Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘রেইনট্রি ধর্ষণ মামলার রায় চরমভাবে জেন্ডার বৈষম্য তৈরি করেছে’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৪ নভেম্বর ২০২১ ১৯:৩১

রেইনট্রি ধর্ষণ মামলার রায় ও পর্যবেক্ষণের প্রতিক্রিয়া জানাতে মহিলা পরিষদের মানববন্ধন

ঢাকা: রাজধানীর বনানীতে রেইনট্রি হোটেলের দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ধর্ষণের মামলার রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন উঠে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা বলছেন, এই পর্যবেক্ষণ নারীর প্রতি সংঘটিত অপরাধকে আরও ঘনীভূত করবে এবং সুষ্ঠুভাবে বিচার কাজ পরিচালনাকে বাধাগ্রস্ত করবে। এই রায় জেন্ডার সমতা তৈরির পরিবর্তে চরমভাবে জেন্ডার বৈষম্য তৈরি করেছে।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১৪ নভেম্বর) বিকেলে রেইনট্রি ধর্ষণ মামলার রায়ের পর বিচারিক আদালতের পর্যবেক্ষণের প্রতিক্রিয়া জানাতে আয়োজিত এক মানববন্ধনে মহিলা পরিষদের নেতারা এসব কথা বলেন। মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে সুপ্রিম কোর্টের সামনের কদম ফোয়ারার পাশে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা রোধ ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতে মানববন্ধন থেকে কয়েকটি দাবিও তুলে ধরা হয়।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, আলোচিত রেইনট্রি হোটেলের ধর্ষণের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আমরা অত্যন্ত হতাশ ও উদ্বিগ্ন। ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় এই পর্যবেক্ষণ নারীর প্রতি সংঘটিত অপরাধকে আরও ঘনীভূত করবে, সুষ্ঠুভাবে বিচার কাজ পরিচালনাকে বাধাগ্রস্ত করবে। এর ফলে দেশের দু’জন নাগরিকের প্রতি চরম অবমাননা করা হয়েছে, তাদের মানহানি করা হয়েছে এবং তাদের মানবাধিকার ও লঙ্ঘিত হয়েছে।

এই মামলার রায় ও পর্যবেক্ষণে পুরষতান্ত্রিকতার প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করছে মহিলা পরিষদ

তারা আরও বলেন, পুরুষতান্ত্রিকতা যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে, নারীকে যে এখনো অধীন ভাবা হয় এবং আইনেরও যে সীমাবদ্ধতা আছে— এই মামলার রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ একইসঙ্গে এই বিষয়গুলোকেও স্পষ্ট করে তুলেছে।

ধর্ষণকারীর স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দি দেওয়ার পরও কেন এ রায় প্রভাবিত হলো?— এমন প্রশ্ন তুলে বক্তারা বলেন, রায়টির পর্যবেক্ষণ নাগরিকের ন্যায় বিচারপ্রাপ্তিতে বাধা তৈরি করেছে। লৈঙ্গিক সমতা রক্ষার পরিবর্তে এই রায়ের পর্যবেক্ষণ চরমভাবে জেন্ডার বৈষম্য তৈরি করেছে। বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রাজ্ঞতা ও লৈঙ্গিক সংবেদনশীলতা কতটুকু বিবেচনায় নেওয়া হয়— রায়ের পর্যবেক্ষণের জের ধরে এ প্রশ্নও তোলেন মহিলা পরিষদের নেতারা।

বিজ্ঞাপন

মানববন্ধনে মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, রেইনট্রি হোটেলের ধর্ষণের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে তৈরি হওয়া নানা প্রতিক্রিয়ার ফলে রায় দেওয়া বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা সাময়িক প্রত্যাহার করার জন্য প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। এই ঘটনায় আশু প্রতিকার নেওয়া হলো। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা আইনি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে জানেন কি না, যথাযথভাবে ‍নিজ দায়িত্ব পালন করছেন কি না, ভিকটিমের প্রতি জেন্ডার সংবেদনশীল মনোভাব রাখেন কি না— এসব বিষয় কে মনিটর করবে?

মানববন্ধনে বক্তব্য রাখছেন মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম

তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বিচার বিভাগের এ দুর্বলতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আইন মন্ত্রণালয় নারীবান্ধব নানা আইন করলেও বাস্তবায়ন নেই। অপরাধের দায় স্বীকারের পর অপরাধীদের অসাধু উপায়ে এবং অন্যায়ভাবে টাকা ও ক্ষমতার অপব্যবহার প্রক্রিয়া থেকে বিচারব্যবস্থাকে মুক্ত করা না গেলে সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা কখনোই সম্ভব নয়। আইনের অপব্যাখ্যার দায় সমগ্র বিচার ব্যবস্থাকেই প্রভাবিত করে। বিচারব্যবস্থা যেন সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার পথকে সংকুচিত না করে প্রসারিত করতে পারে, সে লক্ষ্যে আরও কাজ করতে আইন ও বিচার বিভাগকে আহ্বান জানান তিনি।

ডা. মোসলেম আরও বলেন, বিচারের রায়ই শেষ কথা নয়। দোষ সবসময় প্রমাণ করা যায় না। তা সত্ত্বেও দোষী ব্যক্তি সমাজের কাছে দোষী হিসেবেই চিহ্নিত হবে।

এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ এবং ধর্ষণহ সব ধরনের নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে মানববন্ধন থেকে মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিতে বলা হয়— বিচারব্যবস্থায় জেন্ডার সংবেদনশীলতা নিশ্চিত করতে হবে ও নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে হবে; বিচারকদের জেন্ডার সংবেদনশীল মনোভাব তৈরি করতে তাদের প্রশিক্ষণে জেন্ডার ইস্যুকে সংযুক্ত করতে হবে; পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দূর করতে বিচারব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে; এবং সাক্ষ্য আইনের পরিবর্তনসহ অন্যান্য আইনের সংশোধন করতে হবে।

ধর্ষণের ঘটনায় নারীর চরিত্রহননের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আহ্বান জানানো হয় মানববন্ধনে

সংগঠনের অ্যাডভোকেসি ও লবি ডিরেক্টর জনা গোস্বামীর সঞ্চালনায় মানববন্ধন কর্মসূচিতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন সহসভাপতি রেখা চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, ঢাকা মহানগরের সাধারণ সম্পাদক রেহানা ইউনূস, কেন্দ্রীয় কমিটির লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক মাকসুদা আক্তার লাইলী। মানবন্ধনে অতিথি বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ কে রাশেদুল হক। এ সময় সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটির অন্যান্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে, বৃহস্পতিবার (১১ নভেম্বর) বিকেলে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারের আদালত রেইনট্রি ধর্ষণ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে আলামত পাওয়া যায় না উল্লেখ করে রায়ের পর্যবেক্ষণে ৭২ ঘণ্টা পরে ধর্ষণের মামলা না নিতে পুলিশকে ‘পরামর্শ’ দেন এই বিচারক।

২০১৭ সালে দায়ের করা এই মামলাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল অনলাইনে-অফলাইনে। আসামি সাফাতসহ বাকিদের গ্রেফতারে নানা ধরনের বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করেন। রায়ে পাঁচ আসামির সবাই খালাস পাওয়ার পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারের পর্যবেক্ষণও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। আইনজীবী, নারী অধিকারকর্মী, সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানীসহ সচেতন মহলও এই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

মহিলা পরিষদের নেতারা জেন্ডার সংবেদনশীল বিচারব্যবস্থার দাবি জানান

সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না নিজেও ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘৭২ ঘণ্টা পরে কেন, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি যখনই অভিযোগ দেবেন, তখনই সেই অভিযোগ পুলিশকে নিতে হবে।’ পর্যবেক্ষণের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এর আগেই এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘মামলা রুজু করার জন্য বিধিনিষেধ বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত করবে, যা মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থি।’

শুধু তাই নয়, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজেও এই পর্যবেক্ষণকে অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করেছেন। শনিবার (১৩ নভেম্বর) এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘উনার (বিচারক) অবজারভেশনে ৭২ ঘণ্টা পরে পুলিশ যেন কোনো ধর্ষণ মামলার এজাহার না নেয়, এই যে বক্তব্য উনি দিয়েছেন, এটি সম্পূর্ণ বেআইনি ও অসাংবিধানিক।’ একই অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী জানান, ওই বিচারকের ক্ষমতা সিজ (কেড়ে নেওয়া) করতে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেবে আইন মন্ত্রণালয়।

আরও পড়ুন-

সারাবাংলা/কেআইএফ/টিআর

ডা. ফওজিয়া মোসলেম ধর্ষণ মামলার রায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ রায়ের পর্যবেক্ষণ রেইনট্রি ধর্ষণ মামলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর