‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আইন-আদালত বলে কিছু নেই’
২৮ আগস্ট ২০২১ ২১:৪১
ঢাকা: বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলে এই মুহূর্তে দেশে আইন-আদালত নেই বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগীয় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ আইন-আদালত বলে কিছু নেই। তাই ক্রসফায়ার, গুমের মতো ঘটনা অহরহ আমরা দেখতে পাই, যেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনী যাকে গুলি করতে চায় তাকেই মেরে ফেলতে পারে। ক্রসফায়ারের পর এই সব রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিবৃতি যে মিথ্যা, তা সমাজের সবাই জানে।
শনিবার (২৮ আগস্ট) সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হল রুমে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। ‘নারীর বিরুদ্ধে মোরাল পুলিশিং, গণমাধ্যমের অসংবেদনশীলতা এবং আইন ও বিচার বিভাগে পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে আমরা’ শীর্ষক গোলটেবিলটি আয়োজন করে নারীদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম স্ফুলিঙ্গ। এই অনুষ্ঠান থেকেই এই প্ল্যাটফর্মটি আত্মপ্রকাশ করে।
স্ফুলিঙ্গের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, গণমাধ্যম নারীবিদ্বেষী এসব সংবাদ পরিবেশন করে মূলত জনমত তৈরি করতে, যা এরই মধ্যে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালা দিয়ে সমাজে প্রচলিত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, একজন গার্মেন্টস শ্রমিক নারীকে মজুরি কম দেওয়া এবং এ সংক্রান্ত প্রতিবাদ থামানো সহজ হয় যখন তার ব্যক্তিগত চরিত্রকে উন্মুক্ত করে তার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডামূলক তথ্য প্রচার করা হয়।
বৈঠকের শুরুতেই কর্মসূচির অবস্থানপত্র পাঠ করেন স্ফুলিঙ্গের সদস্য পূরবী তালুকদার। বৈঠকটি যৌথভাবে সঞ্চালনা করে স্ফুলিঙ্গের সদস্য মোশফেকা আরা শিমুল এবং ইশরাত জাহান উর্মি।
তারা বলেন, আগের বছরগুলোতে সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, নারীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোরাল পুলিশিং এবং গণমাধ্যমে নারীর ব্যক্তিগত জীবনকে উন্মুক্ত করে কেলেঙ্কারিকরণের সংবাদ প্রচার করে সমাজের প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক জনমতকে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। তাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রভাবশালীদের অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি বিচার বিভাগের বিশেষ ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে নারীদের নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার বিষয়টিও প্রায়ই সামনে চলে আসছে। স্ফুলিঙ্গ মনে করে, একটি রাষ্ট্র ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ দিনের অগণতান্ত্রিক এবং পুরুষতান্ত্রিক চর্চাই নারীর বিরুদ্ধে এই অন্যায্যতা তৈরি করছে।
বৈঠকে আলোচক হিসেবে সশরীরে উপস্থিত ও ভার্চুয়াল মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন প্রায় ৪০ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা নীরা, আইনজীবী সুলতানা আক্তার রুবি, আলোকচিত্রী ও বাংলাদেশ সাম্যবাদী আন্দোলনের সদস্য জান্নাতুল মাওয়া, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের সম্পাদক খান আসাদুজ্জামান মাসুম, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য লুনা নুর, নারী মুক্তি কেন্দ্রের ঢাকা নগরের সভাপতি তাসলিমা বিউটি, বিপ্লবী নারী ফোরাম ঢাকা নগরের সদস্য আমেনা আক্তার, আইনজীবী তাসমিয়াহ নুহাইয়া আল আমিন, কথা সাহিত্যিক নুরন্নবী শান্ত, কবি ও সাংবাদিক রহমান মুফিজ, উন্নয়নকর্মী ফেরদৌস আরা রুমী, ওয়াইডাব্লিউসি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জেসমিন দিনা উল্লেখযোগ্য।
বৈঠক চলাকালীন অনলাইন মাধ্যমে যুক্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সানজিদা নীরা বলেন, পাঠক বা সার্কুলেশন বাড়াতে গণমাধ্যম নারীদের নিয়ে অসংবেদনশীল সংবাদ পরিবেশন করে। বিজ্ঞাপনের কাটতি বাড়াতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও নারীদের অসংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করে থাকে। নারীকে এভাবে উপস্থাপন না করেও যে গণমাধ্যম চলতে পারে, এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আলোকচিত্রী ও বাংলাদেশ সাম্যবাদী আন্দোলনের সদস্য জান্নাতুল মাওয়া সাংবাদিকতাও করেছেন। ওই সময়কার একটি ঘটনা তিনি গোলটেবিল বৈঠকে উল্লেখ করেন। বলেন, তিনি যে গণমাধ্যমে কাজ করতেন, সেখান থেকে তাকে একবার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীর বিরুদ্ধে অসংবেদনশীল সংবাদ প্রকাশ করতে বলা হয়েছিল। জান্নাতুল মাওয়া সেটি করতে অপারগতা জানিয়ে নিজ দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য লুনা নুর বলেন, সংবেদনশীলতা ও অসংবেদনশীলতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একজন নারীর অধিকারের বিষয়টি। সমাজে যেকোনো দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনস্তত্ত্বের মানুষ নারীর এই অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে না।
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে আইনজীবী সুলতানা আক্তার রুবি ১৯৯৫ সালের ইয়াসমিন ট্র্যাজেডির ঘটনাটি স্মরণ করে বলেন, ইয়াসমিনের ন্যায় বিচারের দাবিতে তখন একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সারাদেশের সামাজিক আন্দোলন, জনমানুষের আন্দোলন ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে ন্যায় বিচারপ্রাপ্তি সম্ভব করেছিল। আমাদের এখন সেই গণতান্ত্রিক পরিবেশটিই নেই।
বৈঠকে নারীর বিরুদ্ধে মোরাল পুলিশিং, গণমাধ্যমের অসংবেদনশীলতা এবং আইন ও বিচার বিভাগে পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে স্ফুলিঙ্গের পক্ষ থেকে ৮ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো—
১. গণমাধ্যমকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে হবে;
২. আইনের অপব্যবহার করে নাগরিকের ব্যক্তি পরিসরে ঢুকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে;
৩. প্রতিটি গণমাধ্যম ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নারীর বিরুদ্ধে অসংবেদনশীল আচরণ, শব্দ চয়ন ও ছবি ব্যবহার বন্ধ করতে হবে;
৪. গণমাধ্যমে নারীর বিরুদ্ধে অসংবেদনশীল সংবাদ পরিবেশন, শব্দ চয়ন ও ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে;
৫. প্রতিটি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীকে উল্লেখিত নীতিমালা বিষয়ে অবগত করতে হবে এবং জেন্ডার সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে;
৬. নারীর বিরুদ্ধে সমাজের প্রচলিত মোরাল পুলিশিংয়ের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকতে হবে;
৭. নারীর সহিংসতা সংক্রান্ত অভিযোগ স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে হবে। এসব অভিযোগে তদন্ত না করে অভিযুক্তকে আইনি প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে না; এবং
৮. বিচার বিভাগকে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ করতে হবে।
সারাবাংলা/আরএফ