মহামারি-যোদ্ধা একজন ড. ফেরদৌসী কাদরী
৩১ আগস্ট ২০২১ ২৩:২৯
সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, ইমিউনোলোজি এবং ভ্যাকসিন উন্নয়ন ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অবদান রাখায় এশিয়ার নোবেলখ্যাত র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার ২০২১ পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী। কলেরা ও টাইফয়েড— এই দু’টি রোগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এই জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী।
এশিয়ায় দারিদ্র্য বিমোচন ও সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখা ব্যক্তিদের প্রতিবছর এই ম্যাগসাইসাই পুরস্কার দেওয়া হয়। ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট র্যামন ম্যাগসাইসাইয়ের স্মরণে ১৯৫৭ সালে পুরস্কারটি প্রবর্তন করা হয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে গত বছর এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়নি। এক বছর বিরতি দিয়ে ফের এ বছরের জন্য এই পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট)। তাতেই উঠে এসেছে ফেরদৌসী কাদরীর নাম।
ড. ফেরদৌসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরে ১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন/প্রতিষেধকবিদ্যা বিভাগ থেকে অর্জন করেন পিএইচডি ডিগ্রি। ১৯৮৮ সালে সহযোগী বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি যোগ দেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) প্রতিষেধকবিদ্যা বিভাগে। পরে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং মিউকোসাল ইমিউনোলজি অ্যান্ড ভ্যাকসিনোলজি বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।
আরও পড়ুন- র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেলেন বাংলাদেশের ফেরদৌসী কাদরী
শুরু থেকেই বাংলাদেশি এই বিজ্ঞানী চিকিৎসাবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত গবেষণা নিয়ে কাজ করে আসছেন। এ ধরনের গবেষণা কার্যক্রমকে বিশেষায়িত করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। সংক্রামক রোগ, রোগতত্ত্ব, ভ্যাকসিন ও এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ে কাজ করেন।
র্যামন ম্যাগসাইসাই ফাউন্ডেশন বলছে, ড. ফেরদৌসী কলেরা ও টাইফয়েড প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এই রোগগুলো বাংলাদেশ তথা এশিয়া ও আফ্রিকার বেশিরভাগ দরিদ্র দেশের মানুষের জন্য বড় ধরনের সমস্যা। এসব দেশে নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার সুযোগ স্বল্পতা রয়েছে। এক্ষেত্রে ড. ফেরদৌসী কাদরী কলেরার মুখে খাওয়ার ভ্যাকসিন (ওসিভি) উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
শিশু ও বয়স্কদের জন্য টাইফয়েডের ভ্যাকসিন উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে ড. কাদরীর। শুধু তাই নয়, ৯ মাস বয়সী নবজাতকদের জন্যও এই রোগের এই প্রতিষেধক উন্নয়নে অবদান রয়েছে তার। কলেরা মহামারি নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সাশ্রয়ী মূল্যের ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশি এই বিজ্ঞানী কাজ করে চলেছেন।
কলেরা প্রতিরোধে মুখে খাওয়ার নতুন ও সাশ্রয়ী মূল্যের ভ্যাকসিন ‘স্যাংকল’-এর সম্ভাব্যতা নিয়ে ২০১১ সালে বড় ধরনের একটি গবেষণা চালিয়েছে আইসিডিডিআর,বি’র একটি গবেষক দল। সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন ড. ফেরদৌসী। সেই গবেষণা কাজের অংশীদার ছিল মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের ফাউন্ডেশন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
ওই গবেষণায় উঠে আসে, সাশ্রয়ী মূল্যের ওই ভ্যাকসিন দরিদ্রদের জন্য ও শহুরে পরিবেশে কলেরার বিস্তার রোধে কার্যকর হতে পারে। ভ্যাকসিনটি কলেরার বিরুদ্ধে ৫০ শতাংশের বেশি সুরক্ষা দিয়েছে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেও সমানতালে কাজ করে গেছেন ড. ফেরদৌসী। দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা, ভ্যাকসিনের ট্রায়াল ও এ সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে ইনস্টিটিউট ফর ডেভলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভ অ্যান্ড হেলথ সার্ভিসেস (আইদেশি) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ড. ফেরদৌসী। বায়োমেডিকেল বিষয়ক গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানটি দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীদের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের যে কয়েকটি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স হয়েছে, তার বড় একটি অংশ হয়েছে এই কেন্দ্রে।
এর আগে, ২০২০ সালে তিনি ‘লরিয়েল-ইউনেস্কো উইমেন ইন সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড’ (এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল) লাভ করেন ড. ফেরদৌসী। উন্নয়নশীল দেশে শিশুদের সংক্রামক রোগ চিহ্নিতকরণ ও বিশ্বব্যাপী এর বিস্তার রোধে প্রাথমিক চিকিৎসা কার্যক্রম এবং ভ্যাকসিন প্রয়োগ কর্মসূচি জোরদারে উল্লেখযোগ্য অবদানের রাখায় তাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এছাড়া সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি বিজ্ঞান সাময়ীকিতে চলতি বছর এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় তিনি স্থান পান।
কেবল নিজের গবেষণাকর্মই নয়, তরুণ বিজ্ঞানীদেরও গবেষণাকাজে উৎসাহিত করছেন ড. ফেরদৗসী কাদরী। তরুণ গবেষকদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিতে ভালোবাসেন তিনি। দেশের সুপরিচিত বিজ্ঞানীদের সংস্পর্শে যেন তরুণরা এসে শিখতে পারেন, সে সুযোগও তিনি যথাসম্ভব তৈরির চেষ্টা করেন। দেশ পর্যায়ে স্থানীয় সক্ষমতা গড়ে তোলাই তার বড় লক্ষ্য। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের যেন বিদেশে যেতে না হয়, সে জন্য দেশের ল্যাবরেটরিগুলোর আধুনিকায়নেও তিনি সচেষ্ট।
র্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি বোর্ড বলছে, ড. কাদরী বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিবেদিত একজন বিজ্ঞানী। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানী, বিশেষ কওরে নারী বিজ্ঞানীদের জন্য তিনি অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। ভ্যাকসিন, উচ্চতর জীবপ্রযুক্তি ও গবেষণা প্রসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। এর মাধ্যমে লাখো মানুষের জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখছেন। তার এমন অনবদ্য কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতি হিসেবেই ফাউন্ডেশন তাকে এ বছরের র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে ভূষিত করেছে।
এর আগে, মঙ্গলবার দুপুরে এ বছরের জন্য র্যামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড ঘোষণা করা হয়। ড. ফেরদৌসী কাদরীর সঙ্গে এ বছর এই পুরস্কার পেয়েছেন পাকিস্তানে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ করা মুহাম্মদ আমজাদ সাদিক, উদ্বাস্তুদের সহায়তায় কাজ করা মানবাধিকার কর্মী স্টিভেন মানসি ও ফিলিপাইনের মৎস্যজীবী রবার্তো ব্যালস। এ বছর প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ পুরস্কার জিতে নিয়েছে ইন্দোনেশিয়ার প্রোডাকশন হাউজ ওয়াচডক।
সারাবাংলা/আরআইআর/টিআর