করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর ‘প্রধান কারণ’ বিধিনিষেধ ভেঙে ঢাকা ত্যাগ
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২১:১৫
ঢাকা: ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো তিন জনের শরীরে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণ প্রতিরোধে ১৮ দিন পরই ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ওই সময় থেকেই জনচলাচল যথাসম্ভব সীমিত রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে ২৩ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরপরেই রাজধানী ঢাকা থেকে মানুষের ঢল নামে গ্রামের পথে। সম্প্রতি পরিচালিত যৌথ এক গবেষণার তথ্য বলছে, সরকারি বিধিনিষেধ ভেঙে এভাবে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কারণেই দেশে করোনা সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ‘জিনোমিকস, সোস্যাল মিডিয়া অ্যান্ড মোবাইল ফোন ডেটা এনাবল ম্যাপিং অব সার্স-কোভ-২ লিনিয়েজেস টু ইনফর্ম হেলথ পলিসি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণাটি বিখ্যাত ব্রিটিশ জার্নাল ‘ন্যাচার’-এ প্রকাশিত হয়েছে। একটি জিনোমিক কনসোর্টিয়ামের আওতায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), আইসিডিডিআর,বি এবং আইদেশিসহ দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে গবেষণাটি পরিচালনা করে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রবেশ, দেশব্যাপী বিস্তৃতি ও করোনাভাইরাস বিস্তার প্রতিরোধে বিভিন্ন সময়ে বিধিনিষেধ, কঠোর বিধিনিষেধ এবং জনসাধারণের গতিবিধির ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।
আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবি, আইদেশি, বাংলাদেশ সরকারের এটুআই প্রোগ্রাম, যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্যাঙ্গার জিনোমিক ইনস্টিটিউট, হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ এবং ইউনিভার্সিটি অব বাথের বিজ্ঞানীদের যৌথ উদ্যোগে ২০২০ সালের মার্চ মাসে এই গবেষণাটি শুরু হয়।
গবেষণাপত্রে জানানো হয়েছে, ২৩ মার্চ থেকে ২৬ মার্চের মধ্যে জনসাধারণের ঢাকা ছাড়ার তথ্যের সঙ্গে সার্স-কোভ-২ জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, এই সময়সীমায় ঢাকা থেকে বহির্মুখী যাতায়াতই মূলত দেশব্যাপী করোনাভাইরাস বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ।
এছাড়াও জিনোম সিকোয়েন্সিং বিশ্লেষণ থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য উদ্ভব হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে। পরবর্তী সময়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের মাধ্যমে আরও ভাইরাসের অনুপ্রবেশ ঘটে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের এপ্রিলে কনসোর্টিয়াম ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে সংগৃহীত আরও ৮৫টি সার্স-কোভ-২ নমুনা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৩০টি ছিল লিনিয়েজ বি.১.১.২৫ (৩৫ শতাংশ), ১৩টি ছিল আলফা ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭, ১৫ শতাংশ), ৪০টি ছিল বিটা ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১, ৪৭ শতাংশ), একটি ছিল লিনিয়েজ বি.১.১.৩১৫, এবং একটি ছিল লিনিয়েজ বি.১.৫২৫।
গবেষণা বিষয়ে আইসিডিডিআর,বি’র জেষ্ঠ্য বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী বলেন, পৃথিবীজুড়েই বিভিন্ন দেশে কয়েক মাস পর মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু ভ্যারিয়েন্ট ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করছে দেশের সব মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসার। এই ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা বোঝার জন্য আমাদের এ ধরনের কাজ অব্যাহত রেখে সরকারকে সময়মতো সঠিক তথ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করতে হবে।
গবেষণায় যুক্ত ড. লরেন কাউলি বলেন, জিনোমিক ও মোবিলিটির বিভিন্ন ডাটা স্ট্রিম একত্রিত করে আমরা কীভাবে করোনাভাইরাস বাংলাদেশের ছড়িয়ে পড়েছিল, তা বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছি। এই গবেষণাটিতে মহামারি প্রতিরোধে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কার্যকারিতা দেখানো হয়েছে, যা ভবিষ্যতে অন্যান্য মহামারির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।
হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক ক্যারোলিন বাকি বলেন, মোবিলিটি ডাটা, প্রথাগত চলমান সার্ভেইল্যান্স সিস্টেমের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, এ ধরনের একটি মিলিত বিশ্লেষণধর্মী গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে কতটা মূল্যবান ভূমিকা রাখতে পারে, যা অন্য কোনো উপায়ে অর্জন করা কঠিন।
তিনি বলেন, এ ধরনের গবেষণা কেবল চলমান করোনাভাইরাস মহামারির ক্ষেত্রেই নয়, ভবিষ্যতের যেকোনো মহামারি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, আমাদের এই কনসোর্টিয়াম বিভিন্ন সময়ে নীতিনির্ধারকদেরকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সহায়তা করে থাকে। সীমান্তবর্তী এলাকায় জনসাধারণের চলাচল নিষিদ্ধ করা, পরিবহন ও যানবাহন চলাচলে সীমাবদ্ধতা আনা, বাধ্যতামূলক কোয়ারেনটাইন এবং যেসব দেশে উদ্বেগজনক ভ্যারিয়েন্ট ছিল সেখান থেকে আসা ভ্রমণকারীদের সাধারণ মানুষদের থেকে আলাদা রাখা, সময়মতো লকডাউনের সিদ্ধান্ত বা প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক চলাচল সীমাবদ্ধ করা— এসব তথ্য এই কনসোর্টিয়াম থেকে পাওয়া গেছে।
গবেষণায় ফেসবুক ডেটা ফর গুড, গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি আজিয়াটা লিমিটেড জনসংখ্যা মোবিলিটি তথ্য সরবরাহ করেছে। অন্যদিকে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, বাংলাদেশ সার্স-কোভ-২ নমুনার সিকোয়েন্সিংয়ে সহায়তা করেছে।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর