Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চিকিৎসা খরচে প্রতিবছর নতুন দরিদ্র ৮৬ লাখ মানুষ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৩ নভেম্বর ২০২১ ০০:৩৮

ঢাকা: দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেওয়া ৯৭ শতাংশ রোগীই ওষুধ পান না। চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধ তাদের কিনতে হয় বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে। একইভাবে ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষাই রোগীকে করতে হয় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এর ফলে বেড়ে যায় রোগীর চিকিৎসা ব্যয়। বিশেষ করে ক্যানসার, কিডনি ডায়ালাইসিস ও ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসায় নিঃস্ব হয়ে যায় রোগী। প্রতি বছর এই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েন ৮৬ লাখ মানুষ। একইসঙ্গে এই অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে দেশে চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত থাকে ১৬ শতাংশ রোগী।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা যায়, তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য রোগীদের সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয় বাংলাদেশেই। দেশের সরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র পুরোপুরি দেওয়া হয় না এবং রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকে না। আর তাই সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা নিয়ে থাকেন মাত্র ১৪ শতাংশ রোগী। দেশের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ৯ শতাংশ রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন। তবে দেশের ৬০ শতাংশ রোগী এখন পর্যন্ত সেবা নিয়ে থাকে বিভিন্ন হাতুড়ে ডাক্তার, পল্লি চিকিৎসক, ওষুধের দোকান ও নিজেদের মতো করে ওষুধ কিনে।

বিজ্ঞাপন

ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকসহ প্রায় সব ধরনের ওষুধ কেনার সুযোগ থাকায় এবং ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মাত্রাতিরিক্ত বিপণনের ফলে স্বীকৃত চিকিৎসকদের পাশাপাশি পল্লি ও হাতুড়ে ডাক্তাররাও ব্যবস্থাপত্রে অতিমাত্রায় ওষুধ লেখেন— উল্লেখ করা হয় গবেষণাপত্রে।

এই গবেষণা ফলাফলের তথ্য বলছে, বেসরকারি হাসপাতাল অ্যাক্রিডিটেশন পদ্ধতি এবং এর সেবা মান ও মূল্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নজরদারি না থাকায় সেবাগ্রহীতা জনগণ প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সে বিষয়ে রোগীদের অসন্তুষ্টি ও কখনো কখনো আস্থার ঘাটতি তাদের দেশের পরিবর্তে বিদেশ থেকে সেবা নিতে উৎসাহিত করে। এভাবে চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে অনেক মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ সেবন করায় রোগীর ব্যয় বেড়ে যায় উল্লেখ করে গবেষণায় জানানো হয়, জরুরি ওষুধের তালিকা সংশোধন ও সম্প্রসারণ এবং ব্যবস্থাপত্রে প্রটোকল অনুসরণ করে কোম্পানির ওষুধের ‘ব্র্যান্ড নাম’ ব্যবহারের পরিবর্তে ‘জেনেরিক নাম’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে এই ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে সেবার ঘাটতি ও বেসরকারি হাসপাতালকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় রোগী চিকিৎসায় শৃঙ্খলা আসেনি। আর তাই বাড়ছে ব্যক্তিগত চিকিৎসা ব্যয়। এছাড়া গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা যথাযথ কার্যকর না হওয়ায় এবং শহর এলাকায় পর্যাপ্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা না থাকায় রোগীরা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন।

কী অবস্থায় আছেস্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশল: ২০১২৩২?

২০১২ সালে দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা নিতে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় করতে হতো ৬৪ শতাংশ অর্থ। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটানোর জন্য নেওয়া হয় ২০ বছর মেয়াদি কৌশলপত্র। এই ব্যয় ৩২ ভাগে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ‘স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশল: ২০১২-৩২’ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ২০১৫ সালে দেখা যায়, এই খরচ উল্টো বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ শতাংশে। প্রায় ১০ বছর পার হয়ে গেলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি ঘটেনি। উল্টো বেড়েছে রোগীর খরচের হার। বর্তমানে একজন রোগীকে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচের ৬৮ দশমিক ৫০ শতাংশ অর্থ নিজের পকেট থেকে ব্যয় করতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় দেখা যায়, রোগীকে নিজের পকেট থেকে চিকিৎসা খরচ বাবদ যে টাকা খরচ করতে হচ্ছে, তার ৬৪ শতাংশই ব্যয় হয়ে ওষুধ কিনতে। একইসঙ্গে হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরে সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ২৩ শতাংশ এবং বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যয় করা হয় ৮ শতাংশ অর্থ।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে তুলনামূলক চিত্র

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চিকিৎসা খাতে রোগীর পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় বাংলাদেশে। এ ক্ষেত্রে একেকজন রোগীকে চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫০ শতাংশ খরচ করতে হয় নিজেদের। ভারতে এই হার ৬৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে ৫১ শতাংশ, মালদ্বীপে ২১ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম ভুটানে ১৩ শতাংশ।

গবেষকরা কী বলছেন?

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. নুরুল আমিন বলেন, রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয়ের প্রধান উৎস হলো ওষুধ। দেশে মাত্র তিন শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতাল থেকে ‍ওষুধ পান। ফলে অধিকাংশ রোগীকে বেসরকারি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হয়। মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে হয়ে থাকে। বাকিদের বিভিন্ন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সেবা নিতে হয়। এতে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় বেড়ে যায়। এর কারণে প্রায়ই রোগী আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন।

গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহাদৎ হোসেন মাহমুদ বলেন, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকসহ প্রায় সব ধরনের ওষুধ কেনার সুযোগ থাকায় এবং ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মাত্রাতিরিক্ত বিপণনের ফলে স্বীকৃত চিকিৎসকদের পাশাপাশি পল্লি ও হাতুড়ে ডাক্তাররাও ব্যবস্থাপত্রে অতিমাত্রায় ওষুধ লেখেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ সেবন করায় রোগীর ব্যয় বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট সেলের ফোকাল পার্সন ডা. সুব্রত পাল বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বাজেট কম। একইসঙ্গে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে জনপ্রতি স্বাস্থ্য খাতে খরচ সবচেয়ে কম (৪৫ ডলার)। শুধু সরকারি অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে এর সমাধান সম্ভব না। একই সঙ্গে আমাদের খরচ করার দক্ষতা থাকতে হবে, যেন বাজেট অব্যবহৃত থেকে না যায়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের তথ্য মতে, দেশের রোগীদের সবচেয়ে বেশি খরচ হয় ওষুধ কিনতে। ফলে এ ক্ষেত্রে সরকারের সঠিক নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন দেশের ওওপি কমিয়ে আনবে বহুলাংশে।

রোগীর ব্যয় কমাতে দফা সুপারিশ

দেশে চিকিৎসাসেবা গ্রহণে রোগীর ব্যয় কমাতে পাঁচটি সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। প্রতিষ্ঠানটির মতে, ই-হেলথ চালুর মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সমন্বিত সেবা চালু করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা বাড়ানো ও পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ করার সুপারিশও করেছে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা খাতের জোগানের দিক শক্তিশালী করার পাশাপাশি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) বা সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা চালু ও সম্প্রসারণের মাধ্যমেও রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় কমানো সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

চিকিৎসা ব্যয় চিকিৎসার খরচ সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর