উজানে আর বসবে না আড্ডা, শেষ হলো না ‘তরলা বালা’
১৯ নভেম্বর ২০২১ ২৩:১৮
রাজশাহী: কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক খুবই আড্ডাপ্রিয় একজন মানুষ ছিলেন। প্রায়ই ঘনিষ্ঠদের নিয়ে বসে যেতেন আড্ডায়। বাইরে কোথাও নয়, নিজের বাড়িতেই বসত সেই আড্ডা। বাড়ির নাম ‘উজান’। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা-বিহাসের ভেতরে ঢুকে বাঁ দিকের গলিটার শেষ বাড়ি। সুনশান এই বিহাসের উজানের আড্ডাটা থাকত প্রাণবন্ত।
তবে করোনার প্রভাব পড়েছিল এই বাড়িটাতেও। শেষ দিকে অনেকটা নিঃসঙ্গ সময় কাটিয়েছেন হাসান আজিজুল হক। তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে কড়াকড়ি শুরু করেছিল পরিবার। ঘনিষ্ঠরাও ইচ্ছে করেই বাড়িটিতে যাওয়া বন্ধ করে দেন হাসান আজিজুল হকের করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে। এমন সাবধান হয়েও তারা ধরে রাখতে পারলেন না প্রিয় লেখককে।
হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ বকুলের। তিনি বলেন, ‘তিনি খুবই আড্ডাপ্রিয় মানুষ ছিলেন। উজানে তার পড়ার ঘরেই আড্ডা বসত। আমিসহ অনেকেই সেই আড্ডায় অংশ নিতাম। অসম্ভব স্মৃতিধর মানুষ ছিলেন তিনি। একেবারেই সেই ছোটবেলার অনেক কথা স্পষ্ট বলতে পারতেন। তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল প্রখর। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হতো। তাকে আমরা পেয়েছি, এটা আমাদের জন্য বিরাট গর্ব।’
শুধু ঘনিষ্ঠরাই নয়, করোনার আগে উজানে গিয়ে হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন তার ভক্ত-অনুরাগী, সাংষ্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিকরা। অনেকে যেতেন লেখা সংগ্রহ করতে। কেউ একটা ইন্টারভিউ নিতে অথবা অন্য কোন কারণে। কেউ দেখা করতে এসেছেন এ কথা কান পর্যন্ত পৌঁছালে হাসান আজিজুল হক কাউকে ফেরাতেন না।
তবে ঢাকা আর ঢাকার বাইরের লেখক-সাহিত্যিকদের দু’চোখে দেখার একটা আক্ষেপ তার মাঝে ফুটে উঠত। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, ঢাকার বাইরের লেখক-সাহিত্যিকদের কদর নেই। মন খুলে কথা বলতেন। বাড়িতে সব সময় মানুষের আনাগোনায় কখনও কখনও বিরক্ত হতেন পরিবারের সদস্যরা। তাও ভক্তরা যেতেন।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক একটা উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘তরলা বালা’। কিন্তু সেই উপন্যাসটি আর শেষ করতে পারলেন না তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন নারীকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে বড় পরিসরে তিনি শেষ করতে চেয়েছিলেন ‘তরলা বালা’।
বাংলা সাহিত্যে বড় শূন্যতা দিয়ে গত সোমবার (১৪ নভেম্বর) রাতে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ বকুল বলেন, “তিনি ‘তরলা বালা’ উপন্যাস লেখার কথা জানিয়েছেন। স্যার, অন্তত চার বছর ধরে তরলা বালা লেখার কথা জানাচ্ছিলেন। তিনি তরলা বালার বিষয়বস্তুও ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু শুরু করে আর শেষ করতে পারেননি।”
তিনি বলেন, ‘স্যারের তরলা বালা লেখার ইচ্ছাটা অপূর্ণই থেকে গেল। যদি আরও কিছুদিন সুস্থ থাকতেন তাহলে আরও কিছু লেখা উপহার দিতে পারতেন। বাংলা সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হতো। এবারের বইমেলায় একটি প্রকাশনী থেকে ‘তরলা বালা’র আংশিক লেখা প্রকাশিত হবে। তারা উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য প্রস্তুতিও সম্পন্নও করেছেন।’
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বহু ছোটগল্প আর উপন্যাসে সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যকে। ৮৩ বছর বয়সে গত সোমবার রাতে পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে। চলে যাওয়ার আগে তিনি শেষ যে গল্পটি লিখেছিলেন, সেটি ছিলো তার জন্মস্থানকে নিয়ে।
গল্পটির নাম ‘মাটির বাড়ি যতদিন চন্দ্র সূর্য’। গল্পটি পুরোপুরি শেষ হয়নি। অসমাপ্ত গল্পটিই রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমির লিটল ম্যাগাজিন ‘মহাকালগড়’-এ প্রকাশ হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে।
হাসান আজিজুল হকের জন্মস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। ছোটবেলার সেই গ্রাম, সেই বাড়ি, প্রকৃতি নিয়েই ‘মাটির বাড়ি যতদিন চন্দ্র সূর্য’ লিখেছিলেন হাসান আজিজুল হক। তবে এই গল্পটিও অসমাপ্ত। জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার আসাদ সরকার অনেকটা পীড়াপীড়ি করেই লেখাটি নিয়েছিলেন।
আসাদ সরকার বলেন, ‘মাটির বাড়ি যতদিন চন্দ্র সূর্য স্যারের শেষ লেখা। অসমাপ্ত গল্পটি নিয়েই আমরা আমাদের লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেছি। বাকি অংশটি পরের সংখ্যায় প্রকাশের কথা ছিলো। সেটি আর হলো না। গল্পটি যে অসমাপ্তই থেকে যাবে তা ভাবিনি।’
আরও পড়ুন:
একজন হাসান আজিজুল হক
হাসান আজিজুল হক আর নেই
প্রিয় ক্যাম্পাসে চিরনিদ্রায় শায়িত হাসান আজিজুল হক
সারাবাংলা/একেএম