Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুরা, মনিটরিংয়ে ঘাটতির অভিযোগ

ওমর ফারুক হিরু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৩১ অক্টোবর ২০২১ ১১:৩৩

ছবি: সারাবাংলা

কক্সবাজার: কক্সবাজার শহরের বৈদ্যঘোনার তাসরিফ ওমর বাবু তার ৫ বছরের ভাতিজা মাহিরকে নিয়ে সেলুনে যান তার চুল কাটাতে। সেলুনে গিয়ে দেখেন, মালিকসহ চার কর্মচারীর মধ্যে রয়েছে আট বছর বয়সী এক শিশুও। অন্যরা ব্যস্ত থাকায় সেই শিশুকর্মী বিজয়ই চুল কাটে মাহিরের।

এই বয়সী একটি শিশুকে কেন এই কাজ করতে হচ্ছে— এমন প্রশ্নের উত্তরে সেলুনের মালিক সঞ্চয় জানান, শিশুটি তার আত্মীয়। শিশুটির বাবা মারা গেছেন। মায়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ফলে শিশুটি লেখাপড়া করতে পারছে না। তাই কোনো একটি কাজ শেখানোর তাগিদ থেকেই সেলুনের কাজে ‘হাতেখড়ি’ হয়েছে তার।

বিজ্ঞাপন

শহরের কলাতলীতে বিকাশ বিল্ডিং সংলগ্ন একটি কার ওয়াশ (গাড়ি ধোয়া) প্রতিষ্ঠানেও দেখা গেল কাজ করছে আরেক শিশু। ১০ বছর বয়সী সেই শিশু মোটরসাইকেল ধোয়ার কাজ করছিল। কার ওয়াশ প্রতিষ্ঠানটির মালিক সালাউদ্দিন জানান, দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া বাদ দিতে হয়েছে ছেলেটিকে। পরিবারের জন্য কিছু আয়ের ব্যবস্থা করতেই তাকে সেখানে কাজ করতে হচ্ছে।
কেবল এই দুই শিশুই নয়, আইনে শিশুশ্রম অপরাধ হলেও কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন স্থানে এমন ‘কর্মজীবী’ শিশুর সংখ্যা সহস্রাধিক। চায়ের দোকান, ওয়ার্কশপ থেকে শুরু করে শুঁটকি মহাল ও সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন দোকানসহ বিভিন্ন স্থানে কর্মরত এসব শিশু। আর তাদের বড় একটি অংশ নিয়োজিত শুঁটকি মহালে, যেখানে শিশুস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন কাজ করতে হয় তাদের।

সচেতন মহলের বক্তব্য, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই শিশুশ্রমের এই বাড়বাড়ন্ত কক্সবাজারে। তারা বলছেন, বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ উদ্যোগ নিলেও জেলায় শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের সঠিক কোনো তথ্য-পরিসংখ্যান নেই। অন্যদিকে শিশুশ্রম বন্ধে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার এবং মনিটরিংয়ের ঘাটতি প্রকট। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে প্রশাসন বলছে, তারা তাদের দায়িত্বে অবহেলা করছে না। শিশুশ্রম বন্ধে প্রচার ও আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি যথাযথ মনিটরিংও চলছে!

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে সেভ দ্য চিলড্রেন কক্সবাজার এরিয়ার কেস ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞ তসলিমা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, একটি শিশুর যখন বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা, বন্ধুদের সঙ্গে হেসে-খেলে বেড়ানোর কথা, মায়ের কোলে শুয়ে গল্প শোনার কথা— বিভিন্ন কারণে তখন তাকে হাতে তুলে নিতে হচ্ছে হাতুড়ি, কিংবা ওয়েল্ডিং মেশিন কিংবা রিকশার হ্যান্ডেল। শিশুশ্রম তার জীবন থেকে কেড়ে নিচ্ছে আনন্দময় শৈশব। সে বঞ্চিত হচ্ছে তার প্রাপ্য অধিকারগুলো থেকে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৪ লাখ ৮০ হাজার শিশু শ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৩ লাখ শিশু কোনো না কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কজে নিয়োজিত। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কক্সবাজার জেলায় শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের তথ্য নেই তাদের কাছেও।

তসলিমা বেগম বলেন, একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে শিশুশ্রম নির্মূল সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর বাস্তবমুখী পরিকল্পনা। এই দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সমাজসহ সব নাগরিকের। পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করা, প্রতিটি শিশুর জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানো, পিতামাতা, অভিভাবকদের ও সব স্তরের মানুষের মধ্যে শিশুশ্রমের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ে যে শিশুশ্রম পর্যবেক্ষণ কমিটি আছে, সেগুলোকে কার্যকর করে তুলতে হবে। সর্বোপরি শিশুশ্রকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার যে মনোভাব আমাদের সমাজে রয়েছে, তার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে হবে।

কক্সবাজারের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণমূলক সংগঠন ‘নতুন জীবন’-এর সহসভাপতি মিনহাজ চৌধুরী বলেন, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী সব মানবসন্তানই শিশু। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তারা শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের শিক্ষায়, চিন্তা-চেতনা ও মননে যত সমৃদ্ধ হবে জাতির ভবিষ্যৎ তত শক্তিশালী হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সমাজের সামর্থ্যবান ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরা চাইলে এই এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দায়িত্ব নিয়ে সমাজের তথা রাষ্ট্রের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন।

শিশুশ্রম বন্ধে প্রশাসনের মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে অভিযোগ করে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, সঠিক প্রচারণার অভাবে গ্রামসহ বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া এলাকায় শিশুশ্রম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা অনেকেরই নেই। এসব এলাকায় সচেতনামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সঠিকভাবে মনিটরিং হচ্ছে না। ফলে শিশুশ্রম বাড়ছে। তাই শিশুশ্রম বন্ধে রাষ্ট্রের দেওয়া আইনের সঠিক প্রয়োগের বিষয়ে জোর দিতে হবে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৮.৭-এ বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রগুলোকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে হবে। শিশুশ্রম নিরসনে বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমকে নির্ধারণ করে ২০২৫ সালের মধ্যে সেগুলোকে বন্ধ করার অঙ্গীকার করেছে। তবে সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসাব অনুযায়ী দেশে যে প্রায় ৩৫ লাখ শিশুর শিশুশ্রমে নিয়োজিত থাকার তথ্য বলছে, এসডিজি’র এই লক্ষ্য পূরণে এখনো অনেক কাজ বাকি বাংলাদেশের।

উন্নয়ন ও সমাজকর্মী, জাতীয় সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস) চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা সারাবাংলাকে বলেন, যে সময় শিশুদের স্কুলে যাওয়ার কথা, ঠিক সেই সময় কিছু শিশুকে পেটের দায়ে বা অভাবের তাড়নায় শ্রম বিক্রি করতে হচ্ছে। এটি খুবই বেদনাদায়ক। প্রতিটি শিশুরই ছেলেবেলার অধিকারগুলো প্রাপ্য এবং তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র, সমাজ ও সব নাগরিকের দায়িত্ব। যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের দারিদ্র্যের কারণেই শিশুদের কাজে নিয়োজিত হতে হয়, তাই রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজের সামর্থ্যবানদেরও এগিয়ে আসতে হবে, শিশুদের দায়িত্ব নিতে হবে।

জানতে চাইলে প্রশাসনের দায়িত্বশীলতার পক্ষেই সাফাই গাইলেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখার উপপরিচালক শ্রাবস্তী রায়। তবে প্রশাসনের পাশাপাশি তিনিও সবাইকে সহযোগিতারই আহ্বান জানাচ্ছেন।

শ্রাবস্তী রায় সারাবাংলাকে বলেন, শিশুশ্রম বন্ধে প্রশাসন সক্রিয় রয়েছে। সচেতনতামূলক প্রচারণার পাশাপাশি নিয়মিত মনিটরিং চলছে। শিশু সুরক্ষা-নিরাপত্তা ও শিশুশ্রম বন্ধে প্রশাসনের পাশাপাশি সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। তখনই শিশুশ্রম বন্ধ নিশ্চিত করা যাবে।

সারাবাংলা/টিআর

কক্সবাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ শিশুশ্রম

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর