ইভানাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ‘প্রেমিকা’র সঙ্গে কথা বলতেন রুম্মান
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২২:৪৪
ঢাকা: ইংরেজি মাধ্যম স্কুল স্কলাসটিকার ক্যারিয়ার গাইডেন্স কাউন্সিলর ইভানা লায়লা চৌধুরীকে (৩২) তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, ইভানাকে তার স্বামী প্রতিদিন একটি করে ঘুমের ওষুধ খাওয়াতেন। কারণ, সেই ওষুধ খেয়ে ইভানা ঘুমিয়ে গেলে স্বামী আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান রুম্মান কথিত প্রেমিকার (সহকর্মী ব্যারিস্টার) সঙ্গে কথা বলতেন।
এক বছর ধরে বয়ে চলা মানসিক যন্ত্রণা, ডিভোর্সের হুমকি, স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতনের পাশাপাশি ঘুমের ওষুধ ইভানাকে আত্মহত্যার মতো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন তার বাবা এ এসএম আমান উল্লাহ চৌধুরী।
শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সারাবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। অনুসন্ধানকালে ইভানার পাঠানো একটি ই-মেইল, বান্ধবীর সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ের কপি এবং তার স্বামী আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান ওরফে রুম্মানের সঙ্গে প্রেমিকার কথোপকথনের কপি সারাবাংলার হাতে এসেছে। এছাড়া ইভানার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেও তাকে নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর অভিযোগের কথা জানা গেছে।
ইভানার পরিবারের সদস্যরা বলছেন, স্বামী রুম্মানের পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ার কথা জানার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ইভানা। এক পর্যায়ে শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অবহেলা-নির্যাতন ইভানাকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করেছে বলে অভিযোগ তাদের।
রুম্মানের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া নিয়ে ইভানা যে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, তা তিনি নিজেই বলছেন একজন বান্ধবীকে। ফেসবুক মেসেঞ্জারের কথোপকথনে ইভানা তার বান্ধবীকে বলেন, ‘এক মাস হলো আমি শারীরিকভাবে ভালো নেই। রুম্মান প্রতিদিন আমাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়। ওপরে ওপরে দেখায় সে আমাকে কেয়ার করছে। কিন্তু সে মূলত তার প্রেমিকার সাথে কথা বলার জন্যই আমাকে ঘুমের ওষুধ দেয়।’
ইভানা লিখেছেন, ‘প্রায় এক বছর হলো রুম্মান আমাকে এড়িয়ে চলে। গত বছরের ৫ আগস্ট আমি প্রথম তার সাথে প্রেমিকার কথোপকথনের মেসেজ দেখতে পাই। এটা দেখার পর সে আমার ওপর সব দোষ চাপায়। আর সে কারণে আমাদের বিয়েটারও সমাপ্তি ঘটাতে চায়।’
আরও পড়ুন-
ইভানা বিয়ের কিছু দিন পরই জানতে পারে, রুম্মানের সঙ্গে অন্য কোনো নারীর ‘সম্পর্ক’ রয়েছে। তবে বছরখানেক আগে তিনি বুঝতে পারেন, রুম্মানের সঙ্গে যে নারীর সম্পর্ক তিনিও পেশায় আইনজীবী। রুম্মানের মোবাইল ফোনে মেসেজ ও হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন থেকে ইভানা বুঝতে পারেন, ওই নারী ব্যারিস্টারও বিবাহিত।
এর মধ্যে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর ইভানা দেখতে পান, রুম্মান সকাল সাড়ে ৮টায় ‘প্রেমিকা’র রোমান্টিক মেসেজ পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারেন, প্রতিদিনই এ ঘটনা ঘটছে। এসব বিষয়ে রুম্মানের সঙ্গে কথা বলতে গেলে নানাভাবে গালিগালাজ করা হতো তাকে। এমনকি গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতেন রুম্মান। আর কথায় কথায় ডিভোর্সের হুমকিও দেওয়া হতো ইভানাকে।
গত ৩ মে ইভানা তার একজন সহকর্মীকে ই-মেইলে বার্তায় বলেন, ‘আমার দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। ছোট ছেলেটি অটিজমের শিকার। এবার তার স্কুল শুরু হবে। আমি যেন তাকে ভালোভাবে সময় দিতে পারি সেজন্য আমাকে চাকরিটা ছাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে রুম্মান। তাছাড়া এটা-ওটা নিয়ে রুম্মান সম্প্রতি আমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। সে বলে, আমাদের টাকার অভাব নেই। তোমাকে চাকরিটা ছাড়তে হবে এবং কোনো ধরনের যোগাযোগ করা যাবে না। কীভাবে কী করব এবং ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে বাচ্চাদের নিয়ে কীভাবে জীবন কাটাব, সবকিছুর পরামর্শের জন্য আপনার কাছে সহযোগিতা ও পরামর্শ চাই। অথবা সাক্ষাৎ না পেলে এ সংক্রান্ত কিছু লিংক বা কোনো বই দেবেন, যেগুলো পড়ে আমি উপকৃত হব। আর রুম্মানের সঙ্গে একান্তই যদি আমার ডিভোর্স হয়ে যায় তাহলে অন্তত ৩০ হাজার টাকার দরকার পড়বে প্রতি মাসে, যা দিয়ে দুই সন্তানসহ চলা সম্ভব হবে।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইভানা সন্তানদের নিয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য সংসার টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। এর জন্য নানাভাবে নানাজনের কাছে সহযোগিতা ও পরামর্শ চেয়েছেন। কিন্তু একদিকে ওষুধের প্রভাব, অন্যদিকে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অত্যাচারে মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়ছিলেন প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন রুম্মান ও তার প্রেমিকার কথোপকথন, মেসেজ, স্বামীর এড়িয়ে চলা এবং বারবার ডিভোর্সের হুমকি দেওয়া— সবকিছু মিলিয়ে মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েন ইভানা। আর এ পরিস্থিতিই তাকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হন বলে মনে করছেন তার পরিবারের সদস্যরা।
জানা যায়, ইভানার মরদেহ উদ্ধারের এক দিন আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বরও রুম্মানের আচরণে মানসিকভাবে আঘাত পেয়ে হাতের রগ কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান ইভানা। তবে তার সেই চেষ্টা সফল হয়নি। তাতে আরও মুষড়ে পড়েন তিনি। আত্মহত্যা করতেও ব্যর্থ হয়েছেন— এটি ভেবেও মানসিক পীড়ন অনুভবন করছিলেন। অভিযোগ মিলেছেন, আত্মহত্যার চেষ্টায় সফল না হওয়ায় সেদিনও ইভানাকে অনেক চাপ সহ্য করতে হয়েছে।
জানা যায়, বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকালেও রুম্মান ও তার মা-বাবা ইভানাকে বকাঝকা করেন। একদিন আগের আত্মহত্যাচেষ্টার বিষয়টি উল্লেখ করে তারা ‘কথা শোনান’ ইভানাকে। বলেন, ‘মারা যাওয়া কি এতই সোজা?’ এরকম আরও টিপ্পনি কেটে ইভানাকে মানসিকভাবে আঘাত করেন এবং উত্তেজিত করে তোলেন। পরে ইভানা ফোনে কথা বলতে বলতে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। পরে ওই সন্ধ্যাতেই পাওয়া যায় ইভানার মরদেহ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার বলেন, ‘ইভানার বাবার দেওয়া কোনো অভিযোগ এখনো আমরা পাইনি। পিতা হিসেবে তিনি অভিযোগ দিতেই পারেন। আরও কেউ অভিযোগ করতে পারেন। কে কী অভিযোগে করেছেন, তা দেখে সবকিছু আমলে নিয়ে আমরা তদন্ত করব। তবে এরই মধ্যে তদন্ত শুরু হয়ে গেছে। কেউ জড়িত থাকলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’
এর আগে, বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৬টার দিকে রাজধানীর শাহবাগ থানার নবাব হাবিবুল্লাহ রোডে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পেছনে) দু’টি ভবনের মাঝখান থেকে ইভানা লায়লা চৌধুরীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তখন থেকেই ইভানার মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে।
জানা যায়, তার স্বামী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ মাহমুদ হাসান ওরফে রুম্মানের আচরণ সন্দেহজনক। ঘটনার দিন রুম্মান কিংবা তার বাড়ির লোকজন কেউ সহযোগিতা করেনি। এমনকি ইভানা মর্গে থাকলেও তাদের কেউ হাসপাতালে যাননি। পরে ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর ইভানার মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে সারাবাংলার অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে।
সারাবাংলা/ইউজে/পিটিএম