‘রাজনীতিই বুঝতো না মাহাদি, অথচ সে-ই এখন মৃত্যুর মুখোমুখি’
৩১ অক্টোবর ২০২১ ২১:০৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ছেলে মাহাদি জে আকিব চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করার পর খুশির সীমা ছিল না স্কুলশিক্ষক বাবা গোলাম ফারুক মজুমদারের। অনেক স্বপ্ন নিয়ে ছেলেকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন চমেকে। বাবার বক্তব্য- স্কুলে, কলেজে পড়ার সময় কখনোই কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না মাহাদি। রাজনীতির প্রতি আগ্রহও ছিল না তার। চমেকের ছাত্রাবাসে থাকতে এসে তাকে পড়তে হয়েছে রাজনীতির ঘেরাটোপে। রাজনীতিটা ভালোভাবে বোঝার আগেই নির্মম হামলা বরণ করতে হয়েছে। হাসপাতালে ঠাঁই হয়েছে, মাহাদি এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাহাদির মাথায় অস্ত্রোপচার হয়েছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) প্রায় নিথর অবস্থায় আছেন এখন। তার মাথায় ব্যান্ডেজ মোড়ানো। সেখানে লেখা আছে- ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না।’ নিচে একটি বিপদজনক চিহ্নও এঁকে দেওয়া হয়েছে। চোখও সাদা ব্যান্ডেজে ঢেকে দেওয়া হয়েছে তার। হাড় নেই, চাপ দেবেন না- লেখা ব্যান্ডেজের ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তোলপাড় চলছে। প্রতিবাদে সরব হয়েছেন তার সহপাঠীরা শুধু নয়, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষও। চমেকে ছাত্রলীগের সংঘাতের রাজনীতি নিয়ে চলছে সমালোচনা।
চমেকের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাথায় এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে যে, অস্ত্রোপচারের সময় হাড়ের একাংশ খুলে আপাতত তার পেটের চামড়ার নিচে রাখা হয়েছে। অবস্থার উন্নতি হলে সেই হাড় প্রতিস্থাপন করা হবে। মূলত সেজন্যই ব্যান্ডেজের ওপর সতর্কতাসূচক মন্তব্য লেখা হয়েছে।
শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) রাতে চমেকের প্রধান ছাত্রাবাসে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারি হয়। এর জের ধরে শনিবার ক্যাম্পাসে উপমন্ত্রীর অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী মাহাদি জে আকিবকে (২১) মারধর করে নাছির অনুসারীরা। পরে দু’পক্ষে আবারও মারামারির ঘটনা ঘটে।
মাহাদি জে আকিব চমেকের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আহত আকিবের অস্ত্রোপচার হয় শনিবার। এই ঘটনার পর শনিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রাতই ছাত্রাবাস ছাড়েন শিক্ষার্থীরা। মাহাদি জে আকিবকে মারধরের ঘটনায় তার নিকটজন ও চমেকের এমবিবিএস চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র তৌফিকুর রহমান বাদি হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ১৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে যাদের সবাই চমেকের ছাত্র। এদের মধ্যে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
মাহাদির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে তৌফিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আজ (রোববার) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার দিকে সংজ্ঞা ফিরেছে। লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়েছে। চোখের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলা হয়েছে। সন্ধ্যার দিকে সে একটু একটু কথা বলতে শুরু করেছে। চোখ খুলতে পারছে। তবে তার অবস্থা এখনও বিপদজনক। এ ধরনের রোগীর অবস্থার যে কোনোসময় অবনতি হতে পারে।’
