পথ হারিয়েছে ভিকারুননিসা
৩০ জুলাই ২০২১ ২৩:২১
ঢাকা: ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ’— কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের কালোত্তীর্ণ এই উক্তি যেন রাজধানীর নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ থাকার পরও শিক্ষাসেবার বদলে একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করে বারবার আলোচনায় আসছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। বিতর্কিত ক্রিয়াকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন অধ্যক্ষ্য ও কলেজের অভিভাবক পর্ষদের সদস্যরাও।
শেষ কয়েক মাসে ভিকারুননিসা কলেজটি রীতিমতো অধ্যক্ষ বনাম কলেজ পরিচালনা পর্ষদের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দুষছেন, গালাগাল করেছেন। সেসবের অডিও রেকর্ড আবার ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কলেজ সংশ্লিষ্ট সাধারণ শিক্ষক ও অভিভাবকেরা বলছেন, দুই পক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্বে শিক্ষার পরিবেশ হারাচ্ছে কলেজটি।
অভিভাবক নেতাদের অভিযোগ, অধ্যক্ষের লাগামছাড়া দুর্নীতির কারণে ভিকারুননিসা ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে একটি মধ্যম মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এছাড়াও শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, অবৈধভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি বাণিজ্য, বিদ্যালয়ের মাঠে গরুর হাট বসানোসহ নানা কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিষ্ঠানটির পুরো কাঠামোটি ধীরে ধীরে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।
আরও পড়ুন- বালিশের নিচে পিস্তল রেখে ঘুমান ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ!
প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল মজিদ সুজন সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমান অধ্যক্ষ কামরুন নাহার আগাগোড়াই একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ। শিক্ষার্থী বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যের পাশাপাশি তিনি বিদ্যালয়ের মাঠে গরু-ছাগলের হাট বসিয়েছিলেন। এজন্য তিনি মোটা অঙ্কের টাকাও নিয়েছেন।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে ভিকারুননিসায় শিক্ষাবান্ধব কোনো অধ্যক্ষ আসেননি। এই অধ্যক্ষ শিক্ষার বদলে দুর্নীতি আর বাণিজ্যকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। তিনি অফিস করেন বাসায় বসে। এতিম শিক্ষার্থীদের বিনাবেতনে পড়ানোর দাবিও দিনি আগ্রাহ্য করেন। তিনি একজন লোভী, শঠ এবং অমানবিক অধ্যক্ষ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এমন অধ্যক্ষ থাকা সমীচীন নয়। আমরা সবসময় তার পদত্যাগ দাবি করে আসছি।
অভিভাবকদের মধ্যে মিজানুর রহমান পিন্টু, সুজন, শাহাবুদ্দিন টিপু, রানা নামের আরও বেশ কয়েকজন কাছাকাছি অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির সামনে থাকা ফখরুদ্দীন বিরিয়ানির মালিকের সঙ্গে অধ্যক্ষের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টিও উঠে আসে। অভিভাবকরা বলছেন, এই তৈরি খাবার বিক্রির এই প্রতিষ্ঠানটিই স্কুলের মাঠে গরু-ছাগলের হাট বসিয়েছিল।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা।’ অভিভাবক নেতাদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগও করেছেন তিনি। বলেছেন, যে অভিযোগগুলো তার নামে দেওয়া হচ্ছে, এর সবকিছুর সঙ্গেই অভিভাবক নেতারা জড়িত।
অধ্যক্ষ বলেন, অভিভাবকদের নাম করে এই মানুষগুলো ভিকারুননিসায় বিভিন্ন অনিয়ম করে আসছেন। এরা আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ। আমি এসে এই অনিয়মগুলো বন্ধের চেষ্টা করলে তারা আমার নামে এসব অভিযোগ করছেন। তারা আমার আগেও কোনো অধ্যক্ষকে এই প্রতিষ্ঠানে টিকতে দেয়নি। আমাকে নানা অভিযোগে বিদায়ের চেষ্টা করছেন। নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে তারা এসব মিথ্যা বানোয়াট অভিযোগ করছেন।
এ বিষয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে (ইইডি) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন বলেও জানিয়েছেন অধ্যক্ষ। জানা গেছে, এ অভিযোগের তদন্ত এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
ইইডি বলছে, ভিকারুননিসায় ভর্তি বাণিজ্য, দুর্নীতি, উন্নয়ন কাজের বিল পরিশোধ না করাসহ বিভিন্ন অভিযোগের সরেজমিন তদন্ত শুরু করেছে। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগেরও তদন্ত করছে তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবক প্রতিনিধি সিদ্দিকী নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করে বিল-ভাউচার জমা না দেওয়ার অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। গত ১৭ মে এই অভিযোগটি করেছিলেন অধ্যক্ষ কামরুন নাহার নিজেই।
অধ্যক্ষ বলছেন, গত ৮ এপ্রিল ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকার বিল-ভাউচার জমা দিতে তিনি সিদ্দিকী নাসির উদ্দিনকে চিঠি দেন। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন কিস্তিতে তাকে ১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল। এর কোনো হিসাব তিনি এখনো দেননি।
অধ্যক্ষ বলছেন, ‘নিজেদের এসব দুর্নীতি ঢাকতেই আমার নামে বিভিন্ন অভিযোগ করছেন দুর্নীতিগ্রস্তরা। পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডও তদন্ত শুরু করছে।’ তবে অভিযোগ বিষয়ে সিদ্দিকী নাসির উদ্দিনের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
ভিকারুননিসা নুন স্কুল ঢাকার বেইলি রোডে অবস্থিত বাংলাদেশে মেয়েদের একটি স্বনামধন্য স্কুল। ১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলার গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহধর্মিনী ভিকার উন নিসা নূন এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। রাজধানীর ধানমন্ডি, আজিমপুর ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সর্বমোট চারটি শাখা মিলিয়ে প্রায় ২৪ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভিকারুননিসা নূন স্কুলে শিক্ষালাভ করছে।
সারাবাংলা/টিএস/টিআর
অধ্যক্ষ কামরুন নাহার ভিকারুননিসা অভিভাবক ফোরাম ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