৫ বছরের ‘মহাপরিকল্পনা’ শেষে অনুমোদনের পথে ড্যাপ
২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০০:০৮
ঢাকা: প্রতিটি ভবন হবে একই উচ্চতায়। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল হবে ওয়ার্ডভিত্তিক এবং পরিকল্পিত। থাকবে খেলার মাঠ, ঘুরে বেড়ানোর জন্য পার্ক। পুরো নগর ঘিরে থাকবে রিং রোড। ফলে যানজটের কোনো সুযোগই থাকবে না। যানবাহন চলবে নিয়ম মেনে। নগরীর ভেতরে তৈরি করা হবে নৌ-পথ। সেই পথে চলবে ওয়াটার বাস। মানুষের হাঁটার জন্য থাকবে বৃক্ষাচ্ছাদিত ফুটপাথ। দূষণ থেকে স্বস্তি পাবে নগরীর প্রাণ ও প্রকৃতি। এমন স্বপ্নের মতো এক শহর গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে প্রণয়ন করা হয় ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)।
কিন্তু রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে তৈরি ২০ বছর মেয়াদী এই উদ্যোগের অনুমোদন পেতেই কেটে গেছে পাঁচ বছর। ছিল নানাধরনের প্রতিবন্ধকতা। এবার সেই সব প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা পেছনে ফেলে আগামী চার মাসের মধ্যেই ড্যাপের গেজেট প্রকাশের কথা জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তবে এই ড্যাপের সঙ্গে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট অথরিটিকে সমন্বিত করে বাস্তবায়নের সুপারিশ নগর পরিকল্পনাবিদদের। তাহলেই ঢাকা পাবে উন্নত বিশ্বের রূপ।
ঢাকাকে ঘিরে যত পরিকল্পনা
ঢাকাকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯১৭ সালে। যদিও সে পরিকল্পনা বেশি দূর এগোয়নি। ১৯৫৩ সালে এসে যে পরিকল্পনাটি করা হয়, সেখানে কিছু অঞ্চলকে ভাগ করে দেওয়া হয়। পরিকল্পনায় বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সময় ঢাকাকে কেন্দ্র করে করা হয় ১৯৫৯ থেকে ২০ বছর মেয়াদী একটি মাস্টারপ্ল্যান। সেটির মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে ‘ঢাকা মহানগরী এলাকার সমন্বিত পরিকল্পনা’ করা হয় ১৯৮১ সালে। ১৯৯৫-২০১৫ সাল র্পযন্ত প্রণয়ন করা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন প্ল্যান (ডিএমডিপি)। রাজউকের তৈরি করা এই পরিকল্পনা অনুমোদন পায় ১৯৯৭ সালে। ১৯৯৫ -২০১৫ করা ডিএমডিপির আলোকে ২০১০ সালে তৈরি করা হয় ‘ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান’। এই প্ল্যান বাস্তবায়নে তৈরি করা হয় ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)। যার সংশোধন চলছে এখন। গত পাঁচ বছরে এটি নানাভাবে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে আগের উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করা যায়নি। যে কারণে এটি যুগোপযোগী করার প্রয়োজনীতা দেখা দিয়েছে।
নতুন পরিকল্পনায় যা থাকছে
নতুন ড্যাপ ২০ বছরের জন্য তৈরি করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও এর আশেপাশের এরিয়া ধরে মোট এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার ভূমি নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে ঢাকাকে একটি মানবিক ও দৃষ্টিনন্দন শহর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। যার মূল লক্ষ্য আর্থ সামাজিক শ্রেণি পেশার মানুষের প্রয়োজন ও জীবনযাত্রাকে উন্নত করা। জনঘনত্ব বিন্যাস পরিকল্পনার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ভূমি ব্যবহারে উৎসাহ, নৌপথের সমন্বয়ে ব্লু নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা এবং অবকাঠামোর সার্বিক রূপান্তর করে নগরজীবন প্রতিষ্ঠা করা- এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে পাঁচটি ধাপ অনুসরণে তৈরি করা হয়েছে ড্যাপ।
প্রস্তাবিত ড্যাপে রাজউকের আওতায় মোট এক হাজার ৫৮২ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ৪৬৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে থাকবে ১৯৮ কিলোমিটার জলাধার। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী সেগুলো উদ্ধার করে সচলের সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকার চারপাশের ৫৬৬ কিলোমিটার নদীপথ সচল, এক হাজার ২৩৩ কিলোমিটার সড়ককে হাঁটার উপযোগী করে তোলা, শহরের বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে স্কুলভিত্তিক উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এর বাইরে ঢাকায় সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সড়ক জল ও রেলপথকে গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত যোগাযোগ মাধ্যম গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত ড্যাপে মিরপুরে ৪-৭ তলা, মোহাম্মদপুর ও লাল মাটিয়ায় ৫-৮ তলা, খিলখেত, কুড়িল, নিকুঞ্জ এলাকায় ৬ তলা, উত্তরায় ৭-৮ তলা, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় ৬-৮ তলা এবং ঢাকায় ৬ তলা আবাসিক ভবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে রাজধানীতে বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমতি মিলবে না। তাই এর বিরোধিতা করে আবাসন ও রিয়েলস্টেট কোম্পানিগুলো ড্যাপ আটকে দিয়ে একটি রিভিউ আবেদন দিয়েছে। ড্যাপ সম্পর্কিত কেবিনেট কমিটির কাছে এমন অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকাকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নতুন নয়। বার বার পরিকল্পনা করা হয়, আবার নানা কারণে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। এসব করতে করতে রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যার ধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে, বসবাসের যোগ্যতা হারাচ্ছে। তাই এখানে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা জরুরি হয়ে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলকে ঘিরে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করা হয় পাকিস্তান আমলে। কিন্তু একাত্তরে সব পরিকল্পনা শেষ হয়ে যায়। তবুও সেটা ধরেই চলছিল। এরপর ১৯৯৫ সালে প্রণয়ন করা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন প্ল্যান (ডিএমডিপি)। সেটা করে রাজউক। ১৯৫৯ সালের পরামর্শ ও সুপারিশ মতে ঢাকার অনেক রাস্তাঘাট করা হয়। ১৯৯৫-২০১০ সালের ডিএমডিপি অনুমোদন দেওয়া হয় ১৯৯৭ সালে। এরপর ঢাকা এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) করা হয় কুড়ি বছর (২০১৬-২০৩৫) মেয়াদী। আমাদের ধারণা ছিল, ২০১৫ সালেই এর অনুমোদন হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। শুধু মতামত নিতেই কেটে গেছে গত চার বছর। ড্যাপ রাজধানী ঢাকার জন্য পরিপূর্ণ একটি প্ল্যান। এটি না হলে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় না। এটাতে সবকিছু বলা রয়েছে।’
পরিবেশবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজধানী ঢাকার জন্য একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার প্রয়োজনীতা রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বহুবার পরিকল্পনা, মহাপরিকল্পনা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ ড্যাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত যত অংশীজন থাকে তাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটি বাস্তবায়নে পৌঁছানো যাচ্ছে না। এখানে নগর পরিকল্পনার সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে যাদের থাকার কথা যেমন প্রকৌশলী, নগর পরিকল্পনাবিদ, উন্নয়নকর্মী, জমি ব্যবসায়ী, ডেভলপার কোম্পানি, বাড়ির মালিকসহ সকলকে নিয়ে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে আগে কখনোই নামা হয়নি। যে কারণে এত বছর ড্যাপ কেবল পরিকল্পনায়-ই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবার ড্যাপ বাংলায় করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকলে এবার বসেছে যাতে, ভূমিদস্যুরা এর বিরোধিতা করতে না পারে এবং সকলের জন্য অন্তর্ভুক্ত হয়। অংশীজনদের প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। তাদের প্রস্তাবনা তাদের পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষণ ও প্রত্যাশার বিষয়ে ভিত্তি করে ড্যাপকে সংবিধিবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। সংযোজন-বিয়োজন করে এটা চূড়ান্তের চেষ্টা চলছে। এই চেষ্টা দ্রুত হলে ড্যাপ বাস্তবায়ন সম্ভব।’
সরকারের বক্তব্য
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি প্রতিষ্ঠান রাজউক। রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে স্বাধীনতার পর যতগুলো পরিকল্পনা হয়েছে সবই রাজউকের তৈরি। সেভাবেই তারা উন্নয়ন করে যাচ্ছেন। কিন্তু এই ড্যাপ অনুমোদন ও বাস্তবায়নে এবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত হয়েছে। ড্যাপ বাস্তবায়ন রিভিউ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামকে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সচিবালয়ে ড্যাপ রিভিউ কমিটির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বলা হয়, শিগগিরই এই ড্যাপ অনুমোদন পাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো.তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ড্যাপ চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সব পক্ষের সঙ্গে যেমন- নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থাপত্যবিদ, রিহ্যাব, বিএলডিএসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার এবং ড্যাপ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সভা করে তাদের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারির মধ্যেই ড্যাপ চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।’
যা বলছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা
ড্যাপ বাস্তবায়নের সঙ্গে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট অথরিটিকে সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে দুইটা প্ল্যান খুব জরুরি। ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা এবং ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট অথরিটি। এই দুই পরিকল্পনার সমন্বয়ে এগোতে হবে। কারণ সড়ক ও যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ ঠিক করে রাস্তায় জ্যাম থাকলে কোনো পরিকল্পনা কাজে আসবে না। এই পরিকল্পনার সমন্বয় করে ঠিক মতো বাস্তবায়ন করা গেলে উন্নত শহরের চেহারা পাবে ঢাকা।’
ড্যাপ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এই নগর পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, ‘ঢাকাকে বাঁচাতে ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা না হলে ২০ বছর আগের পুরনো পরিকল্পনা দিয়ে কাজ চালাতে হবে। যদিও কাজ শুরুর আগে অনুমোদন পেতেই চলে গেল পাঁচ বছর। ড্যাপ বাস্তবায়ন না হলে অপরিকল্পিতভাবে শহর বাড়তে থাকবে। পুরনো সমস্যা বাড়তে থাকবে। এজন্য ড্যাপ বাস্তবায়ন জরুরি।’
সব মিলিয়ে মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে ঢাকার জন্য সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও কৌশলের সমন্বয়েই ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম
৫ বছর অনুমোদন ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) নগর পরিকল্পনাবিদ মহাপরিকল্পনা মো. তাজুল ইসলাম স্থানীয় সরকারমন্ত্রী