Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইকমার্সের পাওনাদাররা টাকা ফেরত পেতে যা করতে পারেন

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১ অক্টোবর ২০২১ ১৩:৪৪

ঢাকা: ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঘরে বসে পণ্য কিনে বহু গ্রাহকের টাকা খোয়া গেছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার চিত্র বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওঠে এসেছে। আর প্রতারণার ঘটনায় বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এ সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর তাদের কয়েকজনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারিত হাজার হাজার গ্রাহকের টাকা ফেরত পেতে পাওনাদারেরা কী পদক্ষেপ নিতে পারেন। সে সব বিষয়েই বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা সারাবাংলার সাপ্তাহিক আইনি পরামর্শ বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘লিগ্যাল চেম্বারস’-পাওয়ার্ড বাই প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন। বৃহস্পতিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাতে আলোচনা অনুষ্ঠানটি সারাবাংলার ফেসবুক ও ইউটিটিউব পেজে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সেই আলোচনা অনুষ্ঠানের পরিমার্জিত অনুলিখন পাঠকের জন্য ‍তুলে ধরা হলো:

বিজ্ঞাপন

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইফফাত গিয়াস আরেফিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাসান চৌধুরী। আর বিশেষ আলোচক হিসেবে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আদনান এম এল করিম।

আলোচনার অনুষ্ঠানের শুরুতেই অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাসান চৌধুরী বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা হঠাৎ করে পাঁচ-ছয়টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে দেখলাম তারা ভোক্তাদের বিভিন্ন পণ্য কেনার জন্য পণ্যের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্যে পণ্য বেচতে অফার দিচ্ছেন। আর ভোক্তারাও হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার মতো এ সব প্রতিষ্ঠানের পেছনে ছুটছেন। আমাদের বুঝতে হবে ই-কমার্স মানে কোনো ডিসকাউন্ট শপ নয়। ই-কমার্স মানে কোনো লটারি কেনা নয়। এ সব অফার পাওয়ার পর কাস্টমারদের মনে রাখতে হবে কোন ধরনের পণ্য কেনায় প্রলুব্ধ হব? কিংবা কত শতাংশ ছাড় পেলে পণ্য কেনার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠব।’

আমরা এর আগেও এরকমভাবে বিভিন্ন এলএলএম কোম্পানির দ্বারা প্রতারিত হয়েছি। কাস্টমাররা অতিরঞ্জিত অফারে প্রতারিত হচ্ছেন। এর জন্য কাস্টমাররা যেমন দায়ী তেমনি ই-কমার্স কোম্পানিগুলোও দায়ী। এ ক্ষেত্রে কাস্টমারদের অসাবধানতা ও অর্থলিপ্সাও বহুলাংশে দায়ী বলে আমি মনে করি।

ই-কমার্সের নামে বড় একটি কোম্পানি আড়াই লাখ টাকার বাইক ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। এ রকম অফার পেয়ে গ্রাহক টাকা দিচ্ছে কিন্তু পণ্য বুঝে পাচ্ছে না। ভোক্তারা যদি নিজেরাই ভাবেন ২ লাখ টাকার বাইক ১ লাখ টাকায় বিক্রি করা কীভাবে সম্ভব? এখন সময় এসেছে বিভিন্ন রেগুলেটরি বডি দ্বারা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় আনার। এখন গ্রাহক প্রতারিত হওয়ার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদের জেলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠেছে তাদের জেলে দিয়ে তো গ্রাহক টাকা ফেরত পাচ্ছে না। তাহলে এখন কী করতে হবে? অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে টাকা উদ্ধার করতে ভোক্তা/গ্রাহককে বহু সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আদনান করিম বলেন, ‘ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের একটা বদনাম এখন হয়ে গেছে। আমি মনে করি, আমাদের দেশে ই-কমার্স পরিচালনার ক্ষেত্রে এখনো ইকো সিস্টেম তৈরি হয়নি। আমি এটিও বলতে চাই, আমাদের দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোও ভোক্তাবান্ধব না। আমি যদি একটা পণ্য কিনে প্রতারিত হই, আমার টাকা যদি খোয়া যায়। আমার পণ্যটি যদি ই-কমার্স পণ্য না হয়েও সাধারণ পণ্য হলেও টাকা মার যাওয়াটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর। এমনকি ভোক্তা অধিদফতরের মতো প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও ভোক্তার অধিকার কি সংরক্ষিত হচ্ছে? সে রকমটাও আমরা দেখতে পাই না।’

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের আইনগত কাঠামোর জন্য বা ইকোসিস্টেমের জন্য কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এখন ভোক্তারা প্রতারিত হচ্ছেন, সামনের দিনে যে প্রতারিত হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যাচাই-বাছাই না করে কম মূল্যে পণ্য কিনলে ভোক্তাকেও এর দায় নিতে হবে। পণ্যটি কত টাকা দিয়ে কিনছি; কোথা থেকে কিনছি এসব অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আমি মনে করি এসব ক্ষেত্রে অনেক ভুল-ক্রটি রয়ে গেছে। পাশাপাশি ভোক্তা বা গ্রাহকের সচেতনতারও অভাব রয়ে গেছে। এ সব সমস্যা উত্তরণে কাজ করতে হবে।

ই-কমার্সের প্রতারণার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এক দর্শকের প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘কিছুদিন ধরে চাঁদে জমি কেনা নিয়ে একটি বিষয় বেশ আলোচনায় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিক রীতিমতো জমি দরদাম নির্ধারণ করে ম্যাপিং করে চাঁদের জমি বিক্রি শুরু করছে। এ ধরনের বিষয়ে আগে থেকে সচেতন থাকতে হবে।’

সাধারণ গ্রাহককে ই-কমার্স এবং শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে কোম্পানি সম্পর্কে মৌলিক ধারণা থাকতে হবে। আর এ সব বিষয়ে মৌলিক ধারণা না থাকলে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। যারা এ সব বিষয় ভালো বুঝতে পারেন না, তাদের জন্য মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করা উচিত।

এ বিষয়ে আদনান করিম বলেন, ‘ইভ্যালির মতো অনলাইন প্লাটফরম ভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পণ্য কেনা-বেচার জন্য আমাদের দেশে ইউরোপ-আমেরিকার মতো ইকোসিস্টেম গড়ে ওঠেনি। তাই এ ক্ষেত্রে আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।’

এ সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাসান চৌধুরী বলেন, ‘২০০ টাকা দামের পণ্য ১০০ টাকা পাওয়ার লোভ ত্যাগ করতে হবে। আর কোম্পানিগুলোকেও অর্ধেক মূল্যে পণ্য বিক্রি করা চলবে না। এটা পৃথিবীর কোথাও চলে না; বাংলাদেশে যা চলছে। এলএলএম কোম্পানির মতো ই-কমার্স নতুন একটি মাধ্যম, যার জন্য সব ধরনের মানুষকে সচেতন হতে হবে।’

ভোক্তা বা গ্রাহক প্রতারিত হওয়ার পর টাকা উদ্ধারের জন্য চুক্তি আইনসহ অন্যান্য একাধিক আইনের মাধ্যমে কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এ ছাড়া টাকা খোয়া যাওয়ার জন্য সিভিল ও ক্রিমিনাল দুধরনের মামলা করার সুযোগই আছে। আর অল্প টাকার জন্য মামলা করার আগে ভাবনা-চিন্তা করে নিতে হবে। দুই-তিন হাজার টাকার জন্য মামলা করাটা কতটা বাস্তবসম্মত সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ মামলা করে অল্প সময়ের মধ্যে রায় নাও পাওয়া যেতে পারে। সেটাও ভাবতে হবে।

আমাদের পরামর্শ হলো আমাদের দেশে ই-কমার্সের নামে যা হচ্ছে অতীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমনটা হয়েছে। ওইসব দেশে এখন রেগুরেটরি বডির মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানকে একটি আইনি কাঠামোর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভোক্তা বা গ্রাহকদের পণ্য কেনায় সব সময় সচেতন থাকতে হবে।

অস্বাভাবিক কম মূল্যে বা অর্ধেক মূল্যে পণ্য কেনার মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। আবার সরকারকে এসব প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মানুষকে আরও সচেতন করে তুলার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি রেগুলেটরি বডির মাধ্যমে আইনের আওতায় আনতে হবে। পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখেই হুমড়ি খেয়ে কেনা শুরু করা যাবে না। আবার কেউ প্রতারিত হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আর মানুষকে সচেতন করে তুলতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাসান চৌধুরী।

সারাবাংলা/কেআইএফ/একে

ই-কমার্স পাওনা টাকা

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর