Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পদোন্নতি চান না রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মচারীরা!

কামরুল ইসলাম ফকির, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৭ অক্টোবর ২০২১ ২৩:০০

ঢাকা: নিবন্ধন অধিদফতরের অধীন দেশের জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের কর্মচারীদের অনেকেই পদোন্নতি নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন। অনেকে তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরেও আগ্রহী নন। এসব অফিসে কর্মরত বেশিরভাগ কর্মচারী এক্সট্রা মোহরার (নকলনবিশ) থেকে রাজস্ব বহির্ভূত টিসি (ট্যাক্স কালেকটর) মোহরার পদে পদোন্নতি নিতেও অনিচ্ছুক।

কর্মচারীরা বলছেন, সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করে তারা টিসি মোহরার পদে পদোন্নতি চান না। অন্যদিকে নিবন্ধন অধিদফতর বলছে, যোগ্য হওয়ার পরও কেউ পদোন্নতি না নিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিজ্ঞাপন

এক্সট্রা মোহরার বা নকলনবিশরা মূলত দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার পর বালাম বইয়ে সেটি লিপিবদ্ধ (সংরক্ষণ) করে থাকেন এবং নকল দলিল দিতে মূল সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করে থাকেন। তাদের বেতন হয়ে থাকে দৈনিক হাজিরাভিত্তিতে।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই মন্ত্রণালয়ের অধীন নিবন্ধন অধিদফতর জেলা পর্যায়ে রেজিস্ট্রার অফিস ও উপজেলা পর্যায়ের সাব-রেজিস্ট্রার অফিসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এসব কার্যালয়ে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার তালিকাভুক্ত এক্সট্রা মোহরার (নকলনবিশ) কাজ করে থাকেন। তাদের সবাই অস্থায়ী ভিত্তিতে (দৈনিক হাজিরা) কাজ করেন। তাদের মধ্য থেকেই মোহরার পদে (গ্রেড-১৮) এবং টিসি মোহরার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়ে থাকে। তবে এর মধ্যে মোহরার পদটি রাজস্ব খাতভুক্ত হলেও টিসি মোহরার দু’টি পদের একটি পদ রাজস্ব খাতভুক্ত, অন্যটি রাজস্ব খাতভুক্ত নয়। রাজস্ব বহির্ভূত টিসি মোহরাররা মহাপরিদর্শকের (আইজিআর) ফান্ড থেকে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজস্ব বহির্ভূত টিসি মোহরাররা জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেন ও পৌরসভা থেকে ট্যাক্স সংগ্রহ করে থাকেন। রাজস্ব খাতভুক্ত না হওয়ার কারণে তারা মোহরারদের চেয়ে সুযোগ-সুবিধা কিছুটা কম পেয়ে থাকেন। এ জন্য বেশিরভাগ এক্সট্রা মোহরার (নকলনবিশ) নিজ পদ থেকে টিসি মোহরার পদে পদোন্নতি নিতে চান না। অনেক এক্সট্রা মোহরার রয়েছেন যাদের বয়স ৪৫ বছরের বেশি। তারাও পদোন্নতি পেয়ে রাজস্ব খাতে যেতে চান না।

তাদের যুক্তি, এক্সট্রা মোহরার (নকলনবিশ) হিসেবে কাজ করার জন্য কোনো নির্ধারিত বয়স সীমা নেই। যতদিন ইচ্ছা, ততদিন কাজ করা যাবে। কিন্তু মোহরার বা টিসি মোহরার পদে পদোন্নতি নিলে সরকারি নিয়মে ৫৯ বছরে অবসরে যেতে হবে।

সম্প্রতি নিবন্ধন অধিদফতর রাজস্ব বহির্ভূত টিসি মোহরার পদে পদোন্নতি দেওয়ার উদ্যোগ নিলে জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয় ও সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে কর্মরত শত শত এক্সট্রা মোহরার (নকলনবিশ) পদোন্নতি নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে তারা পদোন্নতি নেবেন জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন জমা দেন।

পরে এ বিষয়টি সমাধানের জন্য নিবন্ধন অধিদফতর গত ১৪ সেপ্টেম্বর এক অফিস আদেশ জারি করে। নিবন্ধন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক শহীদুল আলম ঝিনুকের সই করা অফিস আদেশে সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রারদের এ ধরনের আবেদন আমলে না নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।

নিবন্ধন অধিদফতরের অফিস আদেশে বলা হয়, ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, সারাদেশে নিবন্ধন অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন, দেশের সব জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে কর্মরত কর্মচারীদের মধ্যে কেউ কেউ পদোন্নতি নিতে অনীহা জানিয়ে পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি নেবেন বলে আবেদন করেছেন। পদোন্নতি নিতে অনিচ্ছুক কর্মচারীদের এরকম আমলে না নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রারদের নির্দেশ দেওয়া হলো।

পদোন্নতি নিতে অনিচ্ছুক কোনো কর্মচারীকে পরবর্তী সময়েও কোনো পদে পদোন্নতির জন্য যোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে অফিস আদেশে। গ্রেডেশন তালিকায় পদোন্নতি নিতে অনিচ্ছুকদের নামের পাশের কলামে এ বিষয়ে নোট দিতে জেলা রেজিস্ট্রারদের নির্দেশ দেওয়া হয় ওই অফিস আদেশে। প্রয়োজনে এসব কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয় ও সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের কর্মরত বেশ কয়েকজন এক্সট্রা মোহরারের (নকলনবিশ) সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের কেউই সংবাদ মাধ্যমে নিজেদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন কয়েকজন সারাবাংলাকে বলেন, সরকার এখন রাজস্ব বহির্ভূত টিসি মোহরার পদে পদোন্নতির উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা অনেকেই এক্সট্রা মোহরার (নকলনবিশ) পদ থেকে পদোন্নতি নিয়ে টিসি মোহরার পদ যেতে চাই না। কারণ, টিসি মোহরারের পদটি রাজস্ব খাতভুক্ত নয়। অন্যদিকে মোহরার পদটি স্থায়ী রাজস্ব পদ। এ জন্য প্রয়োজেন দুই-তিন বছর অপেক্ষার পরও যদি মোহরার পদ শূন্য হয়, তখন সেই পদে যেতে চাই।

কর্মচারীরা বলছেন, মোহরার পদটি রাজস্ব খাতভুক্ত হওয়ায় সেই পদে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। আর রাজস্ব বহির্ভূত টিসি মোহরার পদটি স্থায়ী না হওয়ায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এটিই হচ্ছে মূল বিষয়।

আবার এক্সট্রা মোহরারদের (নকলনবিশ) একটি অংশ কোনো পদেই যেতে চান না। তাদের বেশিরভাগের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব বা পঞ্চাশের কাছাকাছি। এমন কয়েক জানান, বয়স পঞ্চাশের বেশি হওয়ায় রাজস্ব খাতভুক্ত পদে গেলে অল্প কয়েক বছর চাকরি করেই তাদের অবসরে যেতে হবে। এর চেয়ে নকলনবিশ (অস্থায়ী চাকরি) হিসেবে থেকে গেলে সেখানে দীর্ঘ দিন কাজ করা যাবে। কেননা, অস্থায়ীভিত্তিতে নিয়োগের কারণে নকলনবিশ পদে অবসরের কোনো বয়সসীমা নেই।

সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধার নিয়ে মামলা পরিচালনা করে থাকেন প্রশাসনিক অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী এস এম শফিকুল ইসলাম কাজল। তিনি এ বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন যারা এক্সট্রা মোহরার আছেন, তারা প্রমোশন নিতে চাচ্ছেন না। কারণ এখন তারা প্রমোশন নিলে ভালো সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রমোশন নিলে হয়তো তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। কিন্তু এটি ন্যায়সঙ্গত নয়।

এই আইনজীবী বলেন, বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নিবন্ধন অধিদফতর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি সঠিক সিদ্ধান্ত। যোগ্য হওয়ার পরও কেবল সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করে কেউ পদোন্নতি নেবেন না— এটা হতে পারে না। এটাকে আমি এক ধরনের অন্যায় বলে মনে করি।

এসব বিষয় জানতে চাইলে নিবন্ধন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক (আইজিআর) শহীদুল আলম ঝিনুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক্সট্রা মোহরার (নকলনবিশ) পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে রাজস্ব বর্হিভূত টিসি মোহরার ও মোহরার হয়ে থাকেন। এর মধ্যে মোহরার যারা হন, তাদের চাকরি রাজস্ব খাতভুক্ত হয়। তারা পেনশনসহ সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। আর রাজস্ব খাত বহির্ভূত টিসি মোহরারদের আইজিআর (মহাপরিদর্শক) ফান্ড থেকে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়ে থাকে। এখন টিসি মোহরার পদে পদোন্নতির উদ্যোগ চলমান। সেখানে যারা পদোন্নতির জন্য যোগ্য হয়েছেন, তাদের অনেকে ভাবছেন দুয়েক বছর পর মোহরার পদ শূন্য হলে তখন আবেদন করলে মোহরার পদে পদোন্নতি পাওয়া যাবে। তাই এখন এক্সট্রা মোহরাররা পদোন্নতি না নিতে আবেদন করছেন। আমরা সে সুযোগটি বন্ধ করে দিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, এখন যারা পদোন্নতির যোগ্য তারা পদোন্নতি না নিলে পরবর্তী সময়ে আর পদোন্নতি চাইতে পারবেন না। যোগ্য হয়েও পদোন্নতি না নেওয়ার কারণে পরবর্তী সময়ে ওপরে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়াটাকে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ বলে আমি মনে করছি। এই বিষয়টি সবাইকে জানিয়ে দিতেই গত ১৪ সেপ্টেম্বর ওই অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে।

এদিকে, চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের এক প্রশ্নোত্তর পর্বে আাইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, দেশের জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে কর্মরত নকলনবিশের সংখ্যা ১৬ হাজার ২৪৫ জন। তাদের চাকরি স্থায়ী করার বিষয়ে আইন ও বিচার বিভাগ এরই মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছে। শিগগিরই ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে। তবে এখন পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

সারাবাংলা/কেআইএফ/টিআর

এক্সট্রা মোহরার জেলা রেজিস্ট্রার অফিস নকলনবিশ পদোন্নতিতে অনীহা মোহরার পদে পদোন্নতি সাব-রেজিস্ট্রার অফিস

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর