বঙ্গবন্ধু হত্যার ৫ খুনি এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে
১৫ আগস্ট ২০২১ ১৪:৩৩
ঢাকা: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির ইতিহাসের নৃশংস ও মর্মস্পর্শী রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের দিন। এদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালির ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়ের জন্ম দেয় বিপথগামী কিছু সৈনিক। পরিকল্পিত সেই হত্যাকাণ্ডের ৪৬ বছর পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে মামলার রায়ে সেই নৃসংশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ১২ আসামির ছয় জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এছাড়া একজন পলাতক অবস্থায় মারা গেলেও পাঁচ জন এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা সেসব খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে গত এক যুগ ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। তবে এখনও সেই প্রক্রিয়া আলোচনা পর্যায়েই রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অর্তকিত হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারের হত্যা করা হয়। পরিকল্পিত সেই হত্যাকান্ডে ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু রাসেল, পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ তার পরিবারের ১৮ সদস্যকে নৃসংশভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা কর্নেল জামিলকেও হত্যা করা হয়। তবে সেই সময়ে বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ইতিহাসের নৃসংশতম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের সেই সময় বিচারের মুখোমুখি না করে দায়মুক্তির অধ্যাদেশের মাধ্যমে খুনিদের মুক্তি দিয়েছিলো তৎকালীন সরকার।
এরপর কেটে যায় একুশ বছর। বিচার তো দূরের কথা, ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয় জাতির পিতার নাম। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম বারের মতো রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে ওই হত্যাকাণ্ডের মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এই মামলা আর বেশি দূর এগোয়নি। এরপর ২০০৯ সালে ফের আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে ১২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ২০০৯ সালে। এর মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলেটর) ও মহিউদ্দীন আহমেদের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। বাকি সাত জনের মধ্যে ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে পলাতক অবস্থায় মারা যান আসামি আজিজ পাশা। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জানা যায়, তিনি এর আগে ২০ বছরেরও বেশি সময় ভারতে লুকিয়ে ছিলেন।
এছাড়া এখন পলাতক রয়েছেন- খন্দকার আব্দুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী এবং মোসলেম উদ্দীন এই পাঁচ জন। এদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। মোসলেহ উদ্দিন ভারতে ধরা পড়েছেন বলে সেদেশের গণমাধ্যমে খবর বের হলেও তার সতত্যা পাওয়া যায়নি। রশীদ ও ডালিম কোথায় অবস্থান করছে তার সঠিক তথ্য সরকারের কাছে নেই। তবে গত ১২ বছর ধরে এদের খুঁজছে সরকার। পাশপাশি বিদেশে থাকা বঙ্গবন্ধুর এই খুনিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়টি পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয় মার্কিন বিচার বিভাগ। কিন্তু দেশটিতে সরকার বদলের কারণে বিষয়টা অনেকটাই চাপা পড়ে। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরে গণমাধ্যমে বলেছিলেন, তিনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত আনার বিষয়ে দেশটির সরকারের সঙ্গে আলাপ করেছেন। আর কানাডায় পালিয়ে থাকা নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে দেশটির আইনি জটিলতা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফেরানের অগ্রগতি সম্পর্কে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা বঙ্গবন্ধুর দুই খুনির অবস্থান সম্পর্কে জানি। একজন যুক্তরাষ্ট্রে, আরেকজন কানাডায়। আমরা সেসব দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন তাদের ওপরে নির্ভর করছে তারা কীভাবে, কখন এই খুনিদের ফেরত দেবেন।’ আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা করেছি, তার বিচার হয়েছে। বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। এখন যারা পলাতক রয়েছে তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে। আমরা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকার এ বিষয়ে বদ্ধ পরিকর।’
এদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪৬ বছর পর চার খুনির মুক্তিযুদ্ধের খেতাব ও পদক বাতিল করেছে সরকার। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে শরিফুল হক ডালিমের বীর উত্তম, নূর চৌধুরীর বীর বিক্রম, রাশেদ চৌধুরীর বীর প্রতীক এবং মোসলেহ উদ্দীনের বীর প্রতীক খেতাব বাতিল করা হয়। বাতিলের প্রক্রিয়ায় রয়েছে জিয়াউর রহমানের খেতাবও। সংবিধান লঙ্ঘন, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশত্যাগে সহায়তা এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের কারণে সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তম খেতাবও বাতিলের অপেক্ষায়। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘তারা মুক্তিযুদ্ধ করলেও দেশদ্রোহী কাজও করেছেন। অন্য অর্থে তারা খুনি। জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত হত্যাকারী। সংবিধান অনুযায়ীই তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর খুনি শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তান, লিবিয়া বা স্পেনে থাকতে পারেন। আর খন্দকার আব্দুর রশিদ পাকিস্তান বা আফ্রিকার কোনো দেশে পালিয়ে রয়েছেন। তবে সরকারের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এমন কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত নেই।
দীর্ঘদিন আইন মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় পাই তখন থেকেই খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়। সেই থেকে নানাভাবে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে তারা যেসব দেশে অবস্থান করছে, সেসব দেশের আইন এবং রাষ্ট্রীয় অনুশাসন মেনেই আনতে হবে। যা এখনও চলমান। আমি আশাবাদী, পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করা হবে।’
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম