গোল্ডেন রাইস সম্ভাবনা নাকি ষড়যন্ত্র
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২২:০৯
প্রথম দেশ হিসেবে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড পুষ্টি-সমৃদ্ধ সোনালি চাল বাণিজ্যিক উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে ফিলিপাইন। সরকারের এ সিদ্ধান্ত অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই এবং চালের আমদানিকারক দেশগুলোতে সরবরাহ বৃদ্ধির চমৎকার উদ্যোগ হিসেবে মনে করা হলেও চালটি কতটুকু নিরাপদ—তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) সোনালি চাল উদ্ভাবন করেছে। ইরির সদর দফতর ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার দক্ষিণে লাগুনায় অবস্থিত। ইরি দাবি করেছে, সোনালি চাল আবিষ্কারের মূল উদ্দেশ্য হলো— উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভিটামিন এ’র ঘাটতি মেটানো। হলুদ রঙের কারণে এর নামকরণ হয়েছে সোনালি চাল বা গোল্ডেন রাইস। ২০১৩ সালে দেশটির কৃষি বিভাগ এবং সহযোগী সংস্থা ফিলিপাইন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ফিলরাইস) পরীক্ষামূলকভাবে সোনালি ধানের চাষ শুরু করে।
গত জুলাইয়ে ফিলিপাইন যখন আনুষ্ঠানিকভাবে এ চালের জৈব নিরাপত্তা অনুমোদন দিয়েছিল, তখন কৃষি বিভাগ বলেছিল— সোনালি চালের চাষ দেশের পুষ্টি ঘাটতি মেটাতে একটি মাইলফলক হতে যাচ্ছে। এখন ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষ আশা করছে, ২০২২ সালের বর্ষা মৌসুমে কয়েকটি প্রদেশে সোনালি ধানের আবাদ হবে।
ইরি’র মতে, ফিলিপাইনের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি ৫টির মধ্যে একটি শিশু ভিটামিন এ’র ঘাটতিতে ভুগছে। ফিলিপাইনের পর সোনালি ধান নিয়ে বাংলাদেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সোনালি ধানের চাষ সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশে পর্যালোচনা চলছে।
কিন্তু জেনেটিক্যালি মোডিফাইড অর্গানিজম বা জিএমও নিয়ে বিশ্বব্যাপী এরই মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে। এ ধরনের খাবারের সমালোচনা করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। ঠিক এমন অবস্থায় ফিলিপাইনের জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ধান বিশ্বব্যাপী সমালোচনারও জন্ম দিচ্ছে।
ফিলিপাইনের ক্যামারাইনস সুর প্রদেশের ধান চাষি ও জিএমও-বিরোধী জোটের একজন সম্মুখসারীর নেতা মেলানিয়া গুয়াভেজ বলেন, ‘গোল্ডেন রাইস আমাদের জমি বিষাক্ত করে তুলবে।’ এর আগে ২০১৩ সালে তার প্রদেশেই পাইলট প্রকল্পের আওতায় গোল্ডেন রাইসের আবাদ শুরু করা হয়েছিল। সে বছরের আগস্টে গুয়াভেজসহ শত শত কৃষক বহু জমি থেকে ধানের চারা উপড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।
গুয়েভাজ বলেন, ‘আমাদের জমি ও জীবিকার ওপর গোল্ডেন রাইস চাষের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছুই জানায়নি। তারা আমাদের ধামাচাপা দেওয়া সমাধান ও অর্ধসত্য তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। তারা বলেছিল, আমাদের কীটনাশক, বীজ ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করবে। কিন্তু তারা আসলে প্রচলিত চাষ পদ্ধতি বাদ দেওয়ার পাঁয়তারা করছে।’
তবে গোল্ডেন রাইস প্রকল্প ফিলরাইসের নেতা ড. রে ওর্ডোনিও নিক্কেই এশিয়া রিভিউকে বলেন, ‘আমরা কেবল অন্য জাতের বীজ হিসেবে চাষিদের গোল্ডেন রাইসের বীজ দিয়েছিলাম। গোল্ডেন রাইস মানবিক উদ্দেশ্যে উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ইনব্রিড হিসেবে এ ধানটি উদ্ভাবন করেছি। প্রচলিত ধানের জাতের মতো এটিকেও একটি জাত হিসেবে নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য— যেন কৃষক ও ভোক্তাদের জন্য এটি সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য হয়।’ এ ধরনের ইনব্রিড ফিলিপাইনের বেশিরভাগ জেনেটিক্যালি মোডিফাইড জাতের ধানের মতোই একটি বলেও জানান তিনি।
রে অর্ডোনিও চাষি ও ভোক্তাদের আশ্বস্ত করে জানান, গোল্ডেন রাইস সম্পূর্ণ নিরাপদ। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমিস অব সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেডিসিনের এক পর্যালোচনার তথ্য উল্লেখ করেন রে অর্ডোনিও। ওই পর্যালোচনায় প্রায় ৯০০টি গবেষণা ও প্রকাশনার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলা হয়, জেনিটিক্যালি মোডিফাইড শস্য ক্ষতিকর নয়।
অন্যদিকে চাষি গুয়াভেজ বলেন, ‘গোল্ডেন রাইস চাষের জন্য কীটনাশক ও ভেষজনাশকের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হতে হয়। গোল্ডেন রাইস চাষের এই উদ্যোগ কৃষকদের ঋণের অতল গহ্বরে ডুবিয়ে দেবে। বিশাল অঙ্কের ঋণ শোধ করতে গিয়ে বহু কৃষক তাদের জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হবে। কৃষকদের জমি দখলের জন্য এরই মধ্যে করপোরেটরা শকুনের দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে। কৃষকরা অতিরিক্ত খরচের বোঝা টানতে না পারলে জমিগুলো করপোরেটদের দখলে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘বড় ব্যবসায়ীরা এই প্রকল্প থেকে উপকৃত হবে। তবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। আমরা আমাদের স্থানীয় বীজ ও জমি রক্ষার চেষ্টা করছি। পরীক্ষাগারে নতুন কিছু তৈরি করার দরকার কী? সরকারের উচিত স্থানীয় উদ্যোগকে সমর্থন করা।’
ফিলিপাইন কলেজ অব সায়েন্সের ডিন ও অ্যাডভোকেটস অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফর দ্য পিপলের চেয়ারম্যান জিওভান্নি তপাং বলেন, কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের বিষয়গুলো চলে গেছে কৃষি রাসায়নিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। কৃষি বায়োটেক শিল্প দাবি করছে, বিশ্বকে খাওয়ানোর দায়িত্ব তাদের। তাদের পণ্য ছাড়া বিশ্ব অভুক্ত থাকবে। কিন্তু তারা আমাদের অধিকাংশ কৃষকের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে থাকে। অধিকাংশ জমি এখন জমিদার পরিবারের হাতে, বেশিরভাগ কৃষকই জমিহীন।
ফিলিপাইনে কৃষি শ্রমিকদের জাতীয় সংগঠন আমিহান এবং ফিলিপাইনের গোল্ডেন রাইস ঠেকাও জোটের সদস্য ক্যাথি এস্তাভিলো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রতি তার অভিযোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দেশে গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের অর্থ হলো— নব্য উদার বিশ্বায়নের প্রতি সরকারের আনুগত্য প্রকাশ এবং তা শক্তিশালী করা। এতে কৃষকদের কোনো লাভ নেই।কোম্পানিগুলো উৎপাদন ও বাজার থেকে লাভবান হওয়ার লক্ষ্যে বছরের পর বছর ধরে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড চালের উদ্ভাবন করে যাচ্ছে।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন কয়েক বছর ধরে ধান গবেষণার জন্য ইরিকে অনুদান দিয়ে আসছে। প্রযুক্তি বিলিয়নার বিল গেটস কৃষি রাসায়নিকের জায়ান্ট সংস্থা সিনজেন্টায় নিয়মিত অনুদান দিয়ে থাকেন। বিল গেটসের কয়েকটি স্টার্টআপের সঙ্গে সিনজেন্টার অংশীদারিত্ব রয়েছে। গোল্ডেন রাইস উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কয়েকটি প্রযুক্তির লাইসেন্সও রয়েছে সিনজেন্টার হাতে। এস্তাভিলা দাবি করছেন, ‘ভিটামিন এ’র অভাব দূর করার দাবিটি হলো করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বানানো গল্প, তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো নতুন পণ্য থেকে অর্থ উপার্জন করা।’
এস্তাভিলা বলেন, ‘গোল্ডেন রাইসের অন্তর্নিহিত ভিত্তি ত্রুটিপূর্ণ। দৈনিক ভিটামিন এ’র চাহিদা পূরণ করতে কমপক্ষে ৪ কেজি গোল্ডেন রাইস খেতে হবে। গোল্ডেন রাইস উৎপাদনে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে তা যদি অন্যান্য শাক-সবজি উৎপাদনে দেওয়া হতো তাহলে ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ করা সহজ হতো। গোল্ডেন রাইসে ভর্তুকি দেওয়ার কারণ হলো— জেনিটিক্যালি মোডিফাইড শস্যগুলো বড় অঙ্কের মুনাফা নিশ্চিত করে। ফিলিপাইন সরকার এখানে মুনাফাখোরদের পক্ষে দালালি করছে।’
তিনি অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক স্বাধীন গবেষক ম্যাডেলিন লাভের একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে জানান, ৪ কেজি গোল্ডেন রাইসে যে পরিমাণ ভিটামিন এ রয়েছে, তা একটি গাজরেই পাওয়া যায়।
তবে গোল্ডেন রাইস প্রকল্প ফিলরাইসের নেতা ড. রে ওর্ডোনিও জোর দিয়ে বলেন, ‘খাদ্য হিসেবে ভাত ফিলিপাইনের নাগরিকদের জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খায়। এটি তাদের প্রধান খাদ্য। ভাত কার্বোহাইড্রেটের চমৎকার উৎস। কিন্তু এতে অন্যান্য পুষ্টির অভাব রয়েছে। গোল্ডেন রাইস বিটা ক্যারোটিনের পরিপূরক একটি উৎস হতে পারে।’ বিটা ক্যারোটিন শরীরের ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়।
এদিকে এস্তাভিলো মনে করেন, ফিলিপাইনের বাজারে গোল্ডেন রাইস চলবে না। তিনি জানান, ২০১৫ সালে ফিলিপাইনের বাজারে গোল্ডেন রাইসবিরোধী প্রচারণাও দেখেছেন তিনি। এছাড়া চালের হলুদ রঙের কারণে বাচ্চারা এ চাল খেতে চায় না।
ফিলিপাইনে কৃষি শ্রমিকদের জাতীয় সংগঠন আমিহান বর্তমানে ফিলিপাইনের কয়েকটি প্রদেশের আইণপ্রণেতাদের সঙ্গে মিলে গোল্ডেন রাইস উৎপাদনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আনার চেষ্টা করছে।
কৃষক গুয়াভেজ চান দেশের স্থানীয় অর্গানিক বা জৈব চাষাবাদ পদ্ধতিতে সরকারের সহায়তা। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে গোল্ডেন রাইসের পাইলট প্রকল্প চালুর পর থেকে কৃষি বিভাগ নিয়মিত সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। গোল্ডেন রাইসের চাষ মূলত আমাদের জমিগুলো ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র।’
তিনি জানান, তার অঞ্চলের কৃষক গোষ্ঠী একটি প্রতিবাদ সমাবেশের পরিকল্পনা করছে। অন্যান্য প্রদেশেও বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন কৃষকরা। কৃষকরা গোল্ডেন রাইসের চারা উপড়ে ফেলারও আহ্বান জানাচ্ছেন।
নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদন ভাষান্তর করেছেন আতিকুল ইসলাম ইমন
সারাবাংলা/আইই