Wednesday 04 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজীব জানে না তার হাত নেই!


৫ এপ্রিল ২০১৮ ০৮:৪৬ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৮ ১৭:১২
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: উপরের ছবিটি দেখলে- তারুণ্যের ছটা দেখা যাবে। আর নিচের ছবিটিতে চোখে ঝরে পড়ছে করুণ আকুতি। সব ছবিই রাজীবের। পুরোনাম রাজীব হোসেন। রাজধানীর তিতুমীর কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সেই রাজীব দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ডান হাত হারিয়ে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রায় দেড় দিন পার হলেও তিনি এখনও জানেন না, তার হাত নেই। কেবল জানেন, তার পুরো শরীরে ব্যথা।

রাজধানীতে দুটি বাসের বেপরোয়া পাল্লাপাল্লিতে রাজীব তার ডান হাতটি হারিয়েছে। সে একদিন আগের খবর। মঙ্গলবার (৩ এপ্রিল) রাজধানীর কারওয়ানবাজারে ঘটে সে ঘটনা।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (৪ এপ্রিল) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শয্যায় রাজীবের করুণ চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে বুক ধরে আসে অনেকের। কি করুণ চাহুনি তরুণটির দুই চোখে! গভীর দুটি চোখে যে সব স্বপ্ন বোনা ছিলো তার পুরোটাই বুঝি কেড়ে নিয়েছে দুই বাসের বেপরোয়া নিষ্ঠুরতা। ডান হাতের কাঁধের নিচের অংশ থেকে হাতটি আর নেই রাজীবের দেহের সাথে।

রাজীবকে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। রাজধানীর কারওয়ানবাজারে মঙ্গলবার বিকেলে এই নির্মম ঘটনার শিকার হওয়ার পর প্রায় একদিন রাজীব ছিলেন নিকটস্থ পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে। সেখানে দিন ঘুরতে না ঘুরতেই তার চিকিৎসার বিল আসে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। আর ১৭ হাজার টাকা ওষুধের ‍পুরোটাই কিনেছে পরিবার। এমন অবস্থায় মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের আর দশটা সম্ভাবনাময় তরুণের ক্ষেত্রে যা হয় রাজীবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। দ্রুত ওই হাসপাতাল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাদের।

মামা, খালাসহ কয়েকজন আত্মীয় রাজীবকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

রাজীবের খালা জাহানারা বেগম সারাবাংলাকে বলছিলেন, শমরিতা হাসপাতালের খরচের সঙ্গে আমরা কুলিয়ে উঠতে পারছি না। মঙ্গলবার বিকেল থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত ঔষধপত্র ছাড়াই হাসপাতালের বিল এসেছে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। কিছু টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা পরিশোধ করা হবে বলে লিখিত দিয়ে রাজীবকে ছাড়পত্র দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতো খরচ আমাদের পক্ষে নির্বাহ করা সম্ভব নয়। তাই কম খরচের জন্য ওকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।

রাজধানীতে বাসের মধ্যে এমন যুদ্ধ, বাসে চড়া যাত্রীমাত্রই জানা। একটি বাসের গা ঘেঁষে অন্য একটি ছুটে যায়। তাতে কখনো বা বাসের জানালার কাচ ভেঙ্গে যাত্রী আহত হন, কখনো ভেতরে যাত্রীরা উল্টে পড়ে ব্যথা পান। আর রাজীব হারালেন তার তারুণ্যের হাতটি।

হাতটি যখন দুই বাসের মাঝখানে চাপা পড়ে ছিলো তার ছবি তুলেছেন জাতীয় দৈনিকের একজন সংবাদকর্মী। ছবিটি দেখলে গা শিউরে ওঠার মতো। স্রেফ একটি হাত লটকে আছে। হাতের মানুষটি দেখা যাচ্ছে না।

সৌজন্যে: প্রথম আলো

বুধবার ছবিটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন থেকেই তা নিয়ে ঝড় বইছে মূলধারার সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে। বিষয়টিতে বুধবার উচ্চ আদালতে একটি রিট হয়। রিট আবেদনটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল। তার পরিপ্রেক্ষিতে এ নিয়ে রুল জারি করেন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ। তাতে রাজীবের এই হাত হারানোর ক্ষতিপূরণ কেনো এক কোটি টাকা দেওয়া হবে না? তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শাতে বলা হয়। পাশাপাশি যাত্রী সাধারণের চলাচলে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে কার্যকরে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তিরোধে প্রয়োজনে আইন সংশোধন ও নতুন করে বিধিমালা প্রণয়নের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। চার সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, সড়ক পরিবহন সচিব, পুলিশ প্রধান, ডিএমপি কমিশনারসহ আট বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

সে জবাব হয়তো পরে পাওয়া যাবে, আর আদালতও হয়তো পরেই তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু বুধবার উচ্চ আদালততো এও বলে দিয়েছেন যে রাজীবের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ বহন করবে দুটি বাসের মালিক পক্ষ।

আদালতের রায় রাজীবের পরিবারের কাছে সেভাবে পৌঁছায়নি। কেউ যায়নি তাদের কাছে, আর সে কারণেই হাসপাতাল পাল্টে অপেক্ষাকৃত কম খরচের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে তাকে। আর সে আদেশ আমলে নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। সে কারণে রাজীবের পরিবার বিল পরিশোধে অপারগ বলে বন্ড লিখে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে।

পরিবারের খোঁজ নিতে জানা গেলো-রাজীব সত্যিকার অর্থেই এক অনাথ তরুণ। বাবা-মা হারা। জীবনে সামনে এগিয়ে যেতে তার একমাত্র অবলম্বন ছিলো পড়ালেখা। সেই পড়ালেখাও তার চলতো অনেক কষ্টে-সৃষ্টে। নিজের টিউশনিতে সামান্য আয় ও আত্মীয় স্বজনের সহযোগিতায়।

রাজীবরা তিনভাই, রাজিব বড়। বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের দাসপাড়ায়। মা আকলিমা বেগম মারা যান যখন তার বয়স ১০ বছর, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় হারান বাবা হেলালউদ্দিনকে। ছোট দুই ভাই মেহেদী হাসান আর হৃদয় হোসেন আব্দুল্লাহ তামিম মিল্লাত মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।

রাজীবের বড় খালা জাহানারা বেগম বলেন, এতিম জেনে দুই ভাইকেই মাদ্রাসা থেকে ফ্রিতে পড়ার সুযোগ দিয়েছে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। আর রাজীব নিজেও লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজ করে নিজের খরচসহ ভাইদের খরচ চালাতো। তিনি জানান, যাত্রাবাড়িতে একটি কম্পিউটারের দোকানে গ্রাফিক্সের কাজ করতো। এ যুগে এমন ছেলে পাওয়া খুব দুষ্কর জানিয়ে জাহানারা বেগম বলেন, আমার নিজের দুটো সন্তান। কিন্তু রাজিবকে আমি কখনোই তাদের থেকে আলাদা করে দেখিনি।

বড় আপা (রাজীবের মা) মারা যাবার পর থেকেই ওরা তিনভাই আমাদের কাছে, আমরাই ওদের বড় করেছি। কত কষ্ট আমরা করেছি, ও নিজে করেছে। এখন সেই ছেলেটার একটা হাত নেই, ছেলেটার কপালে এত দুঃখ থাকবে-এটা যদি আগে জানতাম তাহলে ওকে সেদিন বাসা থেকে বের হতে দিতাম না-বলেন জাহানারা বেগম। তিনি কথা বলেন আর চোখ মুছেন।

নিজের কষ্টের কথা বোধহয় রাজীব হাসপাতালের বেডে শুয়েও বুঝতে পারছিল। তাইতো যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের অস্ত্রোপচার কক্ষে চিকিৎসক যখন তাকে নাম জিজ্ঞেস করেন তখন নিশ্চুপ ছিলেন তিনি। এরপর চিকিৎসক তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, তোমাকে-তো কথা বলতে হবে। চিকিৎসক আবার তার নাম জিজ্ঞেস করলে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই জবাব দেন, নাম নাই। ও এখনও একটা শকের ভেতর রয়েছে মন্তব্য করে চিকিৎসক আবার জানতে চান, তোমার বাবার নাম কী, এবারও রাজিব নাই বলে জানালে চিকিৎসক বলেন, আমরা তোমার চিকিৎসা করতে এসছি, তুমি কথা না বললে, আমাদের সাহায্য না করলে কীভাবে হবে।

শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বের হয়ে যাওয়াতে সে এখনও ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে সেখানেই রাজিবের পরিবারকে জানায় চিকিৎসক। পরে তাকে হাসপাতালের ১০১ নং ওয়ার্ডের ইউনিট ১ এ নম্বর ভর্তি করা হয়।

এর আগে, রাজীবকে যখন শমরিতা হাসপাতাল থেকে ট্রলিতে করে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হয় তখন কেবল একটি কথাই বলছিল রাজিব-ব্যথা ব্যথা। হাসপাতালের সদস্যসহ রাজিবের স্বজনরা মিলে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলেন। কখনও চোখ বন্ধতো কখনও চোখ খুলে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও আনার পরও সেই ব্যথা শব্দটিই কয়েকবার উচ্চাণ করেছেন তিনি।

অনেক চেষ্টা করেও চিকিৎসকসহ স্বজনরা আর কোনও কথা তাকে বলাতে পারেননি। রাত নয়টার দিকে রাজীবকে ওয়ার্ড থেকে পোস্ট অপারেটিভে স্থানান্তর করা হয়েছে জানিয়ে তার মামা জাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, গতকাল থেকে ওর সঙ্গে কোনও কথা হয়নি। কখনও জ্ঞান আসে আবার কখনও জ্ঞান ফিরলেও সেটা আমরা বুঝতে পারিনা। জ্ঞান ফিরলে কেবল একটা কথাই বলে, ব্যথা।

আর বলে, আমার হাতটা একটু সোজা করে দাও, হাতটা এত ভারী কেন। রাজিব এখনও জানে না, ওর হাতে কী হয়েছে, জানে না-ওর হাতটা কেটে ফেলা হয়েছে।

জাহিদুল ইসলাম বলেন, হাইকোর্টের এক কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের একটা নির্দেশের কথা শুনেছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ আসেনি, সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের কেউ কিছু জানতেও আসেনি, আমরা কোথাও থেকে কোনও সাহায্যও পাচ্ছি না।

তিনি বলেন, আমরা ভাইবোনরা যেভাবে পারছি কাল থেকে চিকিৎসা চালাচ্ছি। কিন্তু আমরাতো ধনী নই-যে শমরিতার মতো হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারবো। ওদেরকে পুরো টাকা দিয়ে দেওয়া হবে লিখিত দিয়ে এই হাসপাতালে নিয়ে আসছি। সেই টাকা কীভাবে দেব তাও জানি না। তাই সমাজের বিত্তবানদের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, যদি তারা এতিম এই ছেলেটার জন্য এগিয়ে আসেন। রাজিবকে যদি তারা আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেন তাহলে হয়তো শমরিতার টাকাটা আমরা দ্রুত দিয়ে দিতে পারবো।

রাজীবকে সাহায্য করার জন্য খাদিজা বেগম, অ্যাকাউন্ট নাম্বার ০২০০০০২১১৪৮৩২, যাত্রাবাড়ি শাখা, অগ্রণী ব্যাংক- এই ঠিকানায় সাহায্যের জন্য তারা আবেদন করেছেন।

রাজীবের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাস দুটির একটি ব্যক্তি মালিকানার। নাম স্বজন পরিবহন। অন্যটির মালিক স্বয়ং সরকার। এটি বিআরটিসির বাস। পুলিশ দুটি বাসই আটক করে থানায় নিযেছে। ঘটনার পরপরই দুই বাসেরই চালক ও চালকের সহকারীরা পালিয়ে যান। পরে অভিযান চালিয়ে প্রথমে বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ এবং পরে স্বজন পরিবহনের চালক মোরশেদ আলমকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সারাবাংলা/জেএ/টিএম

আরও পড়ুন

রাজিবকে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন নয় : হাইকোর্ট

রাজিবের দুর্ঘটনায় দুই বাসের চালক গ্রেফতার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর