রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রত্যাহার করুন: অনুপম সেন
১৮ অক্টোবর ২০২১ ২০:৫৯
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে হলে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রত্যাহার করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে যদি প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক রাষ্ট্র করতে হয়, তাহলে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রত্যাহার করুন। এরশাদ যে রাষ্ট্রধর্ম করেছিল, সেটা বাদ দিতে হবে। বাংলাদেশকে একটি সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। প্রতিমন্ত্রী মুরাদ এ কথা বলার পর সাঈদ খোকন তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। এরকম কত সাঈদ খোকন দলের ভেতরে আছে, তাদের খুঁজে বের করুন।’
সোমবার (১৮ অক্টোবর) বিকেলে ‘সর্বস্তরের সংস্কৃতিকর্মী ও সচেতন নাগরিক সমাজের’ ব্যানারে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে ড. অনুপম এসব কথা বলেন। সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা কোনো ভূমিকা পালন না করায় এসময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, শেখ হাসিনা আজ একা হয়ে গেছেন।
আরও পড়ুন- ‘প্রশাসনে অসংখ্য পাকিস্তানি আছে’
দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে নগরীর চেরাগি পাহাড় মোড়ে আয়োজিত সমাবেশে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নাগরিকরা অংশ নেন। সমাবেশে অনুপম সেন বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, আপনি কী করেছেন? এই প্রশ্ন করার অধিকার আপনাদের আছে। আমিও প্রশ্ন করতে পারি— আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ আজ কোথায়? তারা রাস্তায় নেই কেন? স্বাধীনতার আগে পূর্ব-পাকিস্তানে বারবার সাম্প্রদায়িক আঘাত এসেছে। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক আঘাত আসার পর বঙ্গবন্ধু সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট পার্টি রাস্তায় রুখে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগও রাস্তায় ছিল।’
তিনি বলেন, ‘তারা অত্যাচারিত হয়েছে, তারা জেলে গেছে, নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছে। কিন্তু রাস্তা ছাড়েনি। আজ কেন আমি রাস্তায় ছাত্রলীগের ছেলেদের দেখি না? এত বড় সংগঠন আওয়ামী লীগ, এই আওয়ামী লীগের কত শাখা সংগঠন— ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কত লীগ— তারা কেন নেই রাস্তায়, তারা কোথায়? আমি তাদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানাচ্ছি।’
‘আমি মনে করি, শেখ হাসিনা আজ একা হয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, কঠোর শাস্তি দেবো। কিন্তু তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন বলেন, এখনো তদন্ত চলছে? তদন্ত এতদিন ধরে চলবে কেন? অষ্টমীর দিন ঘটনা, ছয়-সাত দিন পেরিয়ে গেছে। তারপরও কেন তদন্ত প্রতিবেদন পাব না— এর উত্তর চাই। অবিলম্বে তদন্তের খবর দিন, দোষীদের আইনের কাছে সোপর্দ করুন। তাহলে এ দেশে হিন্দু সম্প্রদায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়— শব্দটা আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, তারা বুঝবে যে রাষ্ট্র তাদের পাশে আছে। প্রশাসন কী করছে? যারা ইন্ধন দিচ্ছে, যারা ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের ধরছে না কেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দাবি করছি, আপনি তাদের ধরুন, তাদের শাস্তি দিন।’
গণমাধ্যমের ভূমিকায় ক্ষোভ জানিয়ে ড. অনুপম বলেন, ‘১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর পূর্ব-পাকিস্তানের সব পত্রিকা একযোগে লিখেছিল— পূর্ব বাংলা, রুখিয়া দাঁড়াও। আজ মিডিয়ায় এমন হেডলাইন দেখি না কেন? বাংলাদেশে এত পত্রিকা, এত টেলিভিশন— আপনারা লিখুন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রুখিয়া দাঁড়াও। টেলিভিশনে প্রচার করুন। মিডিয়া হামলার খবর কেন অল্প অল্প করে দিচ্ছে! এটা তো আমরা পাকিস্তান আমলে দেখেছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে মিডিয়ার এমন ভূমিকা কেন?’
একুশে পদকপ্রাপ্ত এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘আমরা একটি আধুনিক বাংলাদেশ করতে চেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর একটি অসাধারণ সংবিধান আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার মাত্র ১০ মাসের মধ্যে তিনি সেই অসাধারণ সংবিধান আমাদের দিয়েছিলেন। সেই সংবিধান দেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন— এটি বাঙালির প্রথম সংবিধান। সেখানে তিনি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট্রানের সংবিধান বলেননি, বাঙালির সংবিধান বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই দেশে প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধর্মচর্চা করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। ধর্মকে ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু আজ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে যারা অন্য ধর্মাবলম্বী, তারা আজ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক!’
সমাবেশে কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, ‘কিছুদিন পরপর একটি ঘটনা ঘটে, আর আমরা রাস্তায় দাঁড়াই। আজ সমাবেশের পর বাড়ি ফিরে গিয়ে আরেকটি ঘটনার জন্য অপেক্ষা করব— এমন ভাবলে ভুল হবে। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে রাস্তায় নামেনি। গান্ধী বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার দায়িত্ব সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের। বাংলাদেশের ঘটনায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি। সুতরাং আমাদের রাজপথে থাকতে হবে।’
বাংলাদেশে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সরকারি একটি নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, কোনো ধর্মের প্রতি কটাক্ষ করে, বিদ্রুপ করে ঘৃণার উদ্রেক করে ধর্মীয় বক্তব্য দেওয়া যাবে না। মানুষের মনে অন্যের প্রতি হিংসা জন্মাতে পারে— এমন বক্তব্য ওয়াজ মাহফিলে দেওয়া যাবে না। কিন্তু ১০ বছর পরও এখনো ওয়াজ মাহফিলে ঘৃণা ছড়ানো হয়। হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু সংস্কৃতি, নারী বিশেষ করে প্রগতিশীল চিন্তার নারীদের ও বিজ্ঞানকে টার্গেট করে হিংসাত্মক কথাবার্তা বলা হয়।’
‘এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাষ্ট্রে, সমাজের তৃণমূলে রূপান্তরের কাজ করতে হবে। মাদরাসার সিলেবাস বদলাতে হবে, মাদরাসার পরিবেশ বদলাতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা বদলাতে হবে এবং বহুত্ববাদী সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এসব কাজ না করে শেখ হাসিনাকে মাথার ওপর বসালেও সমাজের রূপান্তর ঘটবে না। সবাই মিলে শেষবারের মতো বড় রকমের ধাক্কা দিতে হবে। সামাজিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সমাজের রূপান্তর ঘটাতে হবে। আমাদের সামনে লম্বা লড়াই, দীর্ঘ সংগ্রাম। সেই সংগ্রামে আমাদের সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে,’— বলেন আবুল মোমেন।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধে সরকারের ওপর অতিরিক্ত আস্থা রেখে কোনো লাভ নেই। নিজেদের উদ্যোগে এলাকায়-এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। সবাই মিলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলতে হবে। নিজেদেরই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’
জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা বলেন, ‘কোনো কোনো সমাবেশে মানুষ থাকে ২০০ জন, পুলিশ থাকে ৩০০ জন। পূজামণ্ডপগুলোতে পুলিশ ছিল না কেন? মণ্ডপে-বাড়িঘরে গুণ্ডামি, বদমায়েশি, লুটপাট হয়; অথচ পুলিশ আসে না! বিএনপি যায় আওয়ামী লীগ আসে, আওয়ামী লীগ যায় বিএনপি আসে— দেশে সাম্প্রদায়িক সংকটের কোনো সমাধান হয় না। রাজনৈতিক দল যদি গুণ্ডা পোষে, ধর্মব্যবসায়ী পোষে— তাহলে সংকটের সমাধান হবে না।’
খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটির সভাপতি ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘কেউ বিশ্বাস করবে না, সনাতন ধর্মের লোকেরা নির্বোধের মতো তাদের পূজামণ্ডপে কোরআন রাখবে। এটি জঘন্য পরিকল্পনার অংশ। এর জের ধরে সারাদেশে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে। আমরা যাদের নির্বাচিত করে ক্ষমতায় বসিয়েছি, তাদের ভূমিকা কী ছিল? এই হামলার পর তাদের এবং এই রাষ্ট্রের দায় এড়ানোর আর কোনো সুযোগ নেই। এই বাংলাদেশ সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর রাষ্ট্র না। এটা বাঙালির রাষ্ট্র। কে হিন্দু, কে মুসলমান— এই চিন্তা করতে হলে পাকিস্তান থাকলে ক্ষতি কী ছিল! এই বাংলাদেশে সব মানুষের সমান অধিকার। কেউ সেই অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। সরকারকে বলছি— সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বন্ধ করুন। প্রয়োজনে আবারও গণজাগরণ মঞ্চ হবে এই বাংলাদেশে।’
আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত, বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার, নারীনেত্রী নুরজাহান খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনূস, কবি কামরুল হাসান বাদল, জাসদ নেতা জসীম উদ্দিন, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস, ওয়াকার্স পার্টির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহান, মহিলা পরিষদের লায়লা কবীর, সিপিবি নেতা সেহাবউদ্দিন সাইফু, সংগীতশিল্পী কল্পনা লালা ও শ্রেয়সী রায়, নাট্যজন আশীষ নন্দী, ম সাইফুল আলম চৌধুরী, সঞ্জীব বড়ুয়া, বাসদ নেতা মাহিন উদ্দিন, গণসংহতি আন্দোলনের হাসান মারুফ রুমী এবং ন্যাপ নেতা মিটুল দাশগুপ্ত।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর