নিজের সাজা অন্যকে খাটাতে দেড় লাখ টাকার ‘টোপ’, পরে প্রতারণা
১ আগস্ট ২০২১ ১৮:০৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো : চট্টগ্রাম নগরীতে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া এক নারীর বদলে আরেক নারীকে কারাগারে পাঠানোর সঙ্গে জড়িত আরও দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে দণ্ডিত ওই নারীসহ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, নিজের বদলে অন্যজনকে জেল খাটানোর জন্য গ্রেফতার দু’জনকে দেড় লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ওই নারী। কিন্তু পরে টাকা না দিয়ে প্রতারণা করেন।
শনিবার (৩১ জুলাই) রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানার জঙ্গল সলিমপুর কালাপানিয়া দরবেশ নগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করেছে নগরীর কোতোয়ালী থানা পুলিশ।
গ্রেফতার দুজন হলেন— নুর আলম কাওয়াল (৪৮) ও শাহাদাত হোসেন (৪২)। পুলিশ জানিয়েছে, জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় পাহাড়ে সরকারি খাস জমিতে ছিন্নমূল সমিতির নামে গড়ে ওঠা বিশাল এলাকার অন্যতম নিয়ন্ত্রক তারা। নিজেদের তারা ছিন্নমূল সমাজের নেতা হিসেবে পরিচয় দেন।
এর আগে গত ২৮ জুলাই রাতে নগরীর ইপিজেড থানা এলাকা থেকে দণ্ডিত মূল আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী (৪৫) এবং তার সহযোগী মর্জিনা আক্তারকে (৩০) গ্রেফতার করা হয়। পাঁচবছর আগে তারা জঙ্গল সলিমপুরে ছিন্নমূল সমিতির নামে গড়ে ওঠা এলাকায় পাশাপাশি দুটি প্লটে বসবাস করতেন বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন।
আর কুলসুম সেজে তিনবছর ধরে কারাগারে থাকা মিনু আক্তারের বাড়ি কুমিল্লা জেলার ময়নামতি এলাকায়। তিনিও সীতাকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুর এলাকায় থাকতেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সালের ২৯ মে নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় পারভিন আক্তার নামে এক পোশাক কর্মীকে গলাটিপে হত্যা করা হয়। পরে তার লাশ গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ গেলে প্রতিবেশি কুলসুম দাবি করেন, পারভিন আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে আসে, হত্যাকাণ্ডে কুলসুম জড়িত। মোবাইল নিয়ে বিরোধের জেরে পারভিনকে কুলসুমই খুন করেন।
এরপর ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি কারাগারে ছিলেন। জামিনে বেরিয়ে পলাতক হয়ে যান। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ কুলসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
তখন কুলসুম মর্জিনার মাধ্যমে মিনুকে খুঁজে বের করেন। মিনুর স্বামী ট্রাকচালক বাবুল আক্তার তখন মাত্র মারা যান। তিন সন্তান নিয়ে চরম কষ্টে মিনুর দিন কাটছিল। সন্তানদের ভরণপোষণ দেওয়ার প্রস্তাবে অসহায় মিনু রাজি হয়ে কুলসুম সেজে ২০১৮ সালের ১২ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। সেই থেকে মিনু কুলসুম হয়ে কারাগারে ছিলেন।
সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানির পর চট্টগ্রাম আদালতের একজন আইনজীবী এ বিষয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন। হাইকোর্ট গত ৭ জুন মিনুকে মুক্তির আদেশ দেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের বিচারিক আদালত থেকে কুলসুমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। ১৬ জুন মিনু কারাগার থেকে মুক্তি পান। মাত্র ১৩ দিনের মাথায় ২৯ জুন রাতে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার লিঙ্ক রোডে আরেফিন নগর এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মিনু।
ওসি নেজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গ্রেফতার কুলসুম ও মর্জিনাকে আমরা দুইদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি। পরে কুলসুম আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। কুলসুম জানান, হত্যা মামলায় জেল থেকে বের হয়ে তিনি ছিন্নমূল এলাকায় মর্জিনার পাশে প্লট নিয়ে বসবাস শুরু করেন। রায় হওয়ার পর নিজেকে বাঁচানোর জন্য কুলসুম মর্জিনার সহযোগিতা চান। মর্জিনা তাকে দুই ছিন্নমূল নেতার কাছে নিয়ে যান। তারা কুলসুমের বদলে আরেকজনকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়ে দেড় লাখ টাকা দাবি করেন। কুলসুম ও মর্জিনা রাজি হলে অসহায় মিনুকেই কুলসুম সাজিয়ে আদালতে হাজির করে জেলে পাঠানো হয়।’
‘জিজ্ঞাসাবাদে কুলসুম আরও জানিয়েছেন, মিনু কারাগারে যাবার পর নুর আলম ও শাহাদাত বারবার টাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন। টাকা দিতে না পারায় ছিন্নমূল এলাকার মুরব্বিদের নিয়ে সালিশ বৈঠকও হয়। কিন্তু টাকা না দিয়ে একদিন রাতের আঁধারে কুলসুম ও মর্জিনা ছিন্নমূল ছেড়ে চলে যান। তারা ইপিজেড এলাকায় বাসা ভাড়া করে বসবাস শুরু করেন। নুর আলম ও শাহাদাত প্রতিশোধ হিসেবে তাদের প্লট দু’টি দখল করে নেন।’- বলেন ওসি নেজাম
সারাবাংলা/আরডি/একে