চট্টগ্রামজুড়ে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপট, বলছে গবেষণা
৬ আগস্ট ২০২১ ১৩:৫০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরীতে করোনাভাইরাসের ভারতীয় তথা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। করোনাভাইরাসের ৩০টি নমুনার পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচনের পর গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক মাসে চট্টগ্রামে আক্রান্তদের ৯৪ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন। এই ভ্যারিয়েন্ট উচ্চ সংক্রমণশীল হওয়ায় কোনো পরিবারে একজন আক্রান্ত হলে অন্যরাও দ্রুত আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) যৌথভাবে এ গবেষণা কার্যক্রম চালিয়েছে। সিভাসু’র অধ্যাপক ড. পরিতোষ কুমার বিশ্বাস, শারমিন চৌধুরী, চিকিৎসক ইফতেখার আহমেদ রানা, ত্রিদীপ দাশ, প্রণেশ দত্ত, সিরাজুল ইসলাম, তানভীর আহমেদ নিজামী এবং বিসিএসআইআর’র মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সেলিম খান ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোরশেদ হাসান সরকার এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন।
অধ্যাপক পরিতোষ কুমার বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর কারও শরীরে তীব্র লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, আবার কারও মধ্যে মৃদু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে আমরা ভাইরাসের জিনোমের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি না, সেটি নিয়ে গবেষণা শুরু করি। এই গবেষণা করতে গিয়ে চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগরীতে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তীব্র সংক্রমণের বিষয়টি দেখতে পেয়েছি। তবে মূল গবেষণা এখনো চলমান রয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, গবেষণার অংশ হিসেবে গত ১ জুলাই থেকে ১৯ জুলাইয়ের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বিভিন্ন বয়সী ৩০ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ১৫ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ৩০টি নমুনার ১৫টি সিটি করপোরেশন এলাকার এবং বাকি ১৬টি গ্রামাঞ্চলের। এর মধ্যে ১২ জন পুরুষ এবং ১৮ জন নারী। ৩০টি নমুনায় সংগৃহীত ভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন করে বিসিএসআইআরের কাছে পাঠানো হয়েছে। এর আগেও করোনাভাইরাসের ২২টি নমুনার পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন করেছিল সিভাসু।
গবেষণায় পাওয়া ফলাফল সম্পর্কে অধ্যাপক পরিতোষ কুমার বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘গবেষণার এ পর্যায়ে আমরা চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হয়েছি যে চট্টগ্রামে গত এক মাসে আক্রান্তদের ৯৪ শতাংশই ভারতের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে সংক্রমিত। চীনের যে ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে দেশে সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তার অস্তিত্ব এখন তেমন নেই। ওই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পেয়েছি মাত্র তিন শতাংশ। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইউকে আলফা ভ্যারিয়েন্টেরও অস্তিত্ব আছে, তবে সেটিও মাত্র তিন শতাংশের মতো। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও একই ধরনের গবেষণা হয়েছে। সেখানে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ পাওয়া গেছে ৯৮ শতাংশ।’
চট্টগ্রামে গত বছরের (২০২০) ৩ এপ্রিল প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ৯ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম কোনো ব্যক্তি মারা যান। গত ১৬ মাসে চট্টগ্রামে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সরকারি হিসেবে ৮৮ হাজার ৬৬০ জন। এর মধ্যে নগরীর বাসিন্দা ৬৫ হাজার ৮১২ জন এবং বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা ২২ হাজার ৮৪৮ জন। করোনায় চট্টগ্রামে মারা গেছেন মোট এক হাজার ৩৬ জন। এর মধ্যে নগরীর বাসিন্দা ৬০৮ জন এবং বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা ৪২৮ জন।
তবে সংক্রমণ শুরুর পর প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে এসে চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে খারাপ। সারাদেশের মতো গত মার্চ থেকে চট্টগ্রামেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। জুলাইয়ে এসে চট্টগ্রামে সংক্রমণ পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। জুলাইয়ের শেষ দিকে এসে দিনে আক্রান্তের হার হাজার ছাড়িয়েছে। মৃত্যুও বেড়েছে।
চট্টগ্রামে মার্চে ৫ হাজার ১১০ জন, এপ্রিলে ৯ হাজার ৯০৯ জন, মে মাসে ৩ হাজার ২৮০ জন, জুনে ৫ হাজার ২৫৯ জন করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়। সে হিসাবে এই চার মাসের মোট সংক্রমণ ছিল ২৩ হাজার ৫৫৮। সেখানে কেবল জুলাই মাসের ৩১ দিনেই করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ২৪ হাজার ৬১৫ জন!
অন্যদিকে, ২০২০ সালের এপ্রিলে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর ৯ মাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হন ২৪ হাজার ৮৪৪ জন। আর ২০২১ সালের গত সাত মাসেই ৫২ হাজার ৭২০ জন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুর দিকে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীতে আক্রান্তের হার বেশি ছিল। কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার গ্রামে ও শহরে সমানভাবে হয়েছে। ফলে গ্রামে আক্রান্ত ও মৃত্যু ক্রমশ বাড়ছে। জুলাইয়ে এক মাসে রেকর্ড পরিমাণ করোনা রোগী শনাক্তের জন্য ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দ্রুত সংক্রমণকে কারণ হিসেবে বলছেন গবেষকরা।
পরিতোষ কুমার বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি যে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে প্রথম দিকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন বেশি। এটি গত মার্চ থেকে হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামে এই ভ্যারিয়েন্টের সংকমণ একটু দেরিতে হয়েছে। কারণ চট্টগ্রামের সঙ্গে ভারতের তেমন কোনো সীমান্ত এলাকা নেই। চট্টগ্রাম থেকে ভারতে অনেকে আসা-যাওয়া করেন, তাদের কয়েকজনের নমুনা সংগ্রহ করে আমরা গবেষণা করেছি। কিন্তু আমরা তাদের মাধ্যমে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়ানোর প্রমাণ পাইনি।’
তাহলে কীভাবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ছড়িয়েছে— এ প্রশ্নের উত্তরে পরিতোষ বিশ্বাস বলেন, ‘‘দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার অনেক লোকজন চট্টগ্রামের শহরে-গ্রামাঞ্চলে কাজ করেন। দুই ঈদের ছুটিতে তারা বাড়িতে গেছেন এবং আবার ফিরে এসেছেন। তাদের মাধ্যমে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার ঘটে থাকতে পারে বলে আমরা মনে করি।’
গবেষক পরিতোষ বিশ্বাস আরও বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি যে চীনের যে ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট তার চেয়ে অনেক বেশি উচ্চ সংক্রমণশীল। এই ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাস মানুষের শরীরে আদি ভাইরাসের চেয়ে হাজার গুণ বেশি থাকে। এর ফলে বিস্তারও দ্রুত হচ্ছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে এক পরিবারে একজন আক্রান্ত হলে তার মাধ্যমে পুরো পরিবার আক্রান্ত হয়ে পড়ছে।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
অধ্যাপক পরিতোষ কুমার বিশ্বাস ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিসিএসআইআর সিভাসু