চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা, সংকটে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য
৮ নভেম্বর ২০২১ ১৭:৫৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: জ্বালানি তেলের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে চার দিন ধরে বন্ধ পণ্যবাহী পরিবহন। এতে সংকটে পড়েছে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরে গত চার দিন ধরে রফতানি কনটেইনার প্রবেশ কার্যত বন্ধ আছে। আমদানি কনটেইনার জাহাজ থেকে খালাস হলেও বন্দর থেকে বের হতে পারছে না। কনটেইনার ও পণ্যবাহী ট্যাংক লরি, প্রাইম মোভার, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান চলাচল বন্ধ থাকায় বন্দরের ইয়ার্ডে ও বেসরকারি ডিপোতে কনটেইনারের স্তূপ জমেছে। এছাড়া রফতানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার ফেলে দু’টি বিদেশি জাহাজ কলম্বোর উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করেছে।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এ অবস্থা আর দুই-তিন দিন অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় দেখা দেবে। তাতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে এবং বাংলাদেশ রফতানির বাজার হারাবে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর বেসরকারি ডিপো সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্যবাহী পরিবহন ধর্মঘট অব্যাহত থাকলে জাহাজ ও কনটেইনার জট তৈরি হবে।
সরকারি সিদ্ধান্তে গত বুধবার (৩ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বেড়েছে। এরপর বৃহস্পতিবার পরিবহন চালানো বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ ট্রাক-কভার্ড ভ্যান ড্রাইভার ইউনিয়ন। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার অথবা ভাড়া বাড়ানো না হলে শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে সারাদেশে বাস ও পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকবে।
এ অবস্থায় সারাদেশের মতো বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় চলাচলকারী সব বাস এবং এর সঙ্গে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা সরাসরি যাওয়া দূরপাল্লার বাস চলাচল শুক্রবার সকাল থেকে বন্ধ হয়ে যায়। একইসঙ্গে পণ্য বহনকারী ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, লরি-প্রাইম মোভার চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। ভাড়া বাড়ানোর পর সোমবার (৮ নভেম্বর) সকাল থেকে গণপরিবহন চলাচল স্বাভাবিক হলেও পণ্য বহনকারী পরিবহন ধর্মঘট এখনও অব্যাহত আছে।
আন্তঃজেলা মালামাল পরিবহন সংস্থা ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক তকিউর রহমান টিপু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন শিল্প, কলকারখানার পণ্য পরিবহন করি। তাদের সঙ্গে আমাদের বাৎসরিক চুক্তি হয়। তেলের দাম বাড়ার পর আমাদের প্রতি ট্রিপে কমপেক্ষ তিন হাজার টাকা খরচ বেড়ে গেছে। এখন আমরা যদি তাদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করি, তাহলে চুক্তিভঙ্গ হবে। সেজন্য আমরা সমন্বয়ের কথা বলছি। সমন্বয় করা না হলে আমরা পণ্য পরিবহন করতে পারব না।’
শুক্রবার থেকে পণ্যবাহী পরিবহন ঢুকছে না চট্টগ্রাম বন্দরে। এর ফলে ডিপো থেকে রফতানি পণ্যবোঝাই কোনো কনটেইনারও বন্দরে যাচ্ছে না। আবার জাহাজ থেকে আমদানি পণ্যবোঝাই কনটেইনার খালাসের পর সেগুলো ডিপোতে নেওয়া যাচ্ছে না। জাহাজ থেকে খালাস হওয়া খোলা পণ্যও গন্তব্যে যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে ৪৯ হাজার টিইউস কনটেইনারের ধারণক্ষমতা আছে। গত চার দিনে তিন হাজারের বেশি কনটেইনার জমে গিয়ে সোমবার ইয়ার্ডে কনটেইনার আছে ৩৮ হাজার ১০০ টিইউস। সোমবার দুপুর পর্যন্ত তথ্য বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ১৪টি ও বর্হিনোঙরে ৬৫টি জাহাজ পণ্য নিয়ে অবস্থান করছে। জেটি থেকে দু’টি জাহাজ দুপুরে রফতানি পণ্যের কনটেইনার না নিয়েই শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরের উদ্দেশে চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিপো থেকে রফতানি কনটেইনার আসছে না বললেই চলে। গতকাল (রোববার) একেবারে নগণ্য পরিমাণে, হাতেগোনা কয়েকটি এসেছিল। সেগুলো জাহাজে তোলা হয়। গত চার দিনে আর তেমন কোনো রফতানি কনটেইনার জাহাজে তোলা যায়নি। আমদানি কনটেইনার খালাস চলছে। ইয়ার্ডে এখনও পর্যাপ্ত জায়গা আছে। তবে অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যাচ্ছে। দু’টি জাহাজ এক্সপোর্টের কনটেইনার না নিয়েই বন্দর ছেড়ে গেছে।’
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে দুইটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে গেছে সেগুলো তাদের ধারণক্ষমতার দশ ভাগের একভাগ কনটেইনারও নিতে পারেনি। এভাবে কনটেইনার ছাড়া যে জাহাজগুলো চলে যাচ্ছে, পরে তো জাহাজ মালিকরা জাহাজ পাঠাতে রাজি হবেন না অথবা ভাড়া বাড়িয়ে দেবেন। এছাড়া ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট যেগুলো আছে, সেখানেও প্রভাব পড়বে। ধর্মঘট উঠে যাওয়ার পর যখন চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজ যাওয়া শুরু করবে, তখন সেখানে জট দেখা দেবে। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এটি খুবই দুঃখজনক। শিপিং বাণিজ্যে আমাদের খুবই নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হবে।’
দেশের ১৯টি বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে ৭৮ হাজার টিইউস কনটেইনারের ধারণক্ষমতা আছে। এর মধ্যে ৫৩ হাজার টিইউস ধর্মঘটের কারণে জমে যাওয়া কনটেইনার। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডিপোগুলোতে রফতানি কনটেইনার আটকা পড়েছে ১০ হাজার ১০০ টিইউস। আমদানি কনটেইনার আটকে আছে ৮ হাজার ৭০০ টিইউস। আর খালি কনটেইনার আছে ৩৪ হাজার টিইউস।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন বিপ্লব সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত শুক্রবার থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো কনটেইনার ডিপো থেকে যাচ্ছে না। এ অবস্থা আর দুই-তিন দিন থাকলে ডিপোতে কনটেইনারের জট তৈরি হবে। রোববার ও সোমবার মিলে পাঁচটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে তিনটি জাহাজ অন্তত এক হাজার রফতানি কনটেইনার না নিয়ে বন্দর ছেড়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা সবাই এ অবস্থার দ্রুত অবসান চাই।’
আমদানি পণ্য খালাস ও রফতানি পণ্য জাহাজীকরণ বন্ধ থাকার নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে দেশের অর্থনীতিতে। সবচেয়ে বড় চাপ তৈরি হয়েছে পোশাক শিল্প খাতে।
বিজিএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চলতি অর্থবছরে ৪৩ বিলিয়ন পণ্য রফতানির টার্গেট নিয়েছি। গত মাসে আমরা চার বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছি। প্রতিমাসে তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানির টার্গেট আমাদের আছে। কিন্তু যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে এ মাসের টার্গেট পূরণ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।’
তিনি বলেন, আর দুই-তিন দিন এ অবস্থা থাকলে বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের দাম কমাতে বলবে অথবা বিমানে পাঠাতে বলবে। সেটি করতে হলে আমরা পুরোই লোকসানে পড়ে যাব। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে রফতানি বাণিজ্যে আমরা যখন আশার আলো দেখছিলাম, তখন এই ধর্মঘট আমাদের কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে।’
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বন্ধ। যেহেতু পরিবহন ধর্মঘট চলছে, সড়কপথেও আমদানি-রফতানি বন্ধ। এর প্রভাবে কারখানায় কাঁচামালের সংকট হবে, উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। বাজারে পণ্যের সংকট হবে, দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের ওপর এর প্রভাবটা পড়বে। সামগ্রিক ক্ষেত্রে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির তৈরি হবে।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর
আমদানি-রফতানি বাণিজ্য কনটেইনার জট চট্টগ্রাম বন্দর পণ্য পরিবহন পণ্য পরিবহনে ধর্মঘট