বাংলাদেশের পথঘাট, কল-কারখানা, বাসাবাড়ি কিংবা ছোট্ট চায়ের দোকান—কোথায় নেই শিশুশ্রমের করুণ দৃশ্য? কচি হাতে ভারী ইট তুলছে কেউ, কারও চোখে ঘুম জমে আছে ক্লান্তির ভারে, অথচ তারা খেলাধুলা করার বয়সেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। শিশুদের কাঁধে সংসারের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আমরা কি আসলে তাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছি না?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৪.৮ মিলিয়ন শিশু কোনো না কোনো শ্রমের সঙ্গে যুক্ত, যার মধ্যে ১.২ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। তারা ইটভাটা, গার্মেন্টস, ওয়ার্কশপ, বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকা, চা দোকানে কর্মচারী কিংবা কৃষি খাতে কায়িক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। এক গবেষণা বলছে, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ৩.৫৪ মিলিয়ন শিশু শ্রমে নিয়োজিত, যা মোট শিশু জনসংখ্যার ৮.৯%।
যেসব শিশুরা বাসাবাড়িতে কাজ করে, তাদের জীবনের গল্প আরও ভয়াবহ। সকাল থেকে রাত অবধি কাজ, মালিকের খিটখিটে মেজাজ সহ্য করা, সামান্য ভুলের কারণে গালাগাল বা মারধর—এটাই তাদের প্রতিদিনের চিত্র। কেউ কেউ আবার ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়, যেটা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
শিশুশ্রমের প্রধান কারণ হলো দারিদ্র্য। যারা প্রতিদিনের খাবারের নিশ্চয়তা পায় না, তাদের কাছে শিক্ষা বিলাসিতা মনে হয়। পরিবারগুলো যখন দেখছে, বাবা-মায়ের আয় সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়, তখন সন্তানদের কাজ করতে পাঠানো তাদের কাছে একমাত্র সমাধান মনে হয়। অনেকে মনে করে, ‘আমাদের সন্তান কাজ করলে সংসার চালানো সহজ হবে।’ কিন্তু তারা হয়তো বুঝতে পারে না, শিশুশ্রম তাদের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।
শিক্ষার সুযোগের অভাবও শিশুশ্রম বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। যদিও বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে, তবুও এখনও ৪৭% শ্রমজীবী শিশু স্কুলে যায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে, বিদ্যালয়ের পরিবেশ, গরিব পরিবারের টানাটানি, শিক্ষকদের অসহযোগিতা—সব মিলিয়ে শিশুরা ঝরে পড়ে।
শিশুশ্রমের আরেকটি বড় কারণ হলো সহজলভ্য সস্তা শ্রমের প্রতি সমাজের নির্লিপ্ততা। অনেকেই শিশুদের কাজ করানোকে অন্যায় মনে করে না, বরং সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়। যে কারণে অনেক মালিকপক্ষ নির্দ্বিধায় শিশুদের কম বেতনে নিয়োগ দেয়। আমাদের সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে শিশুশ্রম কখনোই পুরোপুরি নির্মূল হবে না।
একজন শিশু যখন প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করে, তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তারা নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার পায় না, বিশ্রামের সুযোগ নেই, ফলে নানা রোগে আক্রান্ত হয়। অনেক শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, যা তাদের কর্মদক্ষতাসহ আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে দেয়।
এছাড়া, যারা অল্প বয়সে কাজ করতে বাধ্য হয়, তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। তারা চুরি, মাদক ব্যবসা, কিংবা অন্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। কারণ সমাজ যখন তাদের শিক্ষার সুযোগ দেয় না, তারা তখন বিকল্প পথ খোঁজে।
বাংলাদেশ সরকার ২০০৬ সালে শ্রম আইন প্রণয়ন করেছে, যেখানে ১৪ বছরের নিচে শিশুদের কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ১৮ বছরের নিচে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, এই আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতার কারণে শিশুশ্রম বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশুদের জন্য শিক্ষা উপকরণ ও সহায়তা নিশ্চিত করা গেলে শিশুশ্রম কমবে। দরিদ্র পরিবারগুলো যাতে শিশুশ্রমের ওপর নির্ভর না করে, তার জন্য তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। বিশেষ করে মায়েদের জন্য জামানত বিহীন ঋণ, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দিলে শিশুশ্রম কমবে। যারা শিশুদের শ্রমে নিয়োগ দেয়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। অভিভাবক, সমাজ, মালিকপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে তারা শিশুশ্রমের ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারে।
শিশুশ্রম শুধু একটি সামাজিক সমস্যা নয়, এটি আমাদের জাতির ভবিষ্যতের জন্য বড় হুমকি। শিশুরা যদি উপযুক্ত শিক্ষা ও সুস্থ পরিবেশ না পায়, তাহলে তারা আমাদের ভবিষ্যতের সম্পদ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। আমাদের সরকার, সমাজ এবং প্রতিটি নাগরিককে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যেন কোনো শিশুকে তার শৈশব থেকে বঞ্চিত হতে না হয়।
একটি শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি। হ্যাঁ, যদি আমরা সবাই মিলে কাজ করি, তাহলে এই নির্মম বাস্তবতা একদিন কেবল অতীতের গল্প হয়ে থাকবে। আমাদের সন্তানেরা বই হাতে স্কুলে যাবে, কঠোর পরিশ্রমের ভারে ক্লান্ত হবে না—এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।
লেখক: এসিস্টেন্ট প্রজেক্ট অফিসার, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশ