আফগানে মোল্লা খেল; বিশ্বের বাঁক বদল
১৬ আগস্ট ২০২১ ০০:৪৯
মারদাঙ্গার পর কূটনীতিও দেখিয়ে দিল তালেবানরা। কেবল আফগানিস্তান নয়, গোটা বিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো যত কাণ্ড। প্রচারে এবং ভাবনায় তারা মোল্লা-মৌলভী শ্রেণির। মিডিয়ায় সাম্প্রদায়িক-জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত ওমর মোল্লার এই সাগরেদরা সাফ জানিয়ে দিয়েছে আর হামলা নয়, এগিয়ে যাবে রক্তপাতহীন পথে। প্রতিশোধ তো নেবেই না, সম্মান দেবে নারী অধিকারে।
কেবল নাটকীয়তা নয়, ম্যাজিকের মতো ঘটনা। একের পর এক প্রাদেশিক রাজধানী দখলের পর মূল টার্গেট ছিল কাবুল। রোববার সকালে তেমন কোনো বাধা ছাড়াই দলে দলে শহরটিতে ঢুকে পড়ে তারা। সশস্ত্র অবস্থান নিলেও চলায়নি গুলি। লাস্ট রাউন্ডটা রক্তপাতহীন। আফগান সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার আলোচনা শুরুর আগেই দেশ ছেড়ে কাজাকিস্তানে আশ্রয় নেয় আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ। চালাকি, কূটনীতি, বিচক্ষণতা যা-ই বলা হোক, মোল্লাদের সুক্ষ কৌশল এবং পেছনে দেশ-বিদেশের বড় বড় শক্তির মদদ বিশ্ব কূটনীতিকদেরও তাজ্জব করে দিয়েছে।
গোটা বিশ্বেই ভাবনাকে হার মানানো বদলি হাওয়া। পিলে চমকানোর মতো বাম-ডানের অবিশ্বাস্য ঘটনা। চীনের কমিউনিস্ট- আফগানিস্তানের তালেবানের প্রকাশ্য মেলবৈঠক, ভারতের অপ্রকাশ্য গতিবিধিতে নতুন সমীকরণটি আঁচ করা গেলেও ভবিষ্যতের জন্য ছিল অপেক্ষার প্রহর। বিশ্বের ঝানু কূটনীতিকদের কাছে আফগানিস্তান হয়ে উঠে ব্যাপক আগ্রহের বিষয়। প্রায় যেমনটি হয়েছিল ১৯৭৫-এ এপ্রিলের শেষদিকে ভিয়েতনামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিরো মাত্র ৩০ বছরের ব্যবধানে কিভাবে ছোট একটি দেশের কাছে জিরো হয়ে গেল সে বিষয় নিয়ে আলোচনা ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশেও। যুক্তরাষ্ট্রে ভয়ঙ্কর ‘নাইন ইলেভেন’ সারা বিশ্বে মুসলমানদের জঙ্গির কাতারে ফেলে দেয়। মুসলমানদের সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিরাপওা আইন তৈরি হয়। সেখানে আজ কী বৈপরিত্য? কূটনীতির কী চমক? বিশ্ব রাজনীতিতে দুই দশকের অবহেলিত ‘ইসলামপন্থা’র রাজনীতির কি পুনরুত্থান ঘটতে যাচ্ছে? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্বরাজনীতির গবেষকদের কাছে।
বিশ্বে ‘ইসলামপন্থা’ মোটা দাগে দুই ধারায় বিভক্ত। একটি শিয়া, আরেকটি সুন্নি । শিয়া ইসলামপন্থিদের কাছে ইরান হচ্ছে মডেল রাষ্ট্র। সুন্নি ইসলামপন্থিরা দীর্ঘ সময় ধরে সক্রিয় থাকলেও প্রথম সফলতা পায় শিয়া ইসলামপন্থিরা। ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে ব্যবহার করে যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা সম্ভব, আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে শিয়া ইসলামপন্থিরা প্রথম সেটা প্রমাণ করে ১৯৭৯ সালে ‘ইসলামী’ বিপ্লবের মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা নানা বাধা এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ টিকে থাকতে পারে, সেটাও তারা প্রমাণ করেছে। তালেবানরা নতুন নজির তৈরি করেছে। বাংলাদেশের ইসলামপন্থিরা বরাবরই মার্কিন এবং পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট ধর্মভিত্তিক শক্তিগুলোর সঙ্গে খায়খাতির রেখে চলে।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশের প্রায় সব ঘরানার ‘ইসলামপন্থি’রা শ্লোগান দিতে শুরু করেন, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’ এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাদেরকে মডারেট রাজনৈতিক দল মনে করে, সেই জামায়াতে ইসলামীকেও এ শ্লোগান দিতে দেখা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ৯/১১ এর ঘটনার সঙ্গে বিন লাদেনের কী সম্পৃক্ততা আছে তার স্বাক্ষ্য প্রমাণ না দেওয়া পর্যন্ত তালেবান বিন লাদেনকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। সময় ক্ষেপণের বাহানা করছে অযুহাতে আমেরিকা ক্ষিপ্ত হয়ে যুক্তরাজ্যকে সঙ্গে নিয়ে আফগানিস্তানের মাটিকে তামা বানিয়ে দিতে থাকে। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তালেবান দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মাত্র তিন মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে কারজাইকে দিয়ে সরকার তৈরি করে। সময়ের ব্যবধানে তালেবানরাই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হয়ে যায়। চীন-পাকিস্তানকে তো বন্ধু হিসেবে পেয়েছেই। চীন রাশিয়ার উত্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় ব্যর্থতা তো রয়েছেই।
অবস্থা বুঝে আফগানিস্তান থেকে দ্রুত সরে আসা ছাড়া প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সামনে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না। পাকিস্তানের পাশাপাশি রাশিয়া, চীন তালেবানদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে। এমন দৃশ্যায়নের জের সামনে কোথায় যাবে-এখনই বলার সময় আসেনি। বাংলাদেশের জামায়াত-হেফাজত কেমন পুলক পাচ্ছে তাও প্রশ্ন। ‘বাংলাদেশ থেকে কিছু লোক তালেবানের সাথে যোগ দিতে হিজরত করেছে’— সংবাদ সম্মেলন ডেকে এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে পুলিশ থেকে। প্রশ্নের সঙ্গে ভয়টাও সেখানে। এর মাঝে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যকে আর পাত্তা না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বিশেষ করে সৌদি আরবকে। ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে সমর্থন দিচ্ছেন না। ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালে করা পারমাণবিক চুক্তি পুনরুদ্ধার চান। আফগানিস্তান থেকে কেটে তো পড়ছেনই। এর মাঝে ইরানের সঙ্গে চীন ২৫ বছরের ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি সেরে ফেলেছে। বিনিময়ে ইরানের তেল ও গ্যাস হাতাবে দেশটি। ইরানের এই উদাম হওয়া কি এমনি এমনি?
কাতারের সঙ্গে সৌদি আরবের পুরোনো বিবাদ মিটমাটও গোপন নয়। তবে সৌদি কর্মকর্তাদের দামেস্কে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকটা হয়েছে গোপনে। আবার ইরানের সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে খাতির বাড়ানোর মধ্যে রাখঢাক নেই। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ ফুরফুরে সফর করেছেন কাতার, ইরাক, কুয়েত ও ওমানে। এতে কি সিরিয়া ও ইয়েমেনের ‘ঘরকাইজ্জা’ থামবে? তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানই বা কী করবেন?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসএসএ