে। সাজেকে দুর্গম এলাকার মানুষের মধ্যে সুঁই, টিকাভীতিসহ ওষুধ সেবনে অনাগ্রহ রয়েছে। বেশিরভাগই এখনো বৈদ্যের চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল। তাই এসব এলাকার ম্যালেরিয়া রোগীরা রক্ত পরীক্ষা করতে আসেন না। জ্বরের লক্ষণ দেখে স্বজনেরা বাজারে এসে ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ব্র্যাকের বিতরণ করা মশারি ব্যবহার না করার কারণেও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেড়ে গেছে। আমি সম্প্রতি ইউপি সদস্যদের সঙ্গে জরুরি সভা করে এলাকায় জনসচেনতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছি। তবে জুন থেকে জুলাই মাসে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এখন ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দি আছে কিছুটা।

সাজেক ইউপি সদস্য হীরানন্দ্র ত্রিপুরা জানান, ‘সাজেকের মানুষ প্রতিবছরই হাম, ম্যালেরিয়া ও ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়। গত বছর হামে আক্রান্ত হয়ে ৮ শিশু মারা গেছে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ টিকা ক্যাম্পেইন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এলাকার মানুষরা এখনো সমতলের মানুষদের চেয়ে অনেকাংশে পিছিয়ে আছে। এছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের অভাব ও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকার কারণে এই পরিস্থিতির কোনো উত্তরণ ঘটছে না সরকারকে অবশ্যই এসব দুর্গম এলাকার দিকে নজর দিতে হবে। দেশের যে প্রান্তেরই হোক না কেন, সাধারণ মানুষকে দেখভাল করা দরকার।’

জানতে চাইলে বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইফতেকার আহমদ বলেন, “প্রতিবছরই তিন পার্বত্য জেলায় মূলত জুন ও জুলাই মাসে এই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ে। এর মধ্যে চলতি বছরের জুন মাসেই বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হওয়া ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ৭৮ জন। এরা প্রায় সবাই সাজেক ইউনিয়নের। আমরা দুর্গম সাজেক ইউনিয়নকে ম্যালেরিয়ার ‘কমন জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছি।”

ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কারণ তুলে ধরে ডা. ইফতেকার বলেন, ‘এলাকটি দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে ওখানে ব্র্যাকসহ আমরা একসঙ্গে কাজ করি। ব্র্যাক আমাদের জানিয়েছে, তাদের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে মশারি বিতরণ করা হলেও স্থানীয়রা ওইসব মশারি ব্যবহার করছেন না। এতে কার্যক্রম চালালেও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। তবে যারা জুমে কাজ করেন এবং মশারি ব্যবহার করছে না, আক্রান্তের সিংহভাগ তারাই।’

এদিকে, জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের হিসাব বলছে, ২০১৪ সালের রাঙ্গামাটির ১০ উপজেলায় ১৭ হাজার ৪৫ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৯৯৩ জন, ২০১৯ সালে ৬ হাজার তিন জন, ২০২০ সালে ১ হাজার ৩৭৭ জন ও ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৩২৬ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। আবার জেলায় উপজেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন বাঘাইছড়ি উপজেলায়। ২০১৪ সালে বাঘাইছড়িতে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২৫৬ জন, ২০১৮ সালে ৮২৪ জন; ২০১৯ সালে ১ হাজার ২৪ জন, ২০২০ সালে ৩৭২ জন, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ৯৬ জন।

রাঙ্গামাটির সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসা বলেন, ‘রাঙ্গামাটির চারটি উপজেলায় ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে সেটি গত বছরের চেয়ে কম। আমি এরই মধ্যে সব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছি। যেসব এলাকায় ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে বাড়তি নজর রাখার জন্য বলেছি। আমরা আশা করছি আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত কমিয়ে আসবে।’

সারাবাংলা/টিআর

ম্যালেরিয়ার প্রকোপ রাঙ্গামাটি সাজেক

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর