যে দলেই থাকুক, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই সম্মান পাবেন: প্রধানমন্ত্রী
২১ নভেম্বর ২০২১ ১৫:৫৭
ঢাকা: মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়াসহ তাদের প্রাপ্য মর্যাদা নিশ্চিত করতে সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, তাদের সম্মান প্রকৃতপক্ষে ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর হারিয়ে গিয়েছিল। সেই সম্মানটা আবার যেন ফিরে আসে, আমরা তার ব্যবস্থা নিয়েছি। যে যেখানেই থাকুক, যে দলেই থাকুক— একজন মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাই। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই তিনি তার সম্মান পাবেন।
রোববার (২১ নভেম্বর) সকালে গণভবন থেকে ঢাকা সেনানিবাস আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সশস্ত্র বাহিনী দিবস-২০২১ উপলক্ষে স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত নির্বাচিত মুক্তিযোদ্ধা/ তাদের উত্তরাধিকারদের সংবর্ধনা প্রদান এবং ২০২০-২০২১ সালের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ শান্তিকালীন পদকপ্রাপ্ত সদস্যদের পদকে ভূষিত করা হয়।
এর আগে সকালে দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অনিবার্ণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তিন বাহিনীর প্রধান উপস্থিত ছিলেন। পরে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহীন ইকবাল এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষ থেকে শিখা অনিবার্ণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসটি বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপন করা হচ্ছে। দেশের সব সেনানিবাস, নৌঘাঁটি ও বিমানবাহিনী ঘাঁটির মসজিদে দেশের কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও সশস্ত্র বাহিনীর উন্নতি কামনায় ফজরের নামাজ শেষে বিশেষ মোনাজাতের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন- দেশের অগ্রযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়: প্রধানমন্ত্রী
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, সাবেক রাষ্ট্রপতি, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, সাবেক প্রধান উপদেষ্টা, মন্ত্রী ও মন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তি, প্রতিমন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার, বিদেশি রাষ্ট্রদূত, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিবসহ বিশিষ্টজনরা উপস্থিত থাকবেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ছয় বছর বিদেশে প্রকৃতপক্ষে আমাদের রিফিউজি হিসাবেই থাকতে হয়েছে। নিজেদের নাম-পরিচয়টাও আমরা দিতে পারতাম না। যারা আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল, তারা চায়নি আমাদের পরিচয় দেই। তাদের দেওয়া একটা নাম ধারণ করে আমাদেরকে থাকতে হয়েছে। সেই শোক-ব্যথা কষ্ট বুকে নিয়েও সবসময় একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম— একদিন বাংলার মাটিতে ফিরে যাব। জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলব। বাংলাদেশের মানুষকে দুঃখ-যাতনা থেকে মুক্তি দেবো।
বাংলাদেশ যে চেতনা নিয়ে, যে আদর্শ নিয়ে, যে লক্ষ্য নিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং জাতির পিতার যে স্বপ্ন ছিল এ দেশের মানুষের কল্যাণে, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, সেই হাসি আমরা একদিন ফোটাব। সেই চিন্তাভাবনাটাই আমাদের মধ্যে ছিল, সেটাই ছিল শক্তি। নইলে আমার মতো এভাবে যারা আপনজন হারায় তাদের পক্ষে কাজ করা খুবই কঠিন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এই সত্যটা জেনেছিলাম যে একটি আদর্শের জন্য আমরা বাবা জীবন দিয়েছেন। আমার মা জীবন দিয়েছেন। আমার ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে। লাখো মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিয়েছে। লাখো মানুষ শহিদ হয়েছে। লাখো মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের সেই স্বাধীনতা কখনো ব্যর্থ হতে পারে না। লাখো শহিদের রক্ত কখনো ব্যর্থ হতে পারে না এবং ব্যর্থ হতে আমরা দেবো না।
‘যখন ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসার সুযোগ পেলাম, তখন অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে, অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। ২১ বছর পর সরকার গঠন করি। তখনই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আবার সামনে নিয়ে আসা হয়। জাতির পিতার ৭ মার্চের যেই ভাষণ, একটা সময় সেটি নিষিদ্ধ ছিল। সেই ভাষণ এ দেশের মানুষ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বারবার বাজিয়েছে। আজ ইউনেস্কোর বিশ্ব প্রামাণ্য দলিলে স্থান করে নিয়েছে সেই ভাষণ। যে নামটি তারা মুছে ফেলেছিল, তারা ভুলে গিয়েছিল— সত্যকে যে মোছা যায় না,’— বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা এবং মুক্তিযোদ্ধোদের প্রত্যেকের পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করেছে। এমনকি একটা সময়ে তারা নিজেদের পরিচয় দিতে লজ্জা পেয়েছেন। কিন্তু আমি সরকারে আসার পর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তৈরি করি। কারণ তারা সম্মানিত। তারা নিজের জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। পরিবার-পরিজন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে তারা বাংলার মানুষকে মুক্ত করার জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছে। কাজেই তাদের সম্মান দেওয়াটাই আমাদের কর্তব্য বলে মনে করি। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নেই।
শেখ হাসিনা এসময় আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, স্বাধীনতার চেতনায় এবং বাংলাদেশকে যেভাবে জাতির পিতা চেয়েছিলেন সেভাবে গড়ে তোলার জন্য তার সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপও তুলে ধরেন।
জাতির পিতার স্বপ্নের আলোকে সশস্ত্র বাহিনী ঘিরেও ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমার একটাই লক্ষ্য— আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক যারা, তারা যদি শিক্ষা-দীক্ষায়-প্রশিক্ষণে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন না হয়, তাহলে বাংলাদেশের মর্যাদাও কখনো উন্নত হবে না। তাই তাদের দক্ষ-প্রশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে সম্ভাব্য সবকিছুই করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণ, যাদের জন্য জাতির পিতা সারাজীবন ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের ভাগ্য আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। কারণ তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। আমাদের এই কর্মসূচিগুলো শুধু শহরভিত্তিক না, একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত। গ্রামের মানুষরা যেন এর সুফলটা পায়, সেই পদক্ষেপই আমরা নিয়েছি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, দেশ যখন আমাদের আছে, মাটি যখন আমাদের আছে, বাংলাদেশের সোনার মানুষ যখন আছে, তখন আমরা সবই পারব। যদি আমরা সোনার ছেলে তৈরি করতে পারি। তাহলে ইনশাল্লাহ স্বপ্নের সোনার বাংলা একদিন অবশ্যই হবে। আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না, কিন্তু তা হবেই।
জাতির পিতার এ স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তার মধ্যে দূরদর্শিতা ছিল। তার মধ্যে এক ধরনের প্রফেসি ছিল। স্বাধীনতার পর সেভাবেই তিনি সব কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। তার হাতে সম্পদ ছিল না, কিন্তু মাটি আর মানুষকেই তিনি বড় সম্পদ বিবেচনা করতেন। আমরা যখন সরকারে এসেছি, তখন আমরাও তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নেই কাজ করে যাচ্ছি, করে যাব।
সারাবাংলা/এনআর/টিআর