বৈদ্যুতিক ট্রেনের যুগে বাংলাদেশ, রোববার ট্রায়াল রান
২৮ আগস্ট ২০২১ ২১:৩৩
ঢাকা: বৈদ্যুতিক ট্রেনের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রোববার (২৯ আগস্ট) দেশের প্রথম মেট্রোরেলে পরীক্ষামূলকভাবে চলবে ট্রেন। এদিন ট্রায়াল রান হবে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মিরপুরের পল্লবী পর্যন্ত। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির (ডিএমটিসিএল) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারিগরি ও নিরাপত্তাসহ খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ট্রায়ালের জন্য ট্রেনগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে। রোববার সকাল ১০টায় ডিএমটিসিএল’র উত্তরা ডিপোতে ট্রায়াল উদ্বোধন করবেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
ডিএমসিটিএলর তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর যানজট নিরসনের পাশাপাশি গণপরিবহন ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে ২০১৬ সালে সরকার হাতে নেয় মেট্রোরেল প্রকল্প। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে আলোর মুখ দেখতে চলেছে মেট্রোরেল। গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত মেট্রোরেলের লাইন নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ৬৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে দিয়াবাড়িতে ডিপোর ভেতরে রেলপথ স্থাপনসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজই শেষ হয়েছে। বৈদ্যুতিক ওয়্যারিংয়ের কাজও শেষ পর্যায়ে। ১৭টি স্টেশনের বেশ কয়েকটির কাজ শেষ। বাকিগুলো চলমান। এছাড়া ভায়াডাক্টের ওপরে মূল রেলপথে ১৫ দশমিক ৫০ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক ওয়্যারিংও শেষ হয়েছে।
অন্যদিকে, চারটি মেট্রো ট্রেন সেট ডিপোতে চলে এসেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় সেটের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এখন দিয়াবাড়ি থেকে পল্লবী পর্যন্ত ট্রায়ালের অপেক্ষায়। ভায়াডাক্টের ওপরে ট্রায়াল সফল হলে এই দুই সেট ট্রেন যাত্রী চলাচলের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে। আর এর মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক ট্রেনের যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।
যেটুকুতে প্রথম পর্যায়ে মেট্রোরেল চালু হচ্ছে তাতে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের দরকার হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এ বিদ্যুৎ সরাসরি গ্রিড লাইন থেকে সরবরাহ করা হবে। এর ব্যবস্থাপনায় থাকবে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। পিজিসিবি ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডেসকো, ডিপিডিসি মিলে বিদুৎ সরবরাহ করবে মেট্রোরেলে। পিজিসিবি মূল কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনায় থাকবে। এই প্রকল্পে পিজিসিবির যে অংশ রয়েছে তা ইতোমধ্যে শেষ। বর্তমানে মতিঝিলের দিকে কাজ চলছে।’
তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেল বিদ্যুতের সাহায্যে পরিচালিত হওয়ায় ডিজেলের ব্যবহার কমবে, কমবে কার্বন নিঃসরণ। ফলে এটি হবে পরিবেশ সম্মত গণপরিবহন।’
বাংলাদেশ রেলওয়ের অধীনে বর্তমানে প্রায় তিনশ ট্রেন পরিচালিত হচ্ছে। ট্রেনগুলোতে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো বিদ্যুতের সাহায্যে ট্রেন পরিচালনা করতে মেট্রোরেল তৈরির উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে গঠন করা হয় ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট লিমিটেড কোম্পানি (ডিএমটিসি)। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল চলাচলের জন্য পথ নির্মার্ণে জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। যদিও পরে তা কমলাপুর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে আপাতত মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। এ পথে চলবে ২৪ জোড়া ট্রেন। ট্রেনগুলো যাত্রী তুলবে ও নামাবে ১৭টি স্টেশনে। জানা গেছে ইতোমধ্যে চার সেট ট্রেন বাংলাদেশে পৌঁছেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রেন সেট পুরোপুরি তৈরি। এখন পরীক্ষামূলক চলাচল করবে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ পর্যায়ের ট্রেনসেট আগামী দুই মাসের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
ডিএমটিসিএল’র ব্যবস্থাপক এ বি এম আরিফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শুক্রবার ভায়াডাক্টের ওপরে মেট্রোরেলের এক দফা পরীক্ষামূলক ট্রায়াল করি। সেখানে মূলত ট্রেনের নিরাপত্তা, কারিগরি বিষয়গুলো দেখাই লক্ষ্য ছিল। সেটা আমরা চেক করেছি। রোববার আমরা মূল পরীক্ষামূলক প্রদর্শন করব। উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে পল্লবী পর্যন্ত। এ অংশের কাজ পুরোপুরি কমপ্লিট। এরপর এটি যাত্রী পরিবহনের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য অনুযায়ী উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু করা। সে লক্ষ্যে কাজ এগিয়ে চলছে।’
এদিকে, উত্তরা থেকে মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট এমআরটি লাইন-৬ নামে পরিচিত প্রকল্পের কাজ চলছে পুরোদমে। তবে উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার রেলপথ এখন পুরোপুরি দৃশ্যমান। আসছে ডিসেম্বরে এই অংশ চালুর কথা থাকলেও মহামারি করোনার কারণে কাজে কিছুটা ধীরগতি নেমে আসে। যে কারণে ডিসেম্বরের টার্গেট থেকে কিছুটা সরে এসেছে ডিএমটিসিএল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেল চালু হলে রাজধানীর যানজট বহুলাংশে কমে যাবে। তবে নির্মার্ণের পাশাপাশি এর ব্যবস্থাপনা টেকসইয়ের পরামর্শ তাদের। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজধানী ঢাকায় এ পর্যন্ত যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে তা সব ছোট যানবাহনের জন্য। যেমন ফ্লাইওভার, রাস্তা চওড়া করা ইত্যাদি। কিন্তু গণপরিবহন সম্পর্কিত যা পরিকল্পনা ছিল যেমন- বাসগুলোকে সকলের চলাচলের উপযোগী করা, সুশৃঙ্খল করা, পথকে পথচারী বান্ধব করা, সড়কগুলোকে কোম্পানি বেইজড চালানো- এসব কখনও হয়নি। যে কারণে মানুষ কখনও বাসে ওঠার পরিবেশ পায়নি। ফলে যে যার সাধ্য মতো গাড়ি কিনেছে। এতে সড়কে গাড়ি বেড়েছে, কিন্তু রাস্তা বাড়েনি। ফলে যানজট আরও তীব্র হয়েছে। এই জট খোলার পথ তৈরি করবে মেট্রোরেল।’
তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেল চালু হলে মানুষ যখন সেটি ব্যবহার করবে তখন রাস্তায় গাড়ি কম নামবে। এতে যানজট কমবে। তবে মেট্রোরেল সবসময় সবার কাজে আসবে না। কারণ এটি নির্দিষ্ট একটা লাইনে চলবে। সবার গন্তব্যও এক হবে না।’
উল্লেখ্য, এমআরটি-৬ শেষ করার কথা ছিল ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রাজধানীর আগারগাঁও পর্যন্ত শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে মেট্রোরেল লাইন স্থাপনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংক্রমিত হলে সময় সীমার কিছুটা ব্যতয় ঘটে।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম