Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘যদি মুখ খুলি তবে অনেকের কুৎসিত রূপ প্রকাশিত হবে’


১৭ আগস্ট ২০২১ ১৩:১৪

অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক।  বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। একজন আপাদমস্তক রাজনীতিক। সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে একদম তৃণমূল থেকে আওয়ামী পরিবারে ভরসার মুখ হয়ে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় আছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সময় তিনি ছিলেন বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। কালোরাতে ঢাকায় থাকার সুবাদে দেখেছেন সেসময়ে দলীয় রাজনীতির পুরো পরিস্থিতি, তৎকালীন নেতাদের নানা হীনমন্যতা। ‘বিডিআর বিদ্রোহে’র সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে শান্তির পতাকা হাতে নিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। এরপর আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন দলের কঠিন দুঃসময়ে। এসময় তার নেতৃত্বে যুবলীগ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জাহাঙ্গীর কবির নানকের নেতৃত্বে যুবলীগ শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই এই নেতাকে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের যোদ্ধা হিসেবে মনে করা হয়।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগের দুঃসময় ও দলের পরবর্তী উত্থান, রাজনৈতিক কর্মকৌশল, সুযোগসন্ধানী নেতাদের নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন জাহাঙ্গীর কবির নানক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট নৃপেন রায়।তাদের কথোপকথনের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো সারাবাংলার পাঠকদের জন্য—

সারাবাংলা: ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আপনারা ক্ষমতাসীন দল হিসাবে হত্যার প্রতিবাদে সাংগঠনিকভাবে প্রতিরোধ-প্রতিবাদের যে ডাক জনগণ আশা করেছিল, সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে আপনারা কি ব্যর্থ হয়েছিলেন বা ওই সময়কার নেতৃত্বের দুর্বলতা কোথায় ছিল বলে মনে করেন?

জাহাঙ্গীর কবির নানক: সেই সময় আমি বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। আমি অকপটে বলতে পারি যে, আজকের ছাত্রলীগের সেক্রেটারি আর সেই দিনে আমরা যে পরিষদের ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিলাম; বিষয়টা একই যে তেমন না। আমরা বরিশালের রাজনীতি করেছি সেই সময়। আমি জেলার নেতৃত্ব দিয়েছি। জেলার নেতাগিরি করেছি। আমরা আসলে একটি আদর্শবাদী সংগঠন হিসাবে সংগঠন দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। আমরা খুব সম্মানিত হতাম মানুষের কাছে। মানুষ আমাদেরকে খুব ভালবাসত। শ্রদ্ধার জায়গায় শ্রদ্ধা করত, স্নেহ করার যারা তারা আমাদের স্নেহ করত। সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি হলো, ক্ষমতার গড্ডালিকায় আমরা গা ভাসিয়ে দেই নাই। আমি স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে কিন্তু ভেবেছি দেশটি আসলে আরেকটি যুদ্ধের মধ্যে লিপ্ত হল। সেই যুদ্ধটির একটি হল দেশ গড়ার যুদ্ধ আরেকটি হল দেশের পরাজিত শত্রুদের বিরুদ্ধে। যে পরাজিত শত্রু চিহ্নিত ছিল। যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং মুসলিম লীগ এরাই শুধু চিহ্নিত ছিল বিষয়টি এমন নয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় দলের ভিতরের মোশতাকদের যে বিচরণ, মোশতাকদের যে কর্মকাণ্ড এ নিয়ে আমরা কিন্তু সবসময় একটা সতর্কতার মধ্যে ছিলাম। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে দলের ভিতরেও কিন্তু আভ্যন্তরীণ ঐক্যে এক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই বিশৃঙ্খলা কিন্তু কেন্দ্র থেকে শুরু হয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দলের কিন্তু সেদিন দলীয় সংহতি বা দলীয় ঐক্য প্রস্তুত ছিল না।

বিজ্ঞাপন

আবার পাশাপাশিভাবে স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ যারা একসঙ্গে করলাম তারা তৎকালীন ছাত্রলীগের মধ্যে বিভাজন তৈরি করল। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র আর শোষিতের গণতন্ত্রের নামে ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যারা নিজস্ব একটি বাতাবরণ তৈরি করতে চেয়েছিল সেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীর অন্যতম প্রধান, সেই সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে যে একটি ভিন্ন পথে চলছিল। দেশ স্বাধীন হবে এব্যাপারে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না সিরাজুল আলম গংদের। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধত্তোর বাংলাদেশ যাতে তাদের দখলে থাকে, তাদের দখলে থাকে রাজনীতি, তাদের দখলে যাতে রাষ্ট্র থাকে। সেই যে একটি অপচেষ্টা তার প্রতিফলন দেখলাম যে ছাত্রলীগকে বিভক্ত করা এবং একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ, যা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ নামে। আরেকদিকে ছাত্রলীগের বিভক্তি করা হল।

আমার বলতে দ্বিধা নেই-স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধত্তোর ছাত্রলীগে মেধাবী যে মানুষগুলি ছিল তার ভিতর ম্যাক্সিমাম লোকগুলোই কিন্তু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদীতে চলে গেলেন। অর্থ্যাৎ ছাত্রলীগ একটি নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো। তার মানে কি দাঁড়াল-মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ বিভাজন আরেকদিকে হল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যারা ডান এবং বাম শক্তি (ডান শক্তি বলতে, জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ নেজামে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল) আরেকদিকে হলো রাজাকার, আলবদর, আলবদর, আলশামস তারা। আরেকদিকে হল তৎকালীন যে মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই হিসাবে আখ্যায়িত করল, সেই ইস্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি অর্থ্যাৎ ইপিসিপিএলএম মার্কসবাদী-লেলিনবাদী এবং পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি যেটি সিরাজ শিকদার পার্টি নামে পরিচিত ছিল; এরা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কি হল স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে পাটের গুদাম পোড়ানো হল ব্যাংক লুট করা হল! কুষ্টিয়ায় ঈদের জামাতে আওয়ামী লীগের এমপিকে হত্যা করল। সারাদেশে হাজার হাজার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে হত্যা করা হলো মুক্তিযুদ্ধত্তোর বাংলাদেশে।

সারাবাংলা: স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে যেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সব শক্তির ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ছিল সেটা না হয়ে এই বিভাজন বা বিভেদের মতাদর্শিক লড়াই কেন শুরু হল বলে মনে করেন?

জাহাঙ্গীর কবির নানক: বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা যে স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই স্বপ্নটা ছিল একটি আদর্শিক স্বপ্ন। সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমরা যখন চেষ্টা করেছি। আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য দেশ যখন এগিয়ে গেছে দেশ যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে, দেশ যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই কিন্তু একটা ষড়যন্ত্র হল। সেই ষড়যন্ত্র কারা করল? সেনাবাহিনীর ভিতরে যারা একদিন চিন্তা করেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে যারা কর্মরত ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আমার পদোন্নতি হয় না। আমি বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন থেকে মেজর, মেজর থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল, বিগ্রেডিয়ার, একদিন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল, একদিন রাতের অন্ধকারে ক্ষমতা দখল করে নেবো; এই এরা এবং পশ্চিমা তেইশ (২৩) পরিবারকে বিতাড়িত করে বাঙালির আরেক ২৩ পরিবার সৃষ্টি হওয়ার তারাও কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকল। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। আর আমরা যারা আদর্শিক কর্মী ছিলাম আমাদের লক্ষ্য ছিল আলাদা। আমাদের লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখিয়েছে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসার নিশ্চয়তা অর্থ্যাৎ বঙ্গবন্ধু যে কথা বলেছেন ঐতিহাসিক ৭ মার্চে যে দর্শন দিয়েছেন এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি তো শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলেননি, তিনি অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছেন। তিনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চেয়েছেন। তিনি অর্থনৈতিক শোষণ চিরতরে ধ্বংস করতে চেয়েছেন এবং বাঙালি জাতির একটি রাষ্ট্র কায়েমের চেষ্টা করেছেন।

যে প্রশ্নটি করেছেন, দেখেন যেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। আমি সেদিন ঢাকায় ছিলাম। আমি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। আমি মরহুম আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় ছিলাম। বরিশাল থেকে এসে ওনার বাসাতেই থাকতাম। আমি ওনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই ওনি একজন শ্রদ্ধাষ্পদ মানুষ ছিলেন। ওনি একজন আদর্শবাদী মানুষ ছিলেন। আমার বড় ভাইয়ের বাসা থাকার পর আমি আমার বড় ভাইয়ের ধানমন্ডির বাসায় কখনো থাকতাম না। আমার বড় ভাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। আমি ওনার বাসায় ছিলাম। রাত এগারটার দিকে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই, বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন পরের দিন ১৫ আগস্ট সকালে। সেই কারণে বিশ্ববিদ্যালয় চলে আসি।

সেইদিন রাত একটা/দুইটা পর্যন্ত শহীদ শেখ কামালসহ আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। কিন্তু পরেরদিন ১৫ আগস্ট আমাদেও ঘুম ভাঙল দেশবাসীর ঘুম ভাঙল, বাঙালি জাতির ঘুম ভাঙল, বুলেটের শব্দ শুনে কামানের গোলার শব্দে। সেদিন আমরা যারা ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি। নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়েছি প্রতিবাদ কেন হয় না? প্রতিবাদ করার জন্য, প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু আমাদের ডাকে তো আর প্রতিরোধ হবে না। আমরা প্রতিবাদ করতে পারি। কিন্তু পরে প্রতিরোধ হল না।

কারণ কে কাক, আর কে যে কোকিল, কে যে হত্যার সঙ্গে জড়িত, আর কে যে হত্যার সঙ্গে জড়িত না? এটি বোঝা আমাদের জন্য খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। তারপরও আমরা ২১ আগস্ট কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম একটি বিক্ষোভ মিছিল করলাম এবং আমরা ছাত্রলীগ যারা করতাম, ছাত্রলীগের একটি বিরাট অংশ নাম বলে সময় নষ্ট করতে চাই না। তবে সেদিন থেকেই তিলে তিলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ এবং প্রতিশোধের জন্য আমরা সংগঠনকে নতুন করে গড়ে তুলি।

যাই হোক আমার যে কথাটি সেটি হলো, এই যে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হল? এটি কি কোন উর্বর মস্তিস্কের সিদ্ধান্ত? বিষয়টি কি এমন ছিল- কয়েকজন আর্মি অফিসার তারা এক জায়গায় বসে তারা ড্রিংকস করেছে, ড্রিংক করার ছলে একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছে চল আমরা গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলি! বাংলাদেশ বেতার দখল করি, বঙ্গভবন দখল করি? বিষয়টা তো এরকম ছিল না। বিষয়টা ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। পূর্ব ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের জাল অনেক গভীরে। এই ষড়যন্ত্র অনেক দিকের ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে কেন সতর্ক করলেন না সরকার বা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষেরা? কেন সতর্ক হলেন না, কেন সতর্ক করলেন না বঙ্গবন্ধুকে? বা বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করলেও বঙ্গবন্ধুকে একটি পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব যাদের মধ্যে ছিল তারা দায়িত্ব পালন করলেন না।

উল্টো বাঙালি জাতি দেখল ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সেনাবাহিনী প্রধান, বিডিআরপ্রধান, পুলিশ প্রধান থেকে শুরু করে বিমানবাহিনী প্রধান নৌবাহিনী প্রধান তারা বঙ্গভবনে গিয়ে ওই হত্যাকারী সরকারের প্রতি আস্থা জানিয়ে বক্তব্য দিলেন। কাজেই বিভ্রান্তি শুধু এখানে নয়। বিপরীতে কি দেখা গেল, বিপরীতে দেখা গেল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব হিসাবে পরিচিত যারা তারা কেউ কিন্তু একটা প্রতিরোধের ডাক দিলেন না। নয়তো ওদের সেদিন ভীরুতা ছিল। নয়তো কাপুরুষতা ছিল, নয় দোদুল্যমানতা ছিল, নয় আত্মসমর্পণের প্রবণতা ছিল? নতুবা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল, হত্যাকাণ্ডে পিছনের দরজার সঙ্গে জড়িত ছিল। কাজেই আজকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে আসার আগ পর্যন্ত আমরা কিন্তু বাংলাদেশে এতিমের মতো রাজনীতি করেছিলাম। আমরা কিন্তু একটা অনিশ্চয়তার পথে রাজনীতি করেছি।

সেই অনিশ্চয়তার পথটা কি ছিল? সেই অনিশ্চয়তা আমাদের কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, কে দেবেন, কে করবেন? আমরা কিন্তু বুঝতে পারিনি। কার কাছে বলে কি বিপদে পড়ি, কোন মহাবিপদে পড়ি, কে কোথায় লিঙ্কআপ হয়ে আছে, এটি আমাদের মধ্যে সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায়? এই অবস্থাতেই আমরা কিন্তু ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছি। এই যে পিছনের ষড়যন্ত্র? বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বিদেশে ছিলেন সেই কারণে বেঁচে গেলেন, শেখ হাসিনা ছিলেন বলে তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি করা হল।

শেখ হাসিনা বেঁচেছিলেন বলে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এলেন এবং আমরা আমাদের বুক ভরা একটা প্রত্যাশার জায়গা সৃষ্টি হলো। আমরা নতুন করে স্বপ্ন দেখলাম। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগকেও, শেখ হাসিনাকেও কিছু মানুষ আছে যারা তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। শান্তিতে দল করতে পারেনি। সেইগুলি খুঁজুন, সেইগুলো দেখুন, সেইগুলো কারা?

সারাবাংলা: কথিত আছে খন্দকার মোশতাক ছাড়াও আপনাদের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন অনেক নেতা পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে? এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

জাহাঙ্গীর কবির নানক: ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিল। তিনি তো তখন বিদেশে ছিলেন। কই তিনি তো বিদেশে বসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি করেন নাই। তিনি তো একটি বিবৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান নাই। এমন কি বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে যখন জার্মানিতে ছিলেন শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদের বিদেশে থাকার সুবাদে। সেই ড. কামাল হোসেন কিন্তু একবারের জন্য বঙ্গবন্ধুর এই বেঁচে থাকা দুই কন্যা শেখ হাসিনা-শেখ রেহানাকে একবারের জন্য একটা টেলিফোন করেও খবর নেন নাই। আমরা যদি হাঁটে হাড়ি ভেঙে দেই, আমরা যদি আমাদের মুখ খুলি তাহলে অনেকের চেহারা উদঘাটন হয়ে যাবে। তারা কত কুৎসিত, তারা কতভাবে এই খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল।

কাজেই আজ সময় এসেছে যখন বঙ্গবন্ধুর সরাসরি হত্যাকারী যারা তাদের যখন বিচার হয়েছে, বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে। তখন আমি একজন কর্মী হিসাবে, আমি একজন নাগরিক হিসাবে আমিও এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা জড়িত ছিল যাদের ব্যর্থতা ছিল এদেরও মুখোশ উন্মোচন চাই। এদের চিহ্নিত করতে চাই। সেই কারণে আমাদের দাবি হলো, ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি করে মূল আসল রহস্য উদঘাটন করা উচিত।

সারাবাংলা: স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করে বিএনপিসহ অনেকে। এবিষয়ে আপনার মতামত কি?

জাহাঙ্গীর কবির নানক: ইতিহাস বিকৃতি, এটি তো ১৯৭৫’র ১৫ আগস্টের ঘটনাই ছিল। স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি পাক-চীন-মার্কিন শক্তি; তাদের উদ্দেশ্যই ছিল তারা এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারে নাই। তারা পরাজয়কে মেনে নিতে পারে নাই বলে তারা যে পরাজিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে। তারা কিন্তু এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারে নাই। কাজেই পাক-চীন-মার্কিন শক্তি, এই শক্তি কিন্তু ১৫ আগস্টের ঘটনায় কে কতখানি জড়িত ছিল আন্তর্জাতিকভাবে সেই বিষয়গুলোও দেখা দরকার।

দেখার ব্যাপার হলো, মুক্তিযুদ্ধের ভিতরে যারা ঘাপটি মেরে আইএসআইয়ের এজেন্ট হিসাবে, পাকিস্তানি অনুচর হিসাবে ছিল তারা কিন্তু একসঙ্গে। আপনি দেখবেন, ১৫ আগস্ট ঘটনার পরে কিন্তু ‘জয়বাংলা’ স্লোগান হয় নাই। বিদ্রোহীরা কিন্তু জয়বাংলা স্লোগান দেয় নাই। বিদ্রোহীরা থেকে জেনারেল জিয়া থেকে শুরু করে জেনারেল এরশাদ থেকে শুরু করে সবাই কিন্তু ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়েছে। অর্থ্যাৎ পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা বুক ফুলিয়ে বের হয়েছে। তারা ভেবেছিল আবার একটি বাংলাদেশ এসেছে যে বাংলাদেশটি পাকিস্তানের আরেকটি ডুপ্লিকেট কপি হয়েছে। পাকিস্তান আবার ফিরে এসেছে।

কাজেই ১৫ আগস্টের খুনের সঙ্গে জড়িত যে শক্তি, সে শক্তি কিন্তু ছোট শক্তি ছিল না। তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বি ছিল। সেই যোগাযোগের মধ্য দিয়েই কিন্তু তারা এই অঘটন ঘটিয়েছে। কাজেই এই বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর যে ষড়যন্ত্র তার সব নীল নকশাই তৈরি হয়ে গিয়েছিল এবং এটাকে মিনি পাকিস্তান বানিয়ে ফেলেছিল। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা। সেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিয়ে গেল। যারা নিয়ে গেল তাদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের একটি কার্বন কপি। পাকিস্তানের সঙ্গে একটি কনফেডারেশন তৈরি করা। যাই হোক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালির জাতীয় জাগরণের কারণে কিন্তু সেই স্বপ্ন তাদের বাস্তবায়িত হয় নাই। হয়নি বলেই আজ বাংলাদেশ এক নতুন অবয়বে নতুনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর দর্শন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য।

সারাবাংলা: ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর আপনারা যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে মাঠে-ঘাটে কাজ করেছেন? তখনকার সেই সময়ে কাজটা কতটা কঠিন ছিল এবং আপনাদের মাঝে কি আশা ছিল একদিন এই বাংলার মাটিতে জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচারের হবে?

জাহাঙ্গীর কবির নানক: ১৫ আগস্টের পর আমরা ঘুরে বেড়াতাম গ্রামান্তরে। তখন এই পঞ্চগড় থেকে শুরু করে তেঁতুলিয়া রূপসা-পাটুরিয়া পর্যন্ত আমরা যেখানেই গেছি, সেখানেই আওয়ামী লীগার বা বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরেছে যখন শুনেছে আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে কাজ করছি। তারা বলেছে, বাবারে আমরা কি দেখে যেতে পারবো বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। আমরা কি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারটা কি দেখে মরতে পারবো। তাহলে পরে শান্তিতে মরতে পারতাম। আজকে ৪৬ বছর অতিক্রম করছে, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি আহাজারি করে নেত্রীর কাছে আবেদন করতে চাই, ‘আপনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং বিচারের রায় কার্যকর করেছেন। আপনার নেতৃত্বেই ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি হয়ে আমরা এর পিছনের কুশীলবদের বের করেছেন এটা দেখে আমরা মরতে চাই।

সারাবাংলা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

জাহাঙ্গীর কবির নানক: সারাবাংলাকেও ধন্যবাদ।

সারাবাংলা/এনআর/এমও

আওয়ামী লীগ কুৎসিত রূপ জাহাঙ্গীর কবির নানক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর