গণঅভ্যুত্থানে এই সরকারের পতন হবে— এই বিশ্বাস নিয়েই রাজনীতি করছি
১১ আগস্ট ২০২১ ১৫:০৯
মাহমুদুর রহমান মান্না। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত। ১৯৬৮ সালে ছিলেন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক। পরে জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদেরও (চাকসু) সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ প্রতিষ্ঠাকালীন দলটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সক্রিয় ছিলেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে। ১৯৯১ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। পরে আওয়ামী লীগ থেকে পদ হারালে দল ছেড়ে দেন, গড়ে তোলেন নাগরিক ঐক্য। দল হিসেবে নাগরিক ঐক্য বড় কোনো জায়গা তৈরি না করতে পারলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা হিসেবে আলোচনায় আসেন। ঐক্যফ্রন্ট সক্রিয় না থাকলেও রাজনৈতিক সমমনাদের নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
বর্তমান সময়ে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারবিরোধী অবস্থান ও দলীয় রাজনীতি, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে খোলামেলা কথাবার্তা বলেছেন মাহমুদুর রহমান মান্না। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আজমল হক হেলাল। তাদের আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো সারাবাংলার পাঠকদের জন্য—
সারাবাংলা: আপনারা বরাবরই বলে আসছেন, অনির্বাচিত একটি সরকার গণতান্ত্রিক লেবাসে দেশে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছে। অথচ অনির্বাচিত সরকারকে হটাতে বিরোধী দলগুলোকে তেমন কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে দেখা যায়নি। এখন কেবল নয়, করোনাভাইরাস মহামারির আগের সময়েও নাগরিক ঐক্য কেবল নয়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে আপনারাও তেমন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। কেন সেই আন্দোলন আপনারা গড়ে তুলতে পারেননি বলে মনে করেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: করোনা মহামারির আগে বলতে যদি আপনি ২০১৮ নির্বাচনের নামে যে ভোট ডাকাতি হয়েছে তখন থেকে বোঝান, তারপর থেকে আন্দোলনটা করা যায়নি সম্মিলিতভাবে এই কারণে যে— যারা যারা এই আন্দোলনে ছিলেন মানে নির্বাচনের আন্দোলনে বা নির্বাচনপূর্ব যে আন্দোলন ছিল, তাতে তারা প্রত্যেকেই নিজের নিজেরটা বোঝার চেষ্টা করেছেন, মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছেন। সেই মূল্যায়ন করতে গিয়ে আসলে কে কীভাবে ভেবেছেন, সেটি আমরা প্রকৃতপক্ষে বুঝিনি। কারণ সেটি নিয়ে আর বসা হয়নি। বিশেষ করে বড় দল হিসেবে বিএনপি’র ভূমিকা বেশি ছিল। তাদের দল বড়, তাদের শক্তি বেশি। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আবার আমরা বাকি যারা যারা আছি, তাদের মধ্যে কাদের সিদ্দিকী তো তখনই জোট থেকে বেরিয়ে গেছেন। বাকি আমরা যারা আছি তারাও এরকম কোনো উদ্যোগ নিয়ে একটি আন্দোলন করে তুলতে পারিনি।
তবে আমি এটুকু বলতে পারি— সেই থেকে আজ অবধি মানে এই যে করোনার যে ১৬ মাস বা তার আগে ২০১৮ সালের ভোট ডাকাতির নির্বাচনের পর থেকে আমরা অর্থাৎ নাগরিক ঐক্য প্রায় প্রতিটি বিষয়ে নিজেদের বক্তব্য রেখেছি, রাজপথে থেকেছি, আন্দোলনের চেষ্টা করেছি। আমাদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
সারাবাংলা: করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে কীভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: এরকম করে বলা মুশকিল যে পরবর্তী সময়ে কী করব। কারণ এটি এখনো বলা যাচ্ছে না যে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি আসলে কতদিন থাকবে। আমরা কয়েকটি দল ও কিছু ব্যক্তি মিলে নাগরিক সমাজের নামে কিছু কর্মসূচি করেছি। ৫ আগস্টের পর বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হবে, এমন ভাবনা থেকে গত ৬ আগস্ট আমরা একটি কর্মসূচি নিয়েছিলাম। পরে তো ৬ আগস্ট থেকে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়নি এবং ১০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে আমরা ১১ আগস্ট শহিদ মিনারে সমাবেশের তারিখ পুনঃনির্ধারণ করেছি। আমরা সমাবেশটা করব এবং এবং বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সর্ববৃহৎ ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকব।
সারাবাংলা: জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বর্তমান অবস্থা কী? ঐক্যফ্রন্ট ঝিমিয়ে পড়েছে কেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: এ প্রশ্নের উত্তর আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে অনেকখানি বলা আছে। তারপরও বলছি— ঐক্যবদ্ধ যেকোনো আন্দোলনের মধ্যে সবারই দায়িত্ব সমান সমান থাকে বলেই আমরা বলি। কিন্তু কার্যত যে দলটি বড়, যে দলের শক্তি বেশি, তাদের ভূমিকাও বেশি রাখতে হয়। ছোট দল বা তাদের নেতারা যে পারেন না, সেটি বলছি না। বিশেষ করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বা কর্মসূচি গ্রহণ করবার ক্ষেত্রে তারা ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু এটি আমাদের সবার মনে হয়েছে যে বিএনপি সামগ্রিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন তাদের মতো করে করার চেষ্টা করেছে। তাছাড়া তাদের কিছু কিছু সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রশ্নও আছে। যেমন— ৩০ ডিসেম্বরের এরকম একটি নির্বাচনের পর তারা কিছু কিছু উপনির্বাচনে গেছে এবং সংসদে পার্টিসিপেট করেছে। ড. কামালের গণফোরাম সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়, যদিও তাদের দলটা ভেঙে গেছে।
কিন্তু আমরা বলছি যে ওই নির্বাচন কোনো নির্বাচন নয়, গ্রহণযোগ্য নয়, সংসদ বৈধ নয়, কারণ আসলে ভোট হয়নি। আবার এই সংসদে আমরা অংশ নিচ্ছি। এতে কিন্তু মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়, আন্দোলনের ধার কমে যায়। তারা হয়তো মনে করেছে যে আমরা সংসদের ভেতরেও লড়াই করব, বাইরেও লড়াই করব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষয়টি যদি এরকম দাঁড়ায়— আমরা বাইরের লড়াই করছিই না, সংসদের ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে, তাহলে লড়াইটা ওখানেই আটকে যায়। আর তেমন করে এসব সিদ্ধান্তের উত্তর পাওয়া যায়নি, আসলে বসাই হয়নি। ঐক্যফ্রন্ট আছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এই মুহূর্তে কার্যকর না। তবে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে যেকোনো সময় আমরা নিজেদের মধ্যে পুনরায় কথা বলে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলব, সেই সুযোগ-ইচ্ছা-পরিকল্পনা সবই আমাদের আছে। আমি মনে করি জোটের কারওই এ বিষয়ে দ্বিমত নেই।
সারাবাংলা: আপনি ঐক্যফ্রন্টে যে স্বপ্ন নিয়ে যোগদান করেছিলেন, সে স্বপ্ন বা উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়েছে? না হলে কারণ কী?
মাহমুদুর রহমান মান্না: আগের প্রশ্নগুলোর উত্তরে অনেকটাই বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে লক্ষ্য বা স্বপ্ন কী ছিল? সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে একটি জবরদখলকারী সরকারকে হটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ— এটিই ছিল লক্ষ্য। সেটি সফল হয়নি। ক্ষমতাসীনরাই ক্ষমতায় আছে এবং তারা স্বৈরতন্ত্রের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের অপশাসন, দুঃশাসন, দুর্নীতি এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এই বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রেও তারা যত গলাবাজি করছেন, সেই তুলনায় কাজ কিছুই করছেন না। এখন সবচেয়ে বেশি দাবি উঠছে ভ্যাকসিনেশনের। গণটিকাদান কর্মসূচির নামে তারা যা করছেন, তা রীতিমতো হতাশাব্যঞ্জক। কিন্তু এত কিছুর পরও তারা এই অপশাসন চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে উঠছে না। যারা ক্ষমতায় আছেন তারা প্রায় বিনা চ্যালেঞ্জে সবকিছুতে করে পার পেয়ে যাচ্ছে। প্রতিপক্ষ বলে কিছু আছে বলে তারা মনে করছেন না। তাদের মতো করে সবকিছু চালাতে পারছেন।
সারাবাংলা: বর্তমানে দেশের যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, তাতে সরকার পতনের আন্দোলন গড়ে তোলার বাস্তবতা কিংবা তেমন সক্ষমতা কারও আছে কি?
মাহমুদুর রহমান মান্না: সরকার পরিবর্তনের বাস্তবতা তো আছেই। কারণ মানুষ এই সরকারকে চায় না। ধরেন আজ যদি নিরপেক্ষ ভোট হয়, এই সরকারকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগকে চাই— এমন বলার মতো লোক আওয়ামী লীগের কিছু বেনিফিশিয়ারি ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগের ভেতরের মানুষও এ সরকারকে রাখার জন্য ভোট দেবে না বলেই আমি মনে করি। ভোট দিয়ে দেখেন বানিয়ে বলছে কি না। সক্ষমতার প্রশ্ন যে করছেন, সেই সক্ষমতা তৈরি হবে কিসের ভিত্তিতে? জনগণের সম্পৃক্ততার ভিত্তিতেই তো। মানুষের সমর্থন নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত নই। এটি নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু সেই সম্পৃক্ততার বিষয়টি অনেকগুলো ফ্যাক্টর, সেক্টরের ওপর নির্ভর করে। সেগুলোর সবকিছু এখন পর্যন্ত পরিপূরিত, এটি আমি বলব না। হতে সময় লাগছে। তবে সেটি পরিপূর্ণ হবে এবং একসময় জনগণের এই আন্দোলন গড়ে উঠবে। একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমেই এই সরকারের পতন হবে— এই বিশ্বাস নিয়েই তো রাজনীতি করছি।
সারাবাংলা: জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনের কথা বলছেন এবং সবসময় বলেও থাকেন। কিন্তু জনগণ সম্পৃক্ত ইস্যুগুলোতে আপনাদের তথা সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে কর্মসূচি নিতে দেখা যায় না। এ বিষয় আপনার মন্তব্য কী?
মাহমুদুর রহমান মান্না: প্রশ্নটি যদি আমাকে করা হয় তাহলে আমি বলব— করছি। জনসম্পৃক্ত বিষয়গুলোতে আমরা সাধ্যমতো কর্মসূচি পালন করি, সেটি শ্রমিকদের দাবি বলেন, পাট শ্রমিকদের দাবি বলেন, পোশাক শ্রমিকদের দাবি বলেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা বলেন, প্রান্তিক মানুষের কথা বলেন, দরিদ্র-অতিদরিদ্র-নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত বলেন— সবার দাবি-দাওয়া নিয়ে আমরা কথা বলছি, আন্দোলন করছি। আবার বলছি— আমরা আমাদের সাধ্যমতো যতটুকুসম্ভব করছি। কিন্তু আপনি যদি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন করেন তাহলে আমি বলব— ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সেভাবে মাঠেই নেই। এক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততা নিয়ে জনগণের দাবি নিয়ে খুব একটা কাজ হচ্ছে, সেটি বলার অবকাশ অন্তত জোটের পক্ষ থেকে নেই। তবে আমাদের দলের পক্ষ থেকে উদ্যোগ সবসময় আছে।
এই যে কয়েকটি দল, সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তিকে নিয়ে নাগরিক সমাজের ব্যানারে ১১ আগস্টের যে কর্মসূচির কথা বলছি, এর প্রধান দাবি দু’টির একটা হচ্ছে ভ্যাকসিন নিয়ে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২৬ কোটি ভ্যাকসিন লাগবে আমাদের। অথচ দুই দিন আগে বলা হয়েছে, সোয়া এক কোটি ভ্যাকসিন আমাদের আছে। সরকার বলছে— দেড় কোটি ভ্যাকসিন দিয়েছি, আরও ছয় কোটির জন্য চীনের সঙ্গে কথা বলছি, রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলছি। কিন্তু চুক্তি হয়েছে— এরকম কিছু শোনা যায় না। কী চুক্তি করেছেন, কত টাকা দিয়েছেন— এসব তো স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। গলাবাজি করলেই বিশ্বাস করব— সেই অবস্থা তো এই সরকারের নেই। যারা জনগণের ভোট ডাকাতি করে নিয়ে যায়, তাদের কথা বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই। এই ১৩ বছরে তারা তো যথেষ্ট মিথ্যাচার করছে ক্ষমতায় থাকার জন্য। এই কারণে মনে করি, তারা জনগণের পক্ষে আসলে কিছু করছে না।
আমাদের দ্বিতীয় দাবির বিষয়টি শিক্ষা নিয়ে। আমরা মনে করি যে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া দরকার। আমরা নিজেরা হিসাব করে দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩২ লাখ। এদের সঙ্গে আরও তিন লাখ শিক্ষক-কর্মচারী যোগ করা হলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৩৫ লাখে। আপনারা (সরকার) তো দিনে ৩০ লাখ ভ্যাকসিন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাহলে সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়ে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে ভ্যাকসিন কেন্দ্র করে দিয়ে একদিনে না পারেন, দুই দিনে সবাইকে ভ্যাকসিন দিয়ে দিন। আমরা এই মুহূর্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
সারাবাংলা: গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলনের কথা সবসময় বলে থাকেন, বর্তমানে পরিস্থিতিতে সেই আন্দোলন সফল করতে হলে কী কৌশল নিতে হবে বলে মনে করেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: কল-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি খুলে দেওয়া হোক। কলকারখানা তো খুলে দেওয়া হয়েছে। এখন কারখানা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করা হোক। ভবিষ্যতে লকডাউন দেওয়া হলে তখন অবশ্যই গরিব মানুষকে খাবার পৌঁছে দিয়ে তারপর যেন লকডাউন দেওয়া হয়। আর গণতান্ত্রিক যে দাবি রয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতেই আন্দোলনটা গড়ে তুলতে চাই একটি সর্বব্যাপক ঐক্য করে। এক মঞ্চ বলছি না, কারণ সবাই মিলে যে একটি মঞ্চ হবে, তা মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে এরশাদবিরোধী আন্দোলন উদাহরণ হতে পারে। ওই সময় কিন্তু একটি নয়, তিন তিন-চারটি মঞ্চ হয়েছে। কিন্তু তারা যুগপৎ আন্দোলন করেছে। এখন আমরা সেই লক্ষ্যেই চেষ্টা করছি, যেন ব্যাপক একটি আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। সেটি প্রধানত গণতন্ত্রের দাবিতে, এই সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এবং তারপর একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবিতে।
সারাবাংলা: সার্বিক অর্থে রাজনীতি নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
মাহমুদুর রহমান মান্না: আমি দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতি করছি। এখন পরিণত বয়সে তো বটেই, প্রায় প্রৌঢ়ত্বে এসে আমার ধারণা— বাংলাদেশের জন্য একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণ করা প্রয়োজন, যার মূল লক্ষ্য হবে জনগণের কল্যাণ করা। এখানে জনগণ মানে অবশ্যই আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে বোঝাচ্ছি, যার মধ্যে রয়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, দরিদ্র মানুষ, দারিদ্র্যসীমার নিচে বা ওপরে থাকা মানুষ, নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ। একইসঙ্গে আমি শিল্পকারখানার বিকাশের কথাও বলি, যার মধ্যে সাম্য থাকবে। লক্ষ্য একটি গণতান্ত্রিক সমাজ, যেটি খুবই মানবিক হবে।
এই যে আমি বললাম, এগুলোর কোনো কিছুই অবাস্তব নয়। এরকম সমাজ, এরকম রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব যদি ক্ষমতাসীনরা এগুলোকে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেন। আমি বলব যে আমাদের এই ৫০ বছরে যারা যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের ম্যানিফেস্টো বা নির্বাচনি অঙ্গীকারে কল্যাণরাষ্ট্রের কথা বলা থাকলেও তাদের কাজেকর্মে এর কোনো প্রতিফলন রাখেননি। লুটপাট নিয়ে বহু কথা আছে। তাদের নিজেদের লোভ-লালসা, নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ, হিংসা-বিদ্বেষ— এগুলোই জনগণ দেখেছে।
এখন পর্যন্ত যে বাজেট হয়েছে, সবগুলো পর্যালোচনা করে দেখেন— দেখবেন সেখানে এরকম কোনো পরিকল্পনা নেই। ১ দশমিক ৫ শতাংশের মতো অল্প কিছু অর্থ আপনি সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র দূরীকরণ, বেকার ভাতা এসবের জন্য রেখেছেন দায়সারাভাবে। এটা কোনো কল্যাণ অর্থনীতির প্রতীক নয়। কল্যাণ অর্থনীতির জন্য সেই সেই খাতে গুরুত্ব দিতে হবে হবে যেন সত্যি সত্যি সামগ্রিকভাবে জনগণের কল্যাণটা হয়। এরকম একটি বাজেট, সেই বাজেটের বাস্তবায়ন এবং সেভাবে দেশের প্রশাসন ও সবকিছু গড়ে তোলা— কোনো সরকারই তা করছে না।
তাই আমরা একটি দল করেছি এবং এই দল গড়ে তোলার কাজটি আমাদের কাছে এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা হলো— দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে সহজে রাজনীতি ও জ্ঞানের চর্চা করা যায়, রাজনীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া মিথস্ক্রিয়া হয়। এসবের মধ্য দিয়ে ভাব, ধারণা, জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়। একটি জ্ঞানসম্পন্ন সমাজ গড়ে উঠতে পারে। একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র ও রাজনীতি গড়ে উঠতে পারে। এগুলো কিছুই হচ্ছে না।
অতএব ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করার জন্য সব বিরোধী শক্তিকে নিয়ে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আমি যেরকম কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলি তারা যদি সেরকম চান তো ভালো। যদি সেরকম না বলেন কিন্তু গণতন্ত্রের কথা বলেন, তাহলে সেই ভিত্তিতে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা এবং সেই সরকার যাদের একটা কল্যাণ রাষ্ট্রের চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, প্রয়োজনে বাধ্য করা যায়— সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। আপনাদের দোয়ায়, সহযোগিতায় এই প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা আমাদের কাছে রাজনৈতিক কার্যক্রম কখনো বন্ধ রাখিনি। করোনার মধ্যেও আমি নিজেসহ আমার সহকর্মী যারা আছেন তারা সবাই সার্বিকভাবে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এবং আমরা এগোচ্ছি। আমি জনগণের ব্যাপক সম্পৃক্ততা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, ভালোবাসা প্রত্যাশী।
সারাবাংলা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে সন্তুষ্ট নন, আপনার আগের কথাতেই তা স্পষ্ট। সামগ্রিকভাবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মাহমুদুর রহমান মান্না: করোনা মহামারি মোকাবিলায় সরকার কোনো ভূমিকা রেখেছে বলে আমার মনে হয় না। যা করেছে, তা রীতিমতো নিন্দা করার মতো। খেয়াল করে দেখুন, একদম প্রথমে যখন উহানে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলো আমরা কিন্তু বেশ সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু আমরা কিছুই করিনি। তখন একদিকে শততমবার্ষিকী, আরেকদিকে সুবর্ণজয়ন্তী— এসব আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তখন সরকারি দলের নেতারা এমন কথাবার্তাও বলেছেন— শেখ হাসিনা যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, সেই দেশে করোনা কিছুই করতে পারবে না। হাউ স্টুপিড! আবার প্রথম দিকে যদি কেউ বুঝতে না পারে, সেটি একরকম। কিন্তু তিন মাস পরও যদি একই কথা বলতেই থাকে, সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। তারপর পোশাক কারখানা ছুটি দেওয়া, খোলা রাখা, গণপরিবহন বন্ধ রাখা— সবকিছুই আমরা দেখেছি। তখন থেকেই আমি, আমরা মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কথা বারবার বলেছি। কিন্তু সরকার এগুলোর পক্ষে কোনো ক্যাম্পেইন করেনি। তারা জনগণকে বকাবকি করেছে, ঘরের মধ্যে আটকে রাখতে চেয়েছে জোর করে। পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষই ঘরে থাকতে পছন্দ করছে না। বাংলাদেশের মানুষ ঈদের জামাতে যেতে পারবে না, সেটা মেনে নিয়েছে। জুম্মায় যেতে পারবে না, সেটাও মেনে নিয়েছে। সুতরাং আপনি মানুষকে তো বকাবকি করতে পারেন না, নিন্দা করতে পারেন না। এসবের সঙ্গে তো দেশের মানুষ অভ্যস্ত নয়। শুধু এই দেশে কেন, ফ্রান্স-আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। অন্যদিকে এই সরকার তথাকথিত লকডাউনের নামে যেটা করেছে, গরীব মানুষের ঘর থেকে বের হতে দেবে না, দিনমজুরদের ঘর থেকে বের হতে দেবে না, তাদের জোর করে ঘরে আটকে রাখবে— সেটি সম্ভব হয়নি। তারা বের হয়েছে, পুলিশ ধরেছে। পুলিশকে তারা বলেছে— বের হলে করোনায় মরব, ঘরে থাকলে না খেয়ে মরব। মরলে আমি মরব, আমার পরিবার তো খেয়ে বাঁচবে। ভারত-পাকিস্তানসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশে লকডেউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারের কাছে কোনো টাকা নেই। শুধু বড় বড় কথা, চাপাবাজি। কোথাও কোনো টাকা দিতে পারবে না। সমালোচনার পর যা দিয়েছে, সেটিও চাটার দল খেয়ে ফেলেছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান দেখিয়েছে— এসব সাহায্য বা প্রণোদনার ৬৫ শতাংশ দলের লোকজন খেয়ে ফেলেছে। সরকার জনগণের জীবন নিয়ে খেল-তামাশা করছে।
সরকারি হিসাব মতে যেখানে ২৬ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োজন, সেখানে তারা সোয়া কোটি ডোজ টিকা নিয়ে কর্মসূচির নামের আগে ‘গণ’ জুড়ে দিয়েছে। ‘গণ’ শব্দের অর্থই বদলে দিয়েছে সরকার। গণটিকার নামে নতুন এক নাটিকার অবতারণা করেছে। প্রতিদিন এসব ভ্যাকসিন কেন্দ্রে হাজার হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু কয়েকশ ভ্যাকসিন দেওয়ার পর বাকিদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এর মধ্যেও আবার আওয়ামী কোটা আছে, ছাত্রলীগ-যুবলীগ কোটা আছে! এই কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার রীতিমতো সার্কাস করেছে। আর এতে ভোগান্তিতে পড়েছে ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী সাধারণ জনগণ। সরকার বলেছে, এই মাসের শেষে এক কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আসবে। এই ভ্যাকসিন তো এখন যারা প্রথম ডোজ পাচ্ছেন, তাদের দ্বিতীয় ডোজ দিতেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর কী হবে? এটি নিয়ে কিন্তু সরকারের কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। তারা শুধু বলছে চীনকে অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে কথা চলছে। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে ভ্যাকসিন নিয়ে কোনো তথ্য জানাচ্ছে না। কোন দেশের কাছ থেকে কত টাকায় কী পরিমাণ ভ্যাকসিন সরকার কিনছে, কার সঙ্গে কী কথা চলছে— এগুলো তো জনগণকে জানাতে হবে। সরকার জনগণের টাকায় ভ্যাকসিন কিনবে আর জনগণ সে সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবে না— এটি হতে পারে না। নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য এক চুক্তি করে দেশের মানুষের জীবনকে, দেশের অর্থনীতিকে এতগুলো দিনের জন্য অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছিলেন আপনারাই (সরকার)।
এখন এই যে এতদিন ধরে লাগাতার লকডাউন চললো, এর ফলে সংক্রমণ কমেছে? মৃত্যুহার কমেছে? কমেনি। বলতে পারেন, বিধিনিষেধ না থাকলে সংক্রমণ আরও বাড়ত। কিন্তু প্রকৃত অর্থে করোনা মোকাবিলায় সরকার সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু প্রচার চলছে অভূতপূর্ব সাফল্যের। বলা হচ্ছে জিডিপি আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের কথা। আমরা তো জানি তো এগুলো কীভাবে হয়। নতুন করে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। অথচ জিডিপি দেখিয়ে বলছেন দেশের উন্নতি হচ্ছে। বলছেন আপনার অর্থনীতি মডেল ফর ডেভেলপমেন্ট!
সারাবাংলা: জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ভূমিকা সর্ম্পকে আপনার মূল্যায়ন কী?
মাহমুদুর রহমান মান্না: এই প্রশ্নের জবাব আমি দেবো না। কারণ আমি জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল মনেই করি না। মৎস্যকন্যার মতো অর্ধেকটা সরকারি দলের মধ্যে, অর্ধেকটা বিরোধী বিরোধী একটা ভাব।
সারাবাংলা: বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?
মাহমুদুর রহমান মান্না: এই প্রশ্নের জবাবে অনেক কথা বলতে হয়। এত কথা বলতে পারব না। শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলছেন আপনি। ব্যবস্থার কথা বলতে গেলে এর খোলনলচে বদলে ফেলতে হবে। এখানে এত লম্বা করব না। শুধু এখনকার অবস্থার কথা বলব। যা করছে সরকার বিগত ১৬ মাস ধরে, শিক্ষাঙ্গনগুলো বন্ধ রাখার কারণে দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমি দাবি করছি এক মুহূর্ত দেরি না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হোক।
সারাবাংলা: সারাবাংলাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহমুদুর রহমান মান্না: সারাবাংলাকেও ধন্যবাদ।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর