কাপ্তাই হ্রদে পানিস্বল্পতা, মাছ ধরা যাবে না আরও ১০ দিন
৯ আগস্ট ২০২১ ১৬:৪৩
রাঙ্গামাটি: পানিস্বল্পতার কারণে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদে আবারও মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়িয়েছে জেলা প্রশাসন। নির্ধারিত তিন মাস (১ মে ৩১ জুলাই পর্যন্ত) মাছ আহরণের নিষেধাজ্ঞা শেষে প্রথম দফায় ১ থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। এবার দ্বিতীয় দফায় ১১ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত আরও ১০ দিন এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
সোমবার (৯ আগস্ট) সকালে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসময় আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই দিনের পরও হ্রদের পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে না বাড়লে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও বাড়ানো হবে।
সভা সূত্র জানায়, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক এবং কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙ্গামাটি বিপণনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তৌহিদুল ইসলাম, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) রাঙ্গামাটি উপকেন্দ্র প্রধান আজহার আলী, রাঙ্গামাটি মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক উদয়ন বড়য়াসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন- কাপ্তাই হ্রদে পানিস্বল্পতা: মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা বাড়ল ১০ দিন
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম জলাধার রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের বংশবিস্তার ও প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিত করতে প্রতিবছরের ১ মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত তিন মাস সব ধরনের মাছ শিকার, বাজারজাতকরণ ও পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জেলা প্রশাসন। গত বছরও একইভাবে নিষেধাজ্ঞার সময় তিন মাস দেওয়া হলে হ্রদে পর্যাপ্ত পানি না বাড়ায় ১ থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বাড়িয়েছিল জেলা প্রশাসন। ১১ আগস্ট থেকে শুরু হয় মাছ আহরণ।
তবে ওই সময়ে পর্যাপ্ত পানি থাকায় মৌসুমের শুরুর দিকে মাত্রাতিরিক্ত মাছ আহরণের ফলে মৌসুমের শেষে দিকে হ্রদে মাছ তেমন পাওয়া যায়নি। এতে বিএফডিসির মাছ অবতরণের বিগত কয়েক বছরের রেকর্ড পতন হয়েছে। এ কারণে এবার নিষেধাজ্ঞার বাড়তি ১০ দিনে হ্রদে পর্যাপ্ত পানি না বাড়ায় আরও ১০ দিনসহ মোট ২০ দিন নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো হলো।
বিএফডিসি রাঙ্গামাটি বিপণনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এই সময়টাতে কাপ্তাই হ্রদের পানি ১০০ এমএসএলের ওপরে থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে আছে ৮৮ এমএসএল। এ অবস্থায় মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে হ্রদের সব পোনা ও ছোট মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়বে। এতে মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। ধস নামতে পারে হ্রদের মাছ আহরণে। এ কারণেই আপাতত ২০ আগস্ট পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা বাড়ানো হলো।’
তবে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পানি না বাড়লে এই নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়তে পারে বলেও জানান তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ২০ আগস্ট নাগাদ পানি ১০০ এমএলএস মাত্রায় পৌঁছালে ওই দিন মধ্যরাতের পর মাছ ধরা শুরু হবে। আর পানির মাত্রা যদি এই স্তরে উন্নীত না হয়, তাহলে আমরা তৃতীয় দফায় আরও ১০ দিন নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়াব।
এদিকে, মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, স্বল্প পানিতে মাছ আহরণ ও ছোট ফাঁসের কারেন্ট জাল ব্যবহারের কারণে কাপ্তাই হ্রদের মৎস্য সম্পদ ধীরে ধীরে কমছে। বিএফডিসি স্বল্প পানিতে মাছ আহরণ শুরু করার কারণে আহরণ মৌসুমের প্রথম প্রান্তিকেই বেশিরভাগ মাছ ধরা পড়ে যায়। এর অন্যতম কারণ হলো— হ্রদে অবমুক্ত পোনা তিন মাস সময়ে পর্যাপ্ত বাড়তে পারে না এবং হ্রদের পানিস্বল্পতার কারণে ছোট ছোট ঘোনাগুলোতে মাছ পৌঁছাতে পারে না। এতে মূল অংশগুলোতে মাছ ছড়িয়ে থাকে। জেলেদের মাছ ধরার সাধারণ জাল ও ছোট ফাঁসের কারেন্ট জালে ধরা পড়ে যায়।
এ কারণেই মৌসুম শেষের দিকে হ্রদে মাছ থাকছে না এবং প্রাকৃতিক প্রজননও উল্লেখজনকভাবে ঘটছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বিশেষত গত দুই-তিন বছর ধরে রাঙ্গামাটিতে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলের পানি না নামার কারণে হ্রদে পানির স্তর বাড়ছে না। কিন্তু অন্যান্য বছরগুলোতে বৃষ্টির পানি ও উজানের ঢলের কারণে হ্রদ এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতো। আহরণ মৌসুম শুরু নিয়েই কোনো দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৬ সালে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৬২ সালে বাঁধ নির্মাণ শেষে রাঙ্গামাটির বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি হয় কৃত্রিম জলাধার কাপ্তাই হ্রদ। এই হ্রদই বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। এর আয়তন প্রায় ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর, যা বাংলাদেশের পুকুরগুলোর মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ। ১৯৬১ সালে রাঙ্গামাটির কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষে এ হ্রদ তৈরি হলেও এটি রাঙ্গামাটিতে মৎস্য উৎপাদন ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে। এ হ্রদের মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন প্রায় সাড়ে ২২ হাজার জেলে।
সারাবাংলা/টিআর