৭২ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষণ মামলার পরামর্শে বাড়তে পারে নারী নির্যাতন
১১ নভেম্বর ২০২১ ২৩:৪৫
ঢাকা: রাজধানীর বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলার রায় দিয়েছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭। আলোচিত এই মামলায় প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ জনকেই খালাস দিয়েছেন আদালত। এই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টার পরে ডাক্তারি পরীক্ষায় আলামত প্রমাণ সম্ভব না। তাই ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পার হলে যেন মামলা না নেয়, পুলিশকে সেই ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন বিচারক।
২০১৭ সালে দায়ের করা এই মামলাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল অনলাইনে-অফলাইনে। আসামি সাফাতসহ বাকিদের গ্রেফতারে নানা ধরনের বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করেন। রায়ে পাঁচ আসামির সবাই খালাস পাওয়ার পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারের পর্যবেক্ষণও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। আইনজীবী, নারী অধিকারকর্মী, সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানীসহ সচেতন মহলও এই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদালতের এ ধরনের পর্যবেক্ষণে আমাদের সমাজে নারী নির্যাতনের ঘটনা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলো। এমনিতেই সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হলে সহজে মুখ খোলেন না, মামলা করতেও তাদের বারবার ভাবতে হয়। ধর্ষকরা প্রভাবশালী হলে মেয়েদের জন্য ন্যায় বিচার পাওয়ার পথ অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে যায়। অনেক ঘটনাই সামাজিকভাবে, এমনকি পুলিশের হস্তক্ষেপে তথাকথিত সালিশের মাধ্যমে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়। মামলা নিতে পুলিশের গড়িমসির অভিযোগও রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। আবার প্রান্তিক পর্যায়ের মেয়েরা বেশিরভাগ সময়ই সামাজিক বা আইনি কোনো সংগঠনের সাহায্য ছাড়া ধর্ষণের মামলা দায়ের করতেই পারেন না। এমন পরিস্থিতিতে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নিতে বিচারকের ‘পরামর্শ’ গোটা প্রক্রিয়াটিকে আরও জটিল করে তুলবে।
আরও পড়ুন- ‘পুলিশ যেন ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা না নেয়’
বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারের আদালত আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মামলার অভিযোগপত্রে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ এবং ধর্ষণে সহায়তার অভিযোগে অভিযুক্ত সাদমান সাকিফ, রহমত আলী ও বিল্লাল হোসেনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আদালত বলেছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এই অভিযোগপত্রটি দায়ের করার মাধ্যমে ‘আদালতের সময় নষ্ট করেছেন’ বলেও পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন বিচারক।
রায় ঘোষণার পর মামলার অন্যতম আসামি নাঈম আশরাফের আইনজীবী এম এ বি খায়রুল ইসলাম (লিটন) বলেন, সাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী মডেল পিয়াসা ষড়যন্ত্র করে ঘটনার ১ মাস ৮ দিন পরে মামলাটি দায়ের করিয়েছেন। আসামিদের সঙ্গে ভিকটিমদের ডিএনএ ম্যাচ করেনি। ৯৪ কর্মদিবসে মামলাটির রায় রয়েছে। ৯৩ কার্যদিবসে মিথ্যা মামলায় আদালতের সময় নষ্ট হয়েছে বলে বিচারক উল্লেখ করেছেন। ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টার পরে ডাক্তারি পরীক্ষায় আলামত প্রমাণের কোনো সম্ভাবনা থাকে না। তাই ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পার হলে যেন পুলিশ ধর্ষণের মামলা না নেয়, সে বিষয়ে তিনি (বিচারক) সুপারিশ করবেন বলেও জানিয়েছেন।
আদালতের এই পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফারহানা আফরোজ আহমেদ অরেঞ্জ সারাবাংলাকে বলেন, আদালত আজকের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্তব্য করেছেন। ধর্ষণ মামলায় ৯ (১) ধারায় ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রমাণ করা না গেলে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গুরুত্ব পায়। এই মামলায় সেটি বাদীর পক্ষে যায়নি। ৩৮ দিন পর মামলা করায় মেডিকেল পরীক্ষায় ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য পক্ষে না থাকলে এই পরীক্ষার প্রতিবেদনের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। আর সেখানে ধর্ষণ প্রমাণের জন্য ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই পরীক্ষা হওয়া জরুরি।
এ ক্ষেত্রে অবশ্য নারীকে ধর্ষণের শিকার প্রমাণ করার বদলে অভিযুক্তকে নির্দোষ প্রমাণের দায় রেখে আইনের পরিবর্তন চাইলেন রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী। তিনি বলেন, আমাদের আইনে নির্যাতনের শিকার নারীকেই প্রমাণ করতে হয় যে তিনি ধর্ষণের শিকার। মেডিকেল অফিসার অনেকের ক্ষেত্রে লিখে দেন ‘নট রিসেন্ট’, যা বাদীর আগের যৌন অভ্যাসকে ইঙ্গিত করে। এর মাধ্যমে নারী চরিত্রের বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়, যার সঙ্গে মামলার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই ধর্ষণ মামলায় ধর্ষণ প্রমাণের দায় ভিকটিমের ওপর না রেখে আসামির ওপর রাখা হোক। তাকে প্রমাণ করতে বলা হোক যে সে ধর্ষণ করেনি। তাই পরীক্ষা দুই পক্ষেরই হওয়া উচিত। নারীর যৌন অভ্যাসের বিষয় যেন কোনোভাবেই বিবাচনায় না আনা হয়। কারণ বিভিন্ন বয়সের নারীই ধর্ষণের শিকার হতে পারেন, কিন্তু বিচার পাওয়ার অধিকার সবারই আছে।
আরও পড়ুন- রায়ে অসন্তোষ ভিকটিমের পরিবারে, আসামিপক্ষের উল্লাস
এমন পর্যবেক্ষণ নারীদের নিরাপত্তাহীনতাকে বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বিচারকের বিরুদ্ধে কিছু বলছি না। কিন্তু আদালতের এমন মন্তব্যে নারী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর ফলে নারী নির্যাতন আরও বাড়বে। এমনিতেই আমাদের সমাজের নারীরা নির্যাতনের ঘটনায় সহজে মুখ খোলে না। বিশেষ করে প্রান্তিক নারীরা নির্যাতনের শিকার হলে নিজ থেকে ততক্ষণ থানায় বিচার চাইতে যেতে পারেন না, যতক্ষণ না পর্যন্ত পাশে কেউ দাঁড়ায়। এমনকি শহুরে শিক্ষিত বা আধুনিক নারীরাও অনেকসময় লোকলজ্জার ভয়ে বা নিরাপত্তার ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ধর্ষণের বিচার চাইতে পারেন না।
সাদেকা হালিম আরও বলেন, এখন দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ ধর্ষণের সঙ্গে প্রভাবশালী নাম জড়িয়ে থাকে। তাই আমাদের দেশের নারীরা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা কারণেই মামলা করতে যায় না। ফলে তারা ধর্ষণের শিকার হলেও বিচার থেকে বঞ্চিত থাকে। আমরা এত আধুনিক রাষ্ট্র হলেও সব ক্ষেত্রে আধুনিক হতে পারিনি। করোনার মধ্যে এত দিনের চাওয়ার পর ধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় আনা হলো, যার পেছনে বিরাট সামাজিক আন্দোলন জড়িত ছিল। আজ এই পর্যবেক্ষণের পরে মনে হচ্ছে— নারী নিরাপত্তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। গৃহবন্দি করে ধর্ষণের ঘটনা আগেও ঘটেছে। এটি আরও বাড়বে বলেই মনে হয়।
একই রকম ধারণা করছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদা রেহানা বেগমও। তিনি বলেন, এর ফলে আরও নির্যাতন বাড়বে। কেবল মেডিকেল টেস্টের ওপর ধর্ষণ মামলার পুরোটা নির্ভর করে না। আর মেডিকেল টেস্ট ভুক্তোভোগীর ওপর নির্ভর করে না। ধর্ষণের অভিযোগ পেলে পুলিশ একজন ভুক্তোভোগীকে সরকারি হাসপাতালে টেস্টের জন্য পাঠান। একজন সরকারি চিকিৎসককেই এই পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেবাদাতাদের কালক্ষেপণ করতে দেখা যায়। সব হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার এখনো নেই, যার দাবি দীর্ঘ দিনের। তাই ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই অভিযোগ এলেও যে তাৎক্ষণিকভাবে ধর্ষণের আলামত জব্দ করা ও মেডিকেল পরীক্ষা সম্ভব হবে— এমনটিও নিশ্চিত নয়।
আরও পড়ুন- রায় শুনে হাসিমুখে বের হলেন সাফাতসহ ৫ আসামি
মাসুদা রেহানা বেগম আরও বলেন, ‘কোনো মেয়ে ধর্ষণের অভিযোগ আনলেই সেটি গুরুত্ব দিয়ে বিচারের আওতায় আনা উচিত। আদালত আজকের মামলার রায়ের যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তাতে নারীর প্রতি বৈষম্যের পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।’ বিচারকের এমন পর্যবেক্ষণকে ‘জেন্ডার ইনসেনসিটিভ’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে গাজী টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সারাবাংলাকে বলেন, আদালতের এমন পরামর্শে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটি আরও সংশয় তৈরি করবে বলেই মনে করি। আদালত তদন্তের দুর্বলতার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মামলা না করলে মামলা না নেওয়ার পরামর্শ সুবিবেচনাপ্রসূত বলে মনে হয়নি। এর ফলে ধর্ষক ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারে। তাছাড়া ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সবার পক্ষে মামলা করতে আসা সম্ভবও না। বিশেষ করে প্রান্তিক এলাকার ক্ষেত্রে, যেটি আমরা বেগমগঞ্জের ঘটনায় দেখেছি।
আরও পড়ুন- রেইনট্রি ধর্ষণ মামলা: সাফাতসহ ৫ আসামি খালাস
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান সারাবাংলাকে বলেন, আদালত কোন প্রেক্ষাপটে এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে না জেনে সরাসরি কোনো মন্তব্য করা কঠিন। তবে আমাদের দেশের ফৌজদারি অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াতেই গলদ আছে। আজকের রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, আমরা এখনো আধুনিক হতে পারিনি। বিচার বিভাগ ও পুলিশ বিভাগের একে অন্যকে দোষারোপ করার প্রবণতা আছে। পুলিশ অভিযোগপত্র দিতে দেরি করায় মামলার বিচার পিছিয়ে যায়। আবার বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার অভিযোগ আনে পুলিশ। এর ফলে ভুক্তোভোগী অনেকসময় ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হন। এক্ষেত্রে ধর্ষণ মামলার বিদ্যমান আইন আরও আধুনিক করা দরকার।
৭২ ঘণ্টার পর ধর্ষণের মামলা না নিতে বিচারকের ‘পরামর্শ’ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এই ঢাবি শিক্ষক বলেন, সামাজিক-পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এমন বার্তা অনেক সময় মানুষের অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দিতে পারে। হ্যাঁ, অনেক সময় আসামি মিথ্যা মামলার শিকার হতে পারেন। কিন্তু সেটিও আদালতে বিচারের মাধ্যমেই প্রমাণিত হতে হবে। তাছাড়া আমাদের দেশের সামাজিক অসমতার বিষয়টি তো আছেই।
৭২ ঘণ্টার মধ্যে মামলা দায়েরে র ‘পরামর্শে’র মাধ্যমে অবশ্য আদালত একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন বলে মনে করছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফারহানা আফরোজ আহমেদ অরেঞ্জ। আর সেটি হলো— দ্রুত আইনের আশ্রয় নিতে হবে ভিকটিমকে। তিনি বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় যেন বাদী কোনোভাবেই সময় ক্ষেপণ না করে থানায় যান এবং মামলা করেন— আদালতের পর্যবেক্ষণে এই বার্তাটিও উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে পুলিশকেও যত দ্রুতসম্ভব আলামত সংগ্রহ করে মেডিকেল পরীক্ষার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক সময় সচেতনতার অভাবে আসামিরা পার পেয়ে যায়। তাই ধর্ষণের ঘটনায় যতদ্রুত সম্ভব আইনের আওতায় আসার আহ্বান জানান তিনি।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
আপন জুয়েলার্স দুই তরুণীকে ধর্ষণ ধর্ষণ মামলার রায় নাঈম আশরাফ বিচারক কামরুন্নাহার বিল্লাল হোসেন রহমত আলী রায়ের পর্যবেক্ষণ রেইনট্রি ধর্ষণ মামলা রেইনট্রিতে ধর্ষণ সাদমান সাকিফ সাফাত আহমেদ হোটেল রেইনট্রি