মাহাদি জে আকিবের বাবা গোলাম ফারুক মজুমদার কুমিল্লা জেলা স্কুলের শিক্ষক। তাদের বাড়ি কুমিল্লায়। সারাবাংলাকে তিনি জানান, এক বছর আগে চমেকে ভর্তি হলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এতদিন মাহাদিকে চট্টগ্রামে এসে থাকতে হয়নি। মাত্র চারমাস আগে মাহাদি ছাত্রাবাসে ওঠেন। মাহাদি কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে এসএসসি ও নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন।
গোলাম ফারুক বলেন, ‘স্কুলে পড়ার সময় মাহাদি কোনোদিন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। এরপর কলেজে ভর্তি হয়েও সে কোনোদিন রাজনীতিতে জড়ায়নি। নটরডেম কলেজে সেই সুযোগও ছিল না। রাজনীতি নিয়ে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। চমেকে এসে হোস্টেলে থাকতে গিয়ে হয়ত ছাত্রলীগের কিছু বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। হোস্টেলে যার প্রভাব বেশি তার সঙ্গে থাকতে হয়, এটাই নিয়ম। আমরা জানতাম, মাহাদি সেভাবে রাজনীতি করত না। রাজনীতিই সে বুঝতো না। মাত্র চার মাসে কী আর রাজনীতি করবে! রাজনীতি বোঝার আগেই আমার ছেলেটা হামলার শিকার হয়ে এখন মৃত্যুর মুখোমুখি। আল্লাহর কাছে বলছি, আমার ছেলেটা যেন সুস্থ হয়ে ফিরে আসে।’
মাহাদির ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার বাদি তৌফিকুর রহমানের বাড়িও কুমিল্লা জেলায়। একই এলাকায় বাড়ি হওয়ায় দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মাহাদিকে চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র তৌফিকুর আপন ছোট ভাইয়ের মতোই দেখভাল করতেন।
শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেলের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা তৌফিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাহাদির বড় ভাই প্রতিবন্ধী। মাহাদি আমাকে বলতো, আমার বড় ভাই সুস্থ থাকলে আমার দেখাশোনা করত। এখন আপনিই (তৌফিকুর) আমার বড় ভাই। আমি নিজের ভাইয়ের মতোই তাকে দেখেছি। আমাদের কলেজে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ। অনলাইনে কিংবা অভ্যন্তরীণভাবে আমরা ছাত্রলীগের যেসব প্রোগ্রাম করতাম, সেগুলোতে মাহাদি অংশ নিত। বয়সে ছোট, সে সামনের সারির কেউ ছিল না। শুধুমাত্র আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো বলে তাকে হামলার শিকার হতে হয়েছে।’
সামগ্রিক পরিস্থিতিতে চমেকের অধ্যক্ষ শাহেনা আক্তারের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ আছে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারীদের মধ্যে। ছাত্রলীগের আরেক গ্রুপ সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। ঘটনার পর থেকে ওই অংশটি নিশ্চুপ আছে।
তৌফিকুর রহমান জানান, শুক্রবার রাতে হামলার পর অধ্যক্ষ ছাত্রলীগের বিবদমান দুই গ্রুপকে নিয়ে বৈঠক করেন। উভয় গ্রুপ থেকে চারজন করে আটজন এতে অংশ নেয়। অধ্যক্ষ সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু বৈঠক শেষে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীরা মাহাদিসহ ৪-৫ জনকে ক্যাম্পাসে পেয়ে হামলা করে।
‘মাহাদি বৈঠকে ছিল না। সিনিয়র লেভেলের আমরা চার জন ছিলাম। বৈঠক শেষে আমরা ফিরে যাই। কিন্তু নাছির সাহেবের অনুসারীরা আগে থেকেই হামলার প্রস্তুতি নিয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়েছে, এটা আমরা বুঝতে পারিনি। মাহাদিসহ ৪-৫ জনকে দেখে ধাওয়া দেয়। এসময় মাহাদি পড়ে যায়। তখন তাকে হকিস্টিক দিয়ে বেধড়ক পেটায়। এখন আমরা বুঝতে পারছি- অধ্যক্ষ আমাদের বৈঠকে ডেকে পরে আবার আমাদের গ্রুপের ছাত্রদের ওপর হামলা করিয়ে আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং বিএমএ নেতা ফয়সল ইকবালের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন’— বলেন তৌফিকুর রহমান।
এ ঘটনায় চমেকের অধ্যক্ষ শাহেনা আক্তারের বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার ফোন করেও সাড়া পায়নি সারাবাংলা।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম