চট্টগ্রাম বন্দরে স্থবিরতা, গণপরিবহন বন্ধে ভোগান্তি
৫ নভেম্বর ২০২১ ১২:৫৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে সারাদেশের মতো বৃহত্তর চট্টগ্রামেও বাসসহ বিভিন্ন ধরনের গণপরিবহন ও পণ্যবাহী পরিবহন চলাচল বন্ধ আছে। পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরে স্থবিরতা বিরাজ করছে। কনটেইনার খালাস ও ডিপোতে আসা-যাওয়া স্বাভাবিক থাকলেও খোলা পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
শুক্রবার (৫ নভেম্বর) সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় গণপরিবহন বন্ধের প্রভাব জোরালোভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। তবে ছুটির দিনে চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে যেতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে নাগরিকদের। অটোরিকশায় বাড়তি ভাড়াও গুণতে হচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সীমিত আকারে বাস-ট্রাক চলতে দেখা গেছে, তবে সংখ্যায় খুবই নগণ্য।
অঘোষিত ‘ধর্মঘটে’র কারণে শুক্রবার সকাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন নিমতলাসহ আশপাশের এলাকায় ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। নগরীতে মাঝে মাঝে দুয়েকটি ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান দেখা গেলেও বন্দর অভিমুখী পণ্যবাহী কোনো যান দেখা যাচ্ছে না। সকাল থেকেই আমদানি করা পণ্য ডেলিভারি নিতে কোনো ট্রাক-কার্ভাড ভ্যান ও লরি বন্দরে ঢুকতে পারেনি। তেমনি বন্দরে ঢোকা গাড়িগুলোও সকালে বন্দর থেকে বের হতে পারেনি।
আরও পড়ুন- অঘোষিত ধর্মঘটে ‘অচল’ ঢাকা সারাদেশ থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’
চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্দরের জেটিতে জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাস অব্যাহত আছে। রফতানি কনটেইনারও জাহাজে তোলা হচ্ছে। তবে ইয়ার্ডে কনটেইনার ও খোলা পণ্যবোঝাই জাহাজ থেকে পণ্য নেওয়ার জন্য সকাল থেকে কোনো পরিবহন প্রবেশ না করায় কার্যত বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় বন্দরে কনটেইনার জট তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্দরের কার্যক্রমে কোনো সমস্যা নেই। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় অ্যাসাইনমেন্টও কম থাকে। যেটুকু থাকে, সেগুলোও যাচ্ছে না। তবে জাহাজে কনটেইনার ওঠানামা ও ডিপোতে নিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক আছে। খোলা কার্গো না যাওয়ায় সংকট হচ্ছে। বন্দরের কনটেইনারের ধারণক্ষমতা ৪৯ হাজার। দুই-তিন দিন ডেলিভারি বন্ধ থাকলে ইয়ার্ডে বড়ো ধরনের জট তৈরি হবে।’
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ডেলিভারি ছাড়াও বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলো থেকে রফতানি কনটেইনারও যাচ্ছে না। সকাল থেকে ডিপোগুলোতে হাতেগোনা কিছু লং ভেহিকেল প্রবেশ করেছে। তবে বেলা গড়াতেই সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার ডেলিভারি ও রফতানি কনটেইনার প্রবেশ বন্ধ থাকলে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। রফতানি পণ্য ছাড়াই জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগে বাধ্য হলে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে। শিল্প-কারখানায় কাঁচামালের সংকট তৈরি হবে।
আন্তঃজেলা মালামাল পরিবহন সংস্থা ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক তকিউর রহমান টিপু সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ট্রাক-কাভার্ডভ্যান চলছে। যেগুলো আগে মাল নিয়ে ফেলেছে, জরুরিভাবে পৌঁছাতে হবে সেগুলো চলছে। এর বাইরে বাকি সব বন্ধ আছে। চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো পরিবহন যায়নি। আমাদের ২৪ ঘণ্টার একটা আলটিমেটাম আছে। দেখি সরকার কী সিদ্ধান্ত নেয়।’
সরকারি সিদ্ধান্তে বুধবার (৩ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বেড়েছে। এরপর বৃহস্পতিবার পরিবহন চালানো বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ ট্রাক-কভার্ড ভ্যান ড্রাইভার ইউনিয়ন। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার অথবা ভাড়া বাড়ানো না হলে শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে সারাদেশে বাস এবং পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকবে।
এ অবস্থায় সারাদেশের মতো বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় চলাচলকারী সব বাস ও এর সঙ্গে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা সরাসরি যাওয়া দূরপাল্লার বাস চলাচল শুক্রবার সকাল থেকে বন্ধ আছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি মোহাম্মদ মুসা সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলার অভ্যন্তরীণ সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ আছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচলকারী ৬৮ রুটের বাসও বন্ধ আছে। এছাড়া উপজেলা ও আঞ্চলিক রুটের বাসও চলছে না।
‘এটি কোনো ঘোষিত ধর্মঘট নয়। শ্রমিকরাও বাস বন্ধ করেনি। এটি মালিকপক্ষের সিদ্ধান্ত। মালিকরা বলছেন, হঠাৎ করে যেভাবে ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, তাতে খরচ এত বেড়েছে যে বিদ্যমান ভাড়ায় তারা আর গাড়ি চালাতে পারবেন না। তাদের লস হবে। তারা ডিজেলও কিনতে পারছেন না। এজন্য মালিকপক্ষ বাস চলাচল বন্ধ রেখেছে,’— বলেন মোহাম্মদ মুসা।
আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে আন্তঃজেলার ৫০টি রুটে দূরপাল্লার বাস চলাচল আমরা বন্ধ রেখেছি। প্রতি কিলোমিটারে ২৫ পয়সা করে জ্বালানি খরচ বেড়েছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের হিসেব যদি করি, যাওয়া-আসায় একটি বাসের ১০০ লিটার তেল লাগে। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর ফুয়েলে খরচ বেড়েছে অন্তঃত দেড় হাজার টাকা। এই বাড়তি খরচের একটা সমাধান তো আসতে হবে। সরকার বলছে, বাস ভাড়া বাড়াবে। কিন্তু সেটি না হওয়া পর্যন্ত আমরা তো লস দিয়ে চালাতে পারি না।’
শুক্রবার সকালে নগরীর লালখান বাজার মোড় থেকে ষোলশহর দুই নম্বর গেইট পর্যন্ত ঘুরে হাতেগোনা কয়েকটি সিটিবাস দেখা গেছে। অটোটেম্পু, হিউম্যান হলার তেমন নেই। তবে সকালে নগরী থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখে কিছু বাস ও হিউম্যান হলার ছেড়ে গেছে বলে জানা গেছে। রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল স্বাভাবিক দেখা গেছে। খোলা থাকা কলকারখানায় শ্রমজীবীদের রিকশা-অটোরিকশায় যেতে দেখা গেছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে ১৫টি রুটে বাস, ১৭টি রুটে হিউম্যান হলার এবং ২১টি রুটে অটোটেম্পু বন্ধ আছে। কিছু অটোটেম্পু কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকার দিকে চলাচল করছে। এর বাইরে সব পরিবহন বন্ধ আছে। ডিজেলের দাম বাড়ার পর প্রতিটি বাসে দৈনিক ৯০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা খরচ বেড়ে গেছে। আমরা কীভাবে গাড়ি চালাব?’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর